সুমনকুমার দাশ
গাজীপুর, খুলনাসহ সব সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারের উন্নয়নকে সামনে এনেছে আওয়ামী লীগ। বলছে, উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে হলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে জয়ী করতে হবে। কিন্তু সিলেটের বেলায় তা ব্যতিক্রম। এখানে সরকারি দলের মুখে উন্নয়নের কথা কম উচ্চারিত হচ্ছে। কারণ, তা বলতে গেলে সুবিধা যাবে বিএনপি প্রার্থীর অনুকূলে।
স্থানীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নাগরিক সমাজের ব্যক্তিরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সিলেটের উন্নয়নের চেয়ে জাতীয় উন্নয়নের প্রচারের দিকে বেশি মনোযোগী। এর কারণ হতে পারে, সিলেটের উন্নয়নের কথা বলতে গেলে বিএনপির মেয়র পদপ্রার্থী আরিফুল হক চৌধুরী এগিয়ে থাকেন। তাই সরকারি দলের নেতারা প্রচারণায় বলছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হচ্ছেন উন্নয়নের প্রতীক। তিনি ক্ষমতায় থাকলেই দেশের উন্নয়ন হয়। সিলেটসহ দেশের উন্নয়ন চাইলে নৌকার প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে হবে।
শহরের বিভিন্ন এলাকার অন্তত ১০ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩০ জুলাই অনুষ্ঠেয় সিটি নির্বাচনে ভোটারদের কাছে মূল বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে নগরীর কিছু দৃশ্যমান উন্নয়ন।
এ প্রসঙ্গে নগরীর অন্যতম জলাবদ্ধপ্রবণ এলাকা ঝালোপাড়ার বাসিন্দা সাব্বির আহমদ ২০১৩ সালের এই সময়ে সিটি নির্বাচনের কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, মনে পড়ে তখন শহরের অনেক এলাকায় হাঁটু ও কোমরসমান পানি মাড়িয়ে প্রার্থীদের ভোট চাইতে বাড়ি বাড়ি যেতে হয়েছিল।
সিলেট সিটি করপোরেশনের গত নির্বাচন হয়েছিল ২০১৩ সালের ১৫ জুন। সে সময় ভারী বর্ষণে নগরীর ঝালোপাড়া, বারুতখানা, সোনারপাড়া, শিবগঞ্জ, রায়নগর, সেনপাড়াসহ অনেক এলাকায় পানি উঠেছিল। এ জন্য তৎকালীন মেয়র ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে বেশ সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। এখন সে অবস্থা নেই।
সিলেট আবহাওয়া দপ্তরের রেকর্ড অনুযায়ী, ২০১৩ সালের জুনে সিলেটে ৭২৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল। একই সময়ে অর্থাৎ এ বছরের জুনে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৭৯২ মিলিমিটার। আর গত বছরের জুনে বৃষ্টিপাত হয় ১ হাজার ১৫ মিলিমিটার। অর্থাৎ ২০১৩ সালের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতেও শহরে সে রকম জলাবদ্ধতা হয়নি।
সোনারপাড়ার গৃহিণী নাইমা আক্তার বলেন, ‘আমাদের গোয়ালি ছড়াটি খনন করে দেয়াল করে দেওয়ায় এখন আর জলাবদ্ধতা হয় না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর জলাবদ্ধতা দূর করতে ১৯৫৬ সালের জরিপের মানচিত্র ধরে গত কয়েক বছরে সিলেট সিটি করপোরেশনে ছোট-বড় ১৯টি ছড়া ও খাল উদ্ধার এবং খননের কাজ করা হয়। এটি করতে গিয়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন অন্তত ৬৩টি অবৈধ স্থাপনা ভাঙতে হয়েছে। এই কঠিন কাজটি করতে ২৭৬ কোটি টাকার বিপুল ব্যয়ের পাশাপাশি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে।
আরিফুল হক ২০১৩ সালের ১৫ জুন মেয়র নির্বাচিত হন। কিন্তু দায়িত্ব পান তিন মাস পর সেপ্টেম্বরে। এরপর একাধিক মামলায় তিনি ২৭ মাস কারাবন্দী ছিলেন। মুক্তি পেয়েও তিন মাস চেয়ারে বসার সুযোগ পাননি মামলার জটিলতা ও বরখাস্ত হওয়ার কারণে। পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত মেয়র আরিফ চেয়ারে ছিলেন ২৭ মাস।
নাগরিকদের অধিকার আদায়ের জন্য গঠিত সামাজিক সংগঠন নাগরিক জোট সিলেটের সভাপতি হুমায়ূন চৌধুরী বলেন, সিলেট শহরকে একটা ঘিঞ্জি ও অপরিকল্পিত মনে করা হতো। এখন সেই তকমা অনেকটাই ঘুচেছে।
এ বিষয়ে আরিফুল হক বলেন, ‘শুধু মেয়র হয়ে চেয়ারে বসে থাকলে তো হবে না। কাজ জানতে হবে, প্রকল্প তৈরি করে ঠিক জায়গায় পাঠাতে হবে, লেগে থাকতে হবে।’
তবে এসব উন্নয়নকে সরকারের কৃতিত্ব মনে করেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী বদরউদ্দিন কামরান। ‘এটা আরিফুল হকের কোনো কৃতিত্ব না। আমরা সুযোগ সৃষ্টি করে না দিলে তিনি উন্নয়ন করতে পারতেন না। তা ছাড়া সিলেটের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী নিজে দায়িত্ব নিয়েছিলেন।’
আরিফুল হক অবশ্য সরকারের সহযোগিতার কথা অস্বীকার করেন না। তিনি বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী (আবুল মাল আবদুল মুহিত) সহযোগিতা করেছেন। কিন্তু কামরান সাহেব তো সরকারে থেকেও করতে পারলেন না।’
স্থানীয় একাধিক অধিবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শহরের উন্নয়ন এবারের নির্বাচনে ভোটারদের মনোযোগে পড়েছে। এই কৃতিত্ব সরকারের, নাকি মেয়রের তা নিয়েও আছে নানা আলোচনা।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, জলাবদ্ধতা দূর করা, খাল খনন, রাস্তা প্রশস্ত করা, শহর পরিচ্ছন্ন রাখা-এমন অনেক কাজই আরিফুল হক করেছেন। দলকানা নয়, এমন ভোটারদের মধ্যে এগুলোর আলাপও আছে। এদের সংখ্যা মোট ভোটের প্রায় ২৫ শতাংশ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁরা ভোট দিতে যাবেন কি না।
উন্নয়নের প্রচারে ব্যতিক্রম সিলেট
শেয়ার করুন