চায়ের কাপ চার টাকা।


মাঝে মাঝেই একা একা হাসি, অনেক বার হেসেছি, হয়ত বা আরো অনেক বার হাসবো
কখনো আবার একই রকম অবস্থার সম্মুখীন হলে। শুনতে চান কেন হাসি।
সত্যি গল্প, এবং গল্প টা এরকম….

মোজাম্মেল খান আমাদের মামা।
ফর্সা রোগা চেহারার হাস্য ময় চেহারার পরিপাটি যুবক।
বংশের অভিজাত্য চেহারায় এবং আচরণে , বরিশালের বাবুগঞ্জ থানার
বিখ্যাত খান বংশের সন্তান। বরিশালের স্কুল শেষ করে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছেন।
পড়াশুনার প্রয়োজনে। মেসে থাকেন, ঈদে কিংবা কোরবানির ছুটিতে, গোটা চারেক আনারস এর মাথায় খাকি রশি
বেঁধে আর কমলার টোঙ্গা ডানহাতে করে যখন বাইরের বাড়ী থেকে হেটে আসতেন, তার হাসি দেখে আনন্দ দেখে
আমরাও আনন্দিত হয়ে যেতাম। মানুষের দেশে ফেরা টা কত যে আনন্দের ব্যাপার হতে পারে তা
মোজাম্মেল মামার সেই চোখ না দেখলে, বিশ্বাস করা কঠিন।
মোজাম্মেল মামা আমার আপন মামা নন, নানা বাড়ির বংশের মামা।
আর মানুষের আনন্দ দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে, বাংলাদেশের ঈদ পূর্ব বর্তী উপজেলা কিংবা
গ্রামের হাঁটে বা বন্দরে।
শনি বা বুধ বারের গ্রামের হাট, শহর ফিরতা মানুষে গমগমে।
গল্প হবে কথা হবে , ঢাকা শহরে কি রকম রাজা উজি র মারছে সেই সব গল্প।
গল্পে গল্পে রাত হয়ে গেলে, এভেরিডি টর্চ লাইটের আলোতে গ্রামের মাটির পথ ধরে কয়েক জন মিলে
হৈ হৈ করে
বাড়ী ফেরা।

ঢাকায় মোজ্জাম্মে মামা মেসে থাকেন। পড়া শুনা চালাতে উনি টিউশনি করেন।
পাশের মেসে থাকেন, ওনার বড় ভাই, চাকরি করেন জিপিওতে কিংবা এজিবিতে
কোনটায় মনে নেই।
তবে উনিও মেসে থাকতেন, দুই ঈদে বাড়ী ফেরা।
ব্যাংকের কড়কড়ে নতুন টাকা আনতেন, আর সেই টাকায় বাবুগঞ্জের হাটে বাজার করতেন।
দোকানি টাকাটা হাতে পেয়ে উল্টে পাল্টে দেখত আর
জিজ্ঞেস করতো “নতুন টাকা, খান সাহেব “?
হ নতুন টাকা। হাসি মুখে বলতেন, ঢাকা ফেরত খান সাহেব।
ঈদ শেষে আবার ফিরে যেতেন কর্ম স্থলে।
মামী আর ছেলেমেয়ে রা অনেক দূর এগিয়ে দিত, গ্রামের পথে।
শুধু বড় মেয়েটি ভেজা চোখে বলতো ”
“আব্বা আপনি আবার কবে আসবেন ”
আসবোরে মা ছুটি হলেই আসব।

মেসের খাবারের মেনু কি রকম, সপ্তাহে একদিন গরুর কিংবা মুরগীর গোস্ত, মাছ কম করেও একদিন।
ডাল তো প্রতিদিন ই থাকবে, পেট ভরে খাও।
আর চাল কিরকম ?
চাল টা হতে হবে একদম সরেস।
যে রান্না করে, সে ই বাজার ঘাট করে। তার নাম হল হাতেম, সবাই তাকে হাতেম ভাই ডাকে, আমি ডাকি হাতেম তাই।
কয়েক জন আড়ালে আবডা, লে আবার ডাকে কাডল হাতেম , ওনার পেট খানা কাঁঠাল শেপের অনেক টা, তাই ওনাকে কাডল হাতেম ও
ডাকা হয়, কিন্তু আবডালে।
সবচেয়ে দর্শনীয় বেপার হলো ওনার ভাত খাবার সময় টা।
উনি ভাত খাবেন, মানে খেতে বসবেন খালি গায়ে। খেতে বসছেন কি ঘামতে শুরু করছেন
শীত কিংবা গ্রীস্ম হাতেম ভাই ঘামবেই।
হাতে লাল সবুজ নীলের চেক কাটা ঝাল কাঠির গামছা দিয়ে, কপাল মুচ্ছেন হাতেম ভাই।
কাঁঠাল ভুঁড়িতে চক চকে ঘাম পিঠে ঘাম, দুই হাটু হাত পা ঘেমে একাকার।
রান্না যাই হোক না কেন, উনার মেনু সারা জীবন একটাই, ডাল আলু ভর্তা পোড়া মরিচ আর একবাটি ডাল।
সকাল বেলা পান্তা ভাত আর পিয়াজ লবন। ডাল না হলেও চলবে সকাল বেলা।
ভাই যান, সকাল বেলাটা হইলো কামের সময়, হেই সময় বেশী খাইলে চলবো কেমনে ?
সকাল বেলাটা হালকা খাইবেন, মিয়া ভাই।
রাইতের বেলা খাইবেন পেট পুইড়া।
হাতেম ভাই বেশি খাননা, শুধু খাড়া কান্দার মানে বাটির মতো প্লেটে দু প্লেট ভাত, সকাল বেলা।
পান্তা ভাত খেতে গেলেও ঘাম দেখবেন ওনার কপালে।
সেই হাতেম তাই, খবর নিয়ে আসলো, যা অবিশাস্য মনে হলো আমার মোজাম্মেল মামার কাছে।
মোজা ভাই খবর শুনছেন ? মোজাম্মেল ভাই, না বলে ওনাকে ভালো বাসায় মোজা ভাই ডাকে।
কি খবর, হাতেম ভাই।
ঢাকা শহর তো আর চললো না।
কেন কি হয়েছে, ঢাকা শহর চলবে না কেন?
গন্ডগোলের পর হইতেই সব যানি কেমন পাল্টাইয়া যাইতাছে।
কি পাল্টাল আবার।
আর পৃথিবী হলো পাল্টানোর জায়গা, রোজ পাল্টাবে, তুমি চাও বা না চাও।
আর ওটা
গন্ডগোল না হাতেম ভাই, স্বাধীনতা যুদ্ধ। আমরা স্বাধীন।
স্বাধীন হইয়া লাভ কি হইলো আমাগো, কন তো? সব কিছুর দাম ই তো বাইরা গেলো।
এক কাপ চায়ের দাম হইয়া গেছে চার টাকা। মানসে চা খাইবো কেমনে।
মুজিবের লাইগ্গা আমার মায় কোরান খতম করছে, রোজা রাখছে।
হেয় কেমনে করছে এমন কাম।
মোজাম্মেল মামা চমকে গেলো।
তার মনে গেথে গেছে, হাতেম ভাইয়ের মেসেজ।
মনে মনে বললো হা, রেস্টুরেন্ট ভেদে দাম কম বেশি হতে পারে
তাই বলে চার টাকা কাপ?
মোজাম্মেল মামা বুঝতে চেষ্টা করছেন, চায়ের দামের সাথে মুজিবের কি সম্পর্ক উনি তো আজ সকালেই দোকানে চা খেলেন, কই তেমনটা তো দেখলেন না।
কোথায় এতো দাম, এক কাপ চায়ের?
গিয়া দেখেন, হোটেল দি প্যালেস এ। বড় লোকের জায়গা, তা না হইলে
এককাপ দামি চা খাইয়া জীবনডা সার্থক করতাম।
জীবনে আর আছে কি ?
কয় দিন পর তো এমনেই মইরা যামু।
যেতে চান সেই চা খাইতে।
নারে ভাই , আমারে তো ঢুকতেই দেবেনা। আমি তো মেসেই চা খাই।
আর কোনো কোনো সময় টঙের দোকানে।
তাইলে দাম জানলেন কেমনে , ওই হোটেলের ?
আমার গেরামের একজন কাম করে , হেরে জিগাইছিলাম।

মোজাম্মেল মামা এই গল্প করছিলো এক সহ পাঠির সাথে।
যথা রীতি সিদ্ধান্ত হইলো, একটু পয়সা জমিয়ে একদিন যেতে হবে ওই হোটেলে চা খাইতে , কিন্তু সাথে নিতে হবে
হাতেম তাই ভাই কে। উনি যেন এতো দামি এককাপ চা খেয়ে ওনার এই
মানব জীবন সার্থক করতে পারেন।
আমাদের দায়িত্ব হবে ওনার জীবন সার্থক
হতে সাহায্য করা।

বৃহস্পতি বার সন্ধ্যা। মেঘ ভাঙা শেষ বিকেলের তির্যক সূর্য দ্রুত লুকিয়ে পড়ার তালে আছে।
সেই সাথে কেমন ড্রাগন হল্কায় উত্তাপ দিয়ে চলছে।
চার জন হেটে চলছে , হোটেল দি প্যালেসের দিকে
আজকের সন্ধ্যা চায়ের অভিযান। চায়ের সন্ধ্যা।
চা পার্টি।
রিক্সা নেয়া যাবে না , রিক্সা নিলে বা বাস ভাড়া দিতে গেলে
বাজেটে পোষাবে না।
চার জনের বিল ষোলো টাকা, আর বকশিস। বড়ো হোটেলে বকশিস দিতে হয়।
” আজকের গ্রীষ্মের এই বিকেল টায় , ভেপসা গরম, আবার বৃষ্টি আসবে নাকি ”
এক বন্ধু উদ্বেগের স্বরে বললো।
“না তেমন মনে হয় না। ”
“আর আসতে আসতে আমরা হোটেলে পৌঁছে যাবো , চিন্তা করিস না। ”
—–বৃষ্টিতে ভিজে গেলে কিন্তু বে ইজ্জত হয়ে যাবে।
“ভিজবোনা চিন্তা করিসনা।

সবাই ই যে যার সর্বোৎকৃষ্ট কাপড় পড়েছে।
সমস্যা দেখা দিলো , যার জন্য এই অভিযান তাকে নিয়ে।
সারা মেস জুড়ে এক বেলা ব্যবহারের জন্য , একটা প্যান্ট ও পাওয়া গেলো না যা ওনাকে মানে হাতেম ভাইকে ফিট করে।
আর পাঞ্জাবি একখান পাওয়া গেলো মনসুর ভাইয়ের গত ঈদের
শ্বশুর বাড়ী থেকে নতুন জামাই হিসাবে পাওয়া উপহার। কিন্তু পেটের কাছে টাইট। তবে পাজামা পেতে কষ্ট হয়নি।
খালেক সাহেবের সম্প্রতি দর্জির দোকান থেকে ডেলিভারি নেয়া পাজামা।
কয়লার আয়রন মেশিনে স্ত্রি করা।
সিদ্ধান্ত হইলো হাতেম ভাই হোটেলে ঢোকার আগে পাঞ্জাবি পড়বেন , তাতে দুটি লাভ এক হাতেম ভাইকে
বেশি সময় পেটের কাছে টাইট পাঞ্জাবি পরে থাকতে হবে না, দুই ওনার ঘাম থেকে একটু সময় বেঁচে থাকতে পারবেন।
সেই মতো ই কাজ হইলো।
উনি ঢোকার মুখেই পাঞ্জাবি পরে একটু গুজো হয়ে রইলেন। পেট টাও নিচের দিকে চেপে রইলেন।
ছোট ছোট সৌখিন কাপে চা।
বানানো চা না , গরম পানি ভিন্ন পটে, চিনি দুধ ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে।
চেয়ারে বসে একই টেবিলে চা খেতে, খুব দ্বিধা হচ্ছিলো হাতেম ভাইয়ের।
চা দেয়া হলো , হাতেম ভাইয়ের চোখে জল।
হাতেম ভাই কি হলো ?
আমার মাইয়াডার কথা মনে হইতে আছে।
মাইয়াডা বড়ো সৌখিন হৈছে , আমার মাইয়া মরিয়ম বড়ো শৈখিন হৈছে ,
বাপের মতো।
আচ্ছা আপনার মেয়ে মরিয়ম যখন গ্রাম থেকে আসবে তখন ওকেও নিয়ে আসবো
চা খেতে।
চায়ের শেষে কাচের কারুকাজ করা ওভাল শেপের প্লেটে মৌরিতে ডুবানো
চিরকুটের মতো বিল আসলো
——–চার টাকা।
চার টাকা মাত্র ? হাতেম ভাই অবাক হলেন।
যেমন অবাক হতে দেখেছি
অনেক বসর আগে দুবাই ফেরত এক আত্মীয় কে
হোটেলের বিল দিতে গিয়ে —–” মাত্র সাতশো টাকা ” ?
হাতেম ভাইয়ের কথাটা এমন শুনালো, যেন চার টাকা না হয়ে চারশো টাকা হলে ভালো হতো , ভালো লাগতো।
যে বেয়ারা চা পরিবেশন করেছিল। সে দূর থেকে সব খেয়াল করছিলো,
এবং অনেকটাই অনুমানে বুঝতে পারছিলো।
কাছে এসে নিচু স্বরে , হাতেম ভাইয়ের কানের কাছে বলল।
” স্যার, চার কাপ চায়ের দাম হয়েছে চার টাকা “।

শামীম। টরন্টো। কানাডা।

 

শেয়ার করুন