বাংলা একাডেমীর ‘ধানশালিকের দেশ’ এর একটি সংখ্যায় শামসুল আরেফিনের একটি ছড়ায় পড়েছিলাম।
‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম
সবার মুখে আসে
ভালবাসা অতি খাঁটি
মিটমিটিয়ে হাসে।’
আপনে বাঁচলে বাপের নাম কথাটি কার জানা নেই।
ভালোবাসা হোক আর যাই হোক আগে নিজে বাঁচতে হবে। এখানে কোন আপোষ নাই। ভালোবাসা শ্বাশ্বত। এর মাধ্যমে একজন আরেকজনের হয়ে যায়। কিন্তু সত্যিই কি তাই? গত ১ আগষ্ট একটি গল্পে পড়লাম নায়িকা নিজেকে নায়কের কাছে এমনভাবে সমর্পিত যে কোন কালেই তার এখান থেকে সরে যাওয়া সম্ভব নয়। অসীম সেই ভালোবাসা কয়েকদিনেই ফিকে হয়ে এলো। নিজের কারনগুলোকে অদৃশ্যে রেখে অপকৌশলে নায়িকা বলেই ফেলল ‘তোমাকে বাঁচিয়ে দেয়ার জন্যই আমি সরে গেলাম’।
ভালোবাসার রং কী অদ্ভুত। আসলে মানুষের মনের ভাষা অন্যরকম। সে নিজে যা ভাবে মন তাতে সায় দেয় না। আহারে! ভালোবাসা!! কখনো হিমালয়ের মতো শক্ত কখনো নড়বড়ে ইসুবগুলের ভুষির মতো।
একটা ভালোবাসার গল্প প্রসঙ্গক্রমে বলি। এর আগেও কোথাও কোন প্রসঙ্গে হয়তো গল্পটি লিখেছিলাম। গল্পটি স্বামী-স্ত্রীর গভীর ভালোবাসার এক উপাখ্যান। স্বামী দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত’্যর প্রহর গুনছেন। স্ত্রী দেবতার সামনে বসে বলছে হে ভগবান আমাকে তুমি স্বামী হারা করো না।
আমার অবুঝ সন্তানদুটোকে পিতৃহারা করো না। এভাবে পূজোয় বসে আহাজারী করতে করতে চোখের পানিতে স্ত্রী বুক ভাসাচ্ছেন।
এসময় আবার ডাক্তার এলেন।
পরীক্ষা করে বললেন স্বামীর শেষ ইচ্ছা হিসাবে কিছু খেতে চাইলে খেতে দিতে পারেন। আজ রাতটা হয়তো তিনি বাঁচতে পারেন। অসহায় স্ত্রী স্বামীর কাছে গেলেন। কি খেতে চান জানতে চাইলেন। স্বামী বললেন পাঠার মাংস খাবো। স্ত্রী হাতের চুড়ি বিক্রি করে পাঠার মাংস এনে রান্না করল।
রাত দশটায় অষুধ খাবার পর মাংস খাওয়াবেন ভেবে আবার তিনি দেবতার সামনে গিয়ে কাঁদতে থাকেন। এদিকে রান্না ঘরে পাঠার মাংসের গন্ধ পেয়ে একটা কুকুর রান্নাঘরে ঢুকে মাংসের ডেকচিতে মাথা ঢুকিয়ে দেয়।
মাংস খেয়ে মাথা বের করতে দিয়ে কুকুর পড়লো বিপাকে। মাথা বের করতে না পেরে কুকুর দুপায়ে দাড়িয়ে এদিক ওদিক ছুটতে ছুটতে যেখানে ঈষৎ অন্ধকারে স্ত্রী কাঁদছিলেন সেখানে এসে দাড়িয়ে লাফালাফি করতে লাগলো। ডেকচির ভেতর কুকুরের মাথা। কুকুর দুপায়ে উঁচু হয়ে দাঁড়ালো।
কানাœরত স্ত্রী এ অবস্থায় কুকুরটিকে দেখে ভড়কে গেলেন। স্ত্রী মনে করলেন নিশ্চই তার স্বামীর জন্য যম এসে পড়েছে এবং যম ভুল করে তার কক্ষে ঢুকে পড়েছে।
তার মানে তাকেই মরতে হবে। স্ত্রী তখন কান্না জড়িত চিৎকার করে উঠে বললেন
‘আপনি ভুল করে আমার কাছে এসেছেন। রুগীতো আমার স্বামী। তিনি তো ঐ রুমে। আপনি ঐ রুমে যান।’
এই বলে স্ত্রী কুকুরটাকে স্বামীর কক্ষের দিকে আঙ্গুল দিয়ে নির্দেশ করল।
পাঠকরা নিশ্চই ভালোবাসার করুন অবস্থান বুঝতে পারছেন। আসলে ভালোবাসার গতি প্রকৃতিই এমন। মানুষের মনের প্রকৃত অবস্থান বোঝা কঠিন। ভালোবাসা চিরন্তন। আমারা গল্পে, কবিতায়, গানে, সুরে সর্বদাই ভালোবাসার কথা বলি।
কোন কোন ভাবে সব মানুষের জীবনে ভালোবাসার প্রবেশ অথবা অনুপ্রবেশ ঘটে। এটা হতেই পারে। তবে সব ভালোবাসাই যে ফাঁকির ওপর অবস্থান করে তা ঠিক নয়। লাইলী-মজনু, শিরী-ফরহাদ ছাড়াও আমরা শেকসপীয়র, টলস্টয়, রবীন্দ্রনাথে বহু কাহিনী চিত্রন অবলোকন করেছি। ভালোবাসতে হলে মন খুলে পবিত্রতার সাথেই বাসা কাম্য। মনের মধ্যে যাদের কালিমা লেপ্টে আছে তারা আর যাই হোক অন্তত: এ ভুবনে না আসাই ভালো।
তবে মজার কথা কি! তারা পার্টটাইম এ ভুবনে এসে এনজয় করে। ছেলে বাবাকে, মেয়ে মাকে, স্বামী-স্ত্রীকে, প্রেমিকা-প্রেমিককে যেমন ভালবাসে একইভাবে স্রষ্টাকেও ভালবাসা যায়। ভালবাসা যায় স্রষ্টার অপার সৃষ্টি প্রকৃতিকেও। যেভাবে বেসেছিলেন সক্রেটিস। আর ভালোবাসা যায় নিজের দেশকে। কথায় বলা হয় ‘যে নিজের দেশকে ভালবাসতে জানে না সে সেই দেশে থাকার যোগ্য নয়। দেশপ্রেম তাই সবার মাঝে থাকা উচিৎ।
দেশের মাটিকে যদি আমরা ভালবাসতে পারি তাহলে এদেশের পন্যকেও আমরা ভালবাসতে শিখব। দেশীয় পন্য ছেড়ে ভিনদেশী পণ্যের প্রতি আগ্রহ থাকা প্রকৃত দেশপ্রেমের পরিচায়ক নয়।
পাশ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে যারা সফর করেছেন তারা নিশ্চই অনুধাবন করেছেন নিজের দেশের প্রতি তাদের প্রেম কি অপরিসীম। দেশের প্রশ্নে তারা ধর্ম বর্ন কোন কিছুকেই স্থান দেয় না, দিতে চায় না। ভালোবাসা যদি চিরন্তনই হয়, তাহলে এর মধ্যে দেশপ্রেমকেও স্থান দিতে হবে।
দেশের সুখে হাসতে হবে, দেশের সুখে কাঁদতে হবে।মনে রাখতে হবে সমর্পিত একবার হয়ে গেলে সরে আসার সুযোগ নেই।
‘বাংলার মাটি বাংলার জলে’ যদি সমর্পিত হয়ে থাকি তাহলে এখানেই জন্মমৃত্যূর ঠিকানা জানান দিতে হবে- সরে যাবার সুযোগ নেই।
আর যারা সরে যাবার চিন্তা চেতনার বৈশিষ্ট্যকে মনে মনে লালন করেন তারাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে পৌঁছাবেন বিশ্বাস ঘাতক হয়ে।
বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক চর্চা হচ্ছে কিন্তু প্রকৃতভাবে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক পরিপূর্ণ রূপ খুঁজে পাচ্ছে না। তার মানে আমরা দেশপ্রেমে পিছিয়ে আছি।
দেশপ্রেমে এগিয়ে থাকা প্রকৃত গনতন্ত্রেরই অন্যতম পূর্বশর্ত।