স্টাফ রিপোর্টার॥ মৌলভীবাজারে সক্রিয় জাল স্ট্যাম্প বিক্রেতা চক্র। স্ট্যাম্প আসল না নকল তা সহজেই চেনা যায়না বলে, সে সুযোগকে কাজে লাগিয়ে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ভেন্ডাররাই জড়িয়ে পড়েছে জাল স্ট্যাম্প ব্যবসায়। ফলে আসল স্ট্যাম্প মনে করে অনেকেই গুরুত্বপুর্ণ সব চুক্তি লিপিবদ্ধ করছেন নকল স্ট্যাম্পেই।
মৌলভীবাজারে জাল স্ট্রাম্প, কোর্ট ফি বিক্রি হলেও জেলা প্রশাসন অবহিত নয়। কিন্তু জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের এক এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট জাল কোর্ট ফি তার নজরে আসে। বিষয়টি তিনি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) অবহিত করেছেন।
জাল নন-জুডিশিয়্যাল, কোর্ট ফি, রেভিনিউ স্ট্যাম্প বিক্রি হলেও জেলায় কর্মরত সিআইডিসহ অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অবহিত নয় এমন কথা জানিয়েছেন মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার শাহ জালাল (পিপিএম)। তবে বিষয়টি তিনি তা খতিয়ে দেখবেন বলে জানিয়েছেন।
সূত্র জানিয়েছে, জাল স্ট্যাম্পের ব্যাপারে সাধারণত ক্রেতারা সতর্ক থাকেন না। সরকার মনোনীত লাইসেন্সধারী স্ট্যাম্প ভেন্ডারদের কাছ থেকে স্ট্যাম্প কিনেই নিশ্চিত থাকেন ক্রেতার। আর অসাধু ভেন্ডাররা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেদারসে বিক্রি করে চলছে নকল বা জাল স্ট্যাম্প। এদের মধ্যে শাহিন, রাসেল, জুবায়ের, হোসেনসহ অনেকেই রয়েছে। এর ফলে সরকার হারাচ্ছে কোটি টাকার রাজস্ব।
মৌলভীবাজারে এখন আর জাল স্ট্যাম্প নেই বলেই চলে তবে কিছু হয়তো গোপনে থাকতে পারে সাধারণভাবে স্ট্যাম্প আসল না নকল তা চেনাও কষ্টসাধ্য বলে জানিয়েছেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসনের রেক্রডরুম এর কর্মকর্তা আতিয়ার রহমান। এমনকি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষেও জাল স্ট্যাম্প সনাক্ত করা অনেকটা দুঃসাধ্য ব্যাপার। এই সুযোগে বছরের পর বছর জাল স্ট্যাম্প তৈরি করে সারা দেশে সরবরাহ করছে সক্রিয় চক্রগুলো। এতে লোকজনের অজান্তেই লাখ লাখ গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি লিপিবদ্ধ হচ্ছে জাল বা নকল স্ট্যাম্পে।
জাল স্ট্যাম্পে চুক্তি করার ফলে আইনত ওই চুক্তির কোনো বৈধতা থাকছে না বলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্রটি দাবি করে বলছে, যেখানে চুক্তিটাই হচ্ছে জাল স্ট্যাম্পে, সেখানে আইনত ওই চুক্তির কোনো ভিত্তি থাকছে না। জাল স্ট্যাম্পে প্রতিনিয়তই এমন চুক্তি হচ্ছে সারা দেশে। ফলে লাখ লাখ চুক্তির আইনগত বৈধতা নিয়ে যে কোনো সময় প্রশ্ন উঠতে পারে।
উল্লেখ্য যে, ২০১৬ সালের ১৮ অক্টোবর মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে র্যাবের অভিযানে জাল স্ট্যাম্পসহ দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ১৮ অক্টোবর) রাত সাড়ে ৯ ঘটিকায় র্যাব-৯ শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের এএসপি মাঈন উদ্দিন চৌধুরী এর নেতৃত্বে এএসপি মোহাম্মদ খোরশেদ আলম সহ একটি বিশেষ আভিযানিক দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করে কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ১ নং গেইট এর বিপরীত পাশে এস এস স্ট্যাম্প ভেন্ডার এর দোকান থেকে দুই হাজার দুইশত আঠারটি জাল স্ট্যাম্পসহ স্ট্যাম্প ভেন্ডার মালিক সুশীতল দেব ওরপে সোনাই (৫৪) ও তার ছেলে সুজন দেব (২২)-কে গ্রেফতার করে।
তাদের বাড়ি কমলগঞ্জ পৌরসভার গোপালনগর এলাকায়। উদ্ধারকৃত জাল স্ট্যাম্পের মূল্য ৭৫ হাজার টাকা। গ্রেফতারকৃত আসামী ও উদ্ধারকৃত আলামত বুধবার সন্ধ্যায় কমলগঞ্জ থানায় হস্তান্তর করা হয়। এ ব্যাপারে কমলগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল বলে র্যাব সূত্রে জানা যায়।
এদিকে বিভিন্ন ধরনের জাল স্ট্যাম্প তৈরি করে সারা দেশের ভেন্ডারদের কাছে সরবরাহ করছে এমন একটি চক্রের মূলহোতা বুলবুল ইসলামকে ২০১৫ সালের জুন মাসের ২২ তারিখ রাজধানীর দারুস সালাম এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি পুলিশ।বুলবুল ও তার ভাই সৌরভের বাসায় অভিযান চালিয়ে পৌনে ১৮ কোটি টাকার জাল স্ট্যাম্পও উদ্ধার করে সিআইডি। উদ্ধার স্ট্যাম্পের মধ্যে রয়েছে, জুডিশিয়াল, নন-জুডিশিয়াল ও রেভিনিউ স্ট্যাম্প।গ্রেপ্তারের পর বুলবুলকে চার দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছে সিআইডি।
বুলবুল সিআইডিকে জানিয়েছে, জাল স্ট্যাম্প বিক্রির ব্যবসাটি তাদের পারিবারিক ব্যবসা। তার বাবাও দীর্ঘদিন জাল স্ট্যাম্পের ব্যবসা করেছেন। এখন এই ব্যবসার হাল ধরেছেন তিনি ও তার ভাই সৌরভ। সৌরভ পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেপ্তার করা গেলে এ বিষয়ে আরো অনেক তথ্য পাওয়া যাবে।
ঢাকার বিভিন্ন প্রেসের সঙ্গে তাদের চুক্তি রয়েছে বলেও বুলবুল সিআইডিকে জানিয়েছে। চুক্তি অনুসারে গোপনে তাদের জাল স্ট্যাম্প তৈরি করে তাদের সরবরাহ করে। এরপর তারাই সারা দেশের লাইসেন্সপ্রাপ্ত অসাধু ভেন্ডারদের কাছে সরবরাহ করে থাকে।
সিআইডির জিজ্ঞাসাবাদে বুলবুল আরামবাগের আজিজ প্রিন্টার্স (৮ নম্বর আরামবাগ) নামে একটি প্রেস থেকে জাল স্ট্যাম্প তৈরি করেছে বলেও জানিয়েছে। যেসব প্রেস থেকে জাল স্ট্যাম্প তৈরি করা হয়, সেসব প্রেসের অনেক কর্মচারীও জানে না যে প্রেসে জাল স্ট্যাম্প তৈরি হয়। কারণ জাল স্ট্যাম্প তৈরি করা এবং সরবরাহ করা হয় অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে।
জাল স্ট্যাম্প তৈরি এবং সরবরাহ করছে এসব চক্রকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে জানিয়ে সিআইডির সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মো. রুহুল আমিন বলেছিলেন, ‘সারাদেশেই জাল স্ট্যাম্প বিক্রির চক্র সক্রিয় রয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন প্রেসে জাল স্ট্যাম্প তৈরি করার পর সারা দেশে অসাধু ভেন্ডারদের কাছে তা পৌঁছে যায়।
তিনি বলেন,জাল স্ট্যাম্প চেনার তেমন কোনো সহজ উপায় নেই জানিয়ে তিনি বলেন, সাধারণভাবে বোঝা খুবই মুশকিল কোনটা আসল আর কোনটা নকল স্ট্যাম্প। তবে সিআইডিতে জাল স্ট্যাম্প, জাল দলিল, হাতের লেখা পরীক্ষা করা হয়।’
এদিকে, ২০১৭ সালে ২৫ এপ্রিল এ রকমই একটি চক্রকে কোটি টাকা মূল্যের জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্পসহ গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। কারওয়ান বাজারের সিটি কর্পোরেশন মার্কেট ও রমনা রেলক্রসিং এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের কাছ থেকে ৫ টাকা, ১০ টাকা, ৫০ টাকা, ১০০ টাকা, ২০০ টাকা ও ৫০০ টাকা মূল্যমানের মোট ৩৫ হাজার ১৬২টি জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প উদ্ধার করা হয়। যার বাজার মূল্য ১ কোটি ২০ লাখ ৭৭ হাজার ১৫০ টাকা। তারা জাল দশ টাকার রেভিনিউ স্ট্যাম্প বিক্রি করে ২ টাকায়।
পুলিশ জানায়, গ্রেফতাররা পেশাদার জাল স্ট্যাম্প ব্যবসায়ী। তারা নিজেরা জাল স্ট্যাম্প তৈরি করে। এছাড়া অন্য জাল স্ট্যাম্প প্রস্তুতকারীদের কাছে পাইকারি মূল্যে জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প সংগ্রহ করে খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে।
এর আগে এই চক্রের এক দম্পতি মো. ফারুক হাওলাদার (৪৫) ও তার স্ত্রী মাসুমা বেগমকে (৩৫) স্ট্যাম্প তৈরির সরঞ্জামসহ গাজীপুর থেকে গ্রেফতার করে সিআইডি। তাদের কাছ থেকে প্রায় ২ কোটি টাকার জাল রেভিনিউ স্ট্যাম্প উদ্ধার করা হয়।
জাল স্ট্যাম্পের ভিত্তিতে যদি কোন দলিল হয়ে থাকে তাহলে, দন্ড বিধি, স্ট্যাম্প আইন, রেজিস্ট্রেশন আইন, সম্পত্তি হস্তান্তর আইনের বিধি-বিধান অনুসারে আইনগত প্রদক্ষেপ নেয়া যেতে পরে বলে আইন বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন।