- সাইফুল ইসলাম,
মৌলভীবাজার জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অধিকাংশ মানুষ এখন নি:স্ব। তারপরও নতুন আতঙ্ক ফের বন্যার। কারণ ক্ষতিগ্রস্ত সবকটি বাঁধ এখনো মেরামত করা হয়নি। তাই অনেকেই এখনো বাড়ি না ফিরে নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের ওপরই আশ্রয় নিয়েছেন। - মৌলভীবাজার জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড মনু,ধলাই ও কুশিয়ারা নদীর ৩৮টি বাঁধ ভাঙ্গনের স্থান চিহ্নিত করেছেন। তাদের তথ্যমতে ৪ হাজার ৪২৬ মিটার নদীর মূল বাঁধ বন্যার তোড়ে ভেঙ্গে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আর ক্ষতিগ্রস্থ কিংবা অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ নিরুপনে জরিপকাজ এখনো চলছে।
মনু ও ধলাই নদীর তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা বলছেন দীর্ঘদিন নাব্যহ্রাস হওয়া নদী খনন ও প্রতিরক্ষা বাঁধ মেরামত কিংবা নতুন ভাবে না হওয়ায় এই সংকট তীব্র হচ্ছে। আর একারনে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বন্যা আতঙ্কে থাকতে হয় উদ্বেগ উৎকন্ঠায়। তাদের সাথে অনেকটা একমত পোষন করে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারাও বলছেন বন্যার হাত থেকে রক্ষা পেতে নদী খনন ও পরিকল্পিত স্থায়ী বাঁধের প্রয়োজন।
গত ২৯ জুন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত নদী তীরবর্তী এলাকা পরিদর্শনে আসেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডিজি মো. মাহফুজুর রহমান ও প্রধান প্রকৌশলী (উত্তর পূর্ব অঞ্চল) মো. জুলফিকার আলী হাওলাদার তারা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের সাথে কথা বলেন এবং এই সমস্যা স্থায়ীভাবে লাগবে নানা পদক্ষেপ ও পরিকল্পনার কথা বলে স্থানীয় দূর্ভোগ গ্রস্তদের আশ্বস্ত করেন।
গত বছর চৈত্র মাসের অকাল বন্যা ও দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতায় চরম ক্ষতিগ্রস্ত হন জেলার হাকালুকি,কাউয়াদিঘি ও হাইল হাওরের তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা। এবছরও একই অবস্থা এজেলার মনু,ধলাই ও কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী এলাকায়। হঠাৎ উজানের ঢল ও ভারী বর্ষণে নদীগুলোর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে জেলার কুলাউড়া,কমলগঞ্জ,রাজনগর ও মৌলভীবাজারের ২টি পৌরসভা ও প্রায় ৪০টি ইউনিয়নের ৪ লক্ষাধিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন।
আকস্মিক বন্যায় ঘরবাড়ি,ক্ষেতকৃষি,মৎস্য খামার সবই হারিয়ে নি:স্ব হন নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা। বন্যার পানির তোড়ে প্রাণ হারান ১০ জন। বন্যার পানিতে তলিয়ে গিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ১ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার পরিসংখ্যান দিচ্ছেন স্থানীয় ক্ষতিগ্রস্থরা। তবে জেলা প্রশাসন এখন ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নিরুপনে কাজ করছেন। জেলার বন্যাকবলিত এলাকা থেকে নেমে গেছে পানি। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষ বাড়ি ফিরছেন।
বন্যায় নি:স্ব হওয়া মানুষ নানা অভাব অনটন আর টানপোড়নের মধ্যেও বন্যার পানির তোড়ে নিশ্চিহ্ন হওয়া ঘরবাড়ি তৈরী ও মেরামতের কাজ চালাচ্ছেন। এখনো উজান থেকে আসা ঢলের পানি ও বৃষ্টির পানি নদীগুলোর ভাঙ্গা অংশ দিয়ে প্রবেশ করছে তীরবর্তী গ্রাম গুলোতে। ভাঙ্গা বাঁধ এখনো মেরামত না হওয়ায় ফের বন্যার আশঙ্কায় আতঙ্কিত নদী তীরবর্তী এলাকার কয়েক লক্ষ মানুষ।
মনুনদীর তীরবর্তী কুলাউড়ার শরীফপুর এলাকার একাধিক গ্রামের বাসিন্দারা নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের উপর এখনো আশ্রয় নিয়েছেন। এর কারন হিসেবে তারা জানালেন নদীর ভাঙ্গা বাঁধ ও ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ এখনো মেরামত না করায় তারা বাড়ি ফিরতে ভয় পাচ্ছেন। এই ভাঙ্গা বাঁধ দিয়ে পানি প্রবেশ করে ফের বন্যার আশঙ্কা তাদের। একই অবস্থা ধলাই,মনু ও কুশিয়ারা তীরবর্তী অনান্য এলাকার বাসিন্দাদের। তারা জানালেন বাঁধ মেরামত না হওয়ায় বন্যা নিয়ে এখনো তাদের উদ্বেগ উৎকন্ঠার শেষ নেই। আকাশে মেঘের আভা দেখলেই বন্যা আতঙ্কে তাদের রাত দিন একাকার।
মৌলভীবাজারে মনু, ধলাই ও কুশিয়ারা নদীর বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধের ৩৮টি স্থান ভাঙলেও জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড এই পর্যন্ত ১৮ টি ভাঙ্গন স্থানে বাঁধ শুরু করেছে। আর অবশিষ্ট ২০টি বাঁধ মেরামতের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হলেও এখনো কাজ শুরু হয়নি। তবে খুব শিগগিরই কাজ শুরু হবে বলে তারা আশ্বাস দিচ্ছেন। তবে কোন রকম জোড়াতালি দিয়ে ভাঙ্গা স্থান মেরামতে সন্তুষ্ট নয় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জেলার বাসিন্দারা।
কুলাউড়া শরীফপুর ইউনিয়নের নজরুল ইসলাম,তাজুল ইসলাম,কামরুল ও সুমন মিয়া তারা জোরালো দাবী করে বলেন, ‘প্রতিবছর বন্যায় হাজার কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে ভাঙ্গা অংশসহ ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ পরিকল্পনা মাফিক স্থায়ীভাবে নির্মাণ ও মেরামতের।’
গত ১২ জুন গভীর রাত থেকে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, রাজনগর ও মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মনু, ধলাই ও কুশিয়ারা নদীর ৩৮টি স্থান ক্রমান্বয়ে পানির তোড়ে ভেঙে যায়। বানের পানি প্রবেশ করে ভেসে যায় কমলগঞ্জ ও মৌলভীবাজার পৌর শহরসহ প্রায় ৪০টি ইউনিয়নের ৫ শতাধিক গ্রাম।
পানিবন্দি মানুষ প্রাণ বাঁচাতে ৬৭টি আশ্রয়কেন্দ্র,নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ও অনান্য উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়। সরকারী তরফে ত্রাণ সহায়তা দিলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে দাবী ক্ষতিগ্রস্তদের। তবে দেশ ও প্রবাসের বিভিন্ন সংগঠনের তরফে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, মনু,ধলাই ও কুশিয়ারা নদীর ভেঙ্গে যাওয়া ৩৮টি স্থানে বাধঁ মেরামতের কাজ চলছে। স্থান গুলো হল কুলাউড়ার শরীফপুরের চাঁনপুর, তেলিবিল-১, তেলিবিল-২, তেলিবিল-৩, চাতলাপুর ব্রীজ, ইটারঘাট, রনচাপ-১, রনচাপ-২, পৃথিমপাশার কলিরকোনা, ডেমরারবাঁধ, বেলেরতল, টিলাগাঁওয়ের আশ্রয়গ্রাম,দুন্ধালপুর,সন্দ্রাবাজ,ডেফারবেড়ি,বলিয়ারা,হাজীপুর,মিয়ারপাড়া,হাজিপুরের বাড়ইগাঁও-১, বাড়ইগাঁও-২, রাজনগরের কামারচাকের ভোলানগর, ফতেহপুরের রশিদপুর ও আব্দুল্লাহপুর, মনসুরনগরের প্রেমনগর, মালিকোনা, কদমহাটা, আশ্রয়কাপন, শ্বাসমহল, টেংরার কোনাগাঁও, হরিপাশা, উজিরপুর মৌলভীবাজার সদরের শহর এলাকার বারইকোনা (বড়হাট) কমলগঞ্জের পৌরসভার বাদে করিমপুর, মুন্সিবাজারের করিমপুর, রহিমপুরের লক্ষীপুর, আদমপুরের ঘোড়ামারা,কেওয়ালিঘাট, মাধপুরের পাত্রখোলা, ইসলামপুরের মোকাবিল, পৌরসভার পানিশাইল ও রাজনগরের উত্তরভাগের হলদিগুল (কালাইগুল) এলাকায় বাঁধ মেরামতের কাজ করা হচ্ছে ও হবে। এতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে চার কোটি টাকা।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী রণেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেন, বাঁধ মেরামত করা চলছে। প্রায় ১৮ টি বাঁধের কাজ কয়েকদিনের মধ্যে শেষ হবে। আর বাকী ২০ টি স্থান বাঁধের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। অল্পদিনের ভিতরে সে কাজ করারও জোর প্রচেষ্ঠা চলছে। আর ঝুঁকিতে থাকা বাঁধগুলোর জরিপ কাজ চলছে শেষ হলে বলা যাবে কতটুকু জায়গায় মেরামতের কাজ প্রয়োজন। তবে তার পরামর্শ বন্যার হাত থেকে জেলার শহর ও গ্রাম রক্ষায় স্থায়ী ও পরিক্ষল্পিত নদী খনন ও বাঁধ মেরামতের মাধ্যমে নদী শাসনের প্রয়োজন।
মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র মো. ফজলুর রহমান বলেন দীর্ঘদিন থেকে নদী খনন ও বাঁধ মেরামত না করায় জেলার গ্রাম ও শহর নদীগর্ভে বিলিন হওয়ার চরম ঝুঁকিতে রয়েছে।
মৌলভীবাজার মনু ও ধলাই বাঁধ নিয়ে আতঙ্কে বানভাসী মানুষের
শেয়ার করুন