—*সুহেল ইবনে ইসহাক
আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, হাওয়ায় কাশফুলের দুলুনি-এই যেন সৃষ্টির অপার বিস্ময়। যান্ত্রিক নগর জীবনে সব কেন যেন ভুলতে বসেছি।গ্রামের সেই হদরপুর, মন্টেকা আর চাতল মাঠ, সেই দিগন্তজুড়ে কাশফুলের ছন্দের বারতা বারবার ছুঁতে ইচ্ছে করছে খুব। দূর আকাশে সাদা মেঘের ভেলা I চারদিকে শান্ত, সমাহিত ভাব। ছোট গাঙ(ছোট নদী)এর তীরে, প্রান্তে শুভ্র কাশফুলের সারি।প্রকৃতির নরম গায়ে বর্ষার স্যাঁতসেতে শ্যাওলা ধরা আড়মোড়া ভেঙ্গে গেলে আকাশের বিস্তীর্ণ হদরপুর মাঠে নীলের আবছায়া ঘন হয়ে ওঠে।গ্রামের পিচ্ছিল পথ শুকনো ধুলোয় শক্ত হলে আকাশ বালিকা আরও নীল হয়ে নীল শাড়ি পড়া তরুণীর মতো চপল নূপুর বাজিয়ে স্থির ঝুলে থাকে শূন্যতায়।সে নীলের মাঠে সাদা সাদা মেঘ- কোদাল পড়া জমির মতো ভেসে বেড়ায় নিবিড় ছন্দে।বালিঙ্গা গাঙে কিংবা বিকমায় মাছ ধরা, কলাই ক্ষেতের সবুজের মধ্যে হাঁটা; সর্ষে ফুল, শোলা ফুল, হিজল ফুলের মধ্য দিয়ে ছোটাছুটি, নৌকায় কিংবা জমির আইলে নাশতা খাওয়া, হালচাষের পেছনে হাঁটা, অবারিত মাঠে ঘুড়ি ওড়ানো, এসব আমার ঘুঙ্গাদিয়া গ্রামের মুক্ত জীবনের স্মৃতিবিজড়িত আনন্দ। অন্তর জুড়ে আছে জ্যোৎস্না রাতে উঠানে বিছানো নারিকেল পাতা কিংবা খড়ের মধ্যে বসে গল্প করা।
শরৎকালে ছোট নদী ও বালিঙ্গা গাঙের কূল-ঘেঁষে চরে চরে কাশফুল ধুতি গায়ে ব্রাহ্মণের মতো হেলে দুলে চলে অনিন্দ এক দোলনায়। যে দিকে চোখ যায় সেদিকেই সবুজ, কাশবন আর কাশফুল। বালিঙ্গা গাঙ ও ছোট নদীর জলে ছলছল জল-তরঙ্গ নেচে নেচে বয়ে যায় এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্তে, উত্তর থেকে দক্ষিণে ,হদরপুর থেকে মুড়িয়া হাওড়ে।শরতের সে রূপ থেকে রং ছিটকে পড়ে কখনো নীল, কখনো সাদা মৃদু বাতাসে বিলের পানিতে কাঁপন তুলে। সাদা কাশফুল, শিউলি, স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, আর দিনভর আলোছায়ার খেলা এসব মিলেই তো আমার গ্রামের চির সবুজ প্রকৃতি!চারদিকে মেঘ, বৃষ্টি আর রোদের খেলা। নেই মলিনতা। চারপাশে যেন নির্মল আনন্দ আর উচ্ছ্বাস। প্রকৃতিতে চলে অনাবিল রঙের আনাগোনা।পল্লীর নীল আকাশে বাঁধনহারা সাদা মেঘের পদসঞ্চারI নির্মল আকাশে শুভ্র মেঘের উড়োউড়ি সত্যিই মধুর। জীবনানন্দের রূপসী বাংলায় যেন নতুন প্রাণের ছোঁয়া লাগে। নব যৌবন বিকশিত হয় আকাশে।
প্রকৃতির অপূর্ব সৌন্দর্য এতটাই মুগ্ধ করবে যে, ক্লান্ত হয়ে যাওয়া যে কেউ ভুলেই যাবেন। রাতের বেলায় দেখবেন প্রকৃতির আরেক রূপ ও রঙ। রাতের আকাশ চাঁদের আলোয় আলোকিত করে ফেলে। চাঁদের আলোয় রাতের বাঁশঝাড় ও গাছপালা গুলো অদ্ভুত সুন্দর লাগে।গ্রামের প্রধান পাকা রাস্তার পাশে চৌধুরী বাড়ির বড় দিঘির পশ্চিম পাড়ের ঘাট চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। আষাঢ়ের রাতে ভরা পূর্ণিমার চাঁদ ঠিক যেন নবধূর মুখ! তবে আমার আজ মনে হচ্ছে, এই চাঁদের মালিক শুধুই আমাদের গ্রাম |এক সময় দিনের বেলা কৃষাণীরা শীতল পাটি তৈরী করতো, এবং ভাংতো, রোদে শুকাতো আজ যা শুধুই স্মৃতি|অধুনা দৈনন্দিন জীবনে গ্রামীণ সংস্কৃতির তিরোধান। একসময় যা অতি পরিচিত, অতি স্বাভাবিক ছিল, আজ তা লোকমুখেও শোনা যায় না। এমনকি গ্রাম বা ছোট ছোট শহরেও নয়। চোখের সামনে সব অদৃশ্য হয়ে গেল।
গ্রামের একমাত্র বাজার কাজীর বাজারের পূর্ব দিকে বহে যাওয়া ছোট্ট খাল যা বিকমা নাম পরিচিত । এই বিকমার পাড়ে দাঁড়িয়ে পূর্বদিকে থাকলে চোখে পড়বে শুধুই সবুজের সমারোহ। প্রকৃতি যেন অপূর্ব সাজে সজ্জিত হয়ে আছে। প্রকৃতি যেন শ্যামলের সিংহাসন করে বসে আছে সেথায়। প্রকৃতি এক এক জায়গায় এক এক রূপ বৈচিত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার দুই ধারে নারকেল, শিমুল, সুপারি গাছ সবুজ বৃক্ষরাজি মাথা উঁচু করে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে।বাতাস বহে অপূর্ব সুন্দর লাগে।মনে হবে যেন এরা এখানকার চিরন্তর প্রহরী। পথিকদের স্বাগতম জানাচ্ছে।
মাঝে মাঝে শীতকালের রাতে চাঁদের আলোয় বরফাচ্ছন্ন গাছপালা সারিবদ্ধ বসতি ও রাস্তাগুলো অধিক আলোয় আলোকিত হয়ে পড়ে| চাঁদটা পূর্ব দিগন্ত থেকে পশ্চিমে হেলে যেত, তবু ঘুম আসত না। ব্যালকনিতে জ্যোৎস্নার আলো, তখন মনটা চলে যায় শসার মাচায় ঝুলন্ত শসায়, শিউলি ফুলের সুবাসে|
আমাকে বিমোহিত করত নদীর পাল তোলা নৌকা ও মাঝির ভাটিয়ালি সুর। এমন আরো অনেক আনন্দ উৎসবের মধ্য দিয়ে কেটেছে আমার ছেলেবেলা। আর এ আনন্দগুলোই আজ আমি প্রকাশ করতে চেষ্টা করি আমার শিল্পকর্মে। জীবনের যন্ত্রণা আর অসংগতির প্রতিবাদ না হয়ে নির্মল আনন্দের স্মৃতিচারণা হয়ে ওঠে আমার শিল্পকর্ম। ফেলে আসা দিনের আনন্দের লাবণ্যটুকুই আমার শিল্পকর্মের প্রকাশভঙ্গির মধ্যে নিয়ে আসতে চেষ্টা করি। অধুনা দৈনন্দিন জীবনে গ্রামীণ সংস্কৃতির তিরোধান। একসময় যা অতি পরিচিত, অতি স্বাভাবিক ছিল, আজ তা লোকমুখেও শোনা যায় না। এমনকি গ্রাম বা ছোট ছোট শহরেও নয়। চোখের সামনে সব অদৃশ্য হয়ে গেল।
*রচয়িতা : কানাডা প্রবাসী কবি ও কলাম লেখক