৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট হাসনাত করিমের নাম নেই যে কারণে হলি আর্টিজানকে বেছে নেয় জঙ্গিরা

 

স্টাফ রিপোর্টার

আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য হলি আর্টিজানে হামলার পরিকল্পনা করেছিল জঙ্গিরা। ছয় মাস আগেই হামলার পরিকল্পনা নিয়ে রেকি করছিল তারা। বিদেশি অতিথিদের নিয়মিত যাতায়াত থাকায় শেষ মুহূর্তে হামলার জন্য তারা হলি আর্টিজানকে বেছে নেয়। দুনিয়া কাঁপানো হলি আর্টিজান হামলার ঘটনায় গতকাল আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ। চার্জশিটে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

বর্বর জঙ্গি হামলার দুই বছর পর দেয়া চার্জশিটে ২১ জনকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

তাদের মধ্যে ১৩ জন পুলিশের বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছে। ঘটনার দিন অভিযানে পাঁচ জন জঙ্গি নিহত হয়। ঘটনায় জড়িত আট জন জীবিত রয়েছে। এরমধ্যে ছয় জন কারাগারে বন্দি। দুই জন পলাতক রয়েছে। হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম আহমেদ চৌধুরীকে। তামিম আগেই পুলিশের অভিযানে নিহত হয়েছেন। দেশকে অস্থিতিশীল করা, সরকারকে বেকায়দায় ফেলা ও দেশে বিনিয়োগ বন্ধ করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এই হামলা চালানো হয়েছিল বলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। হামলাকারীরা ঘটনার ছয় মাস আগে থেকে গুলশানের বিভিন্নস্থান রেকি করেছিল। পরে তারা হলি আর্টিজানকে বেছে নেয়। তবে, ওই হামলার পেছনে কাদের মদত ছিল তা জানা যায়নি।

হামলায় বিদেশি কোনো জঙ্গি গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে জঙ্গি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে কথিত ইসলামিক স্টেটের ওয়েবসাইটে কিভাবে এ হামলার ছবি প্রকাশ হয়েছে। মামলার আলোচিত গ্রেপ্তার হওয়া নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসনাত করিমকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। নৃশংস হামলায় তার কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। গতকাল দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলনে চার্জশিটের বিষয়ে গণমাধ্যমকে অবহিত করেন। সংবাদ সম্মেলনের পর গতকাল বিকালেই ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে এই অভিযাগে পত্র দেয়া হয়।

২০১৬ সালের ১লা জুলাই রাত ৯টা ২০ মিনিটে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজানে জঙ্গিরা হামলা চালায়। এ ঘটনায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ মোট ২৮ জন নিহত হন। ২৮ জনের মধ্যে মোট ২০ জন জিম্মিকে জঙ্গিরা নৃশংসভাবে হত্যা করে। জিম্মি ২০ জনের মধ্যে ১৭ জনই বিদেশি। এরপর সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডোর অপারেশনে পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়। অভিযানে রেস্তোরাঁর এক কর্মচারীও নিহত হন।

সংবাদ সম্মেলনে মনিরুল ইসলাম জানান, হলি আর্টিজানে যারা এই হামলা চালিয়েছিল তারা পাঁচ থেকে ছয় মাস ধরে পরিকল্পনা করেছিল। সেখানে হামলা চালানো জঙ্গিদের উদ্দেশ্য ছিল  আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করা। বিশ্বের বড় বড় জঙ্গি সংগঠনের অনেক অস্ত্রশস্ত্র আছে। তাই তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এসব অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা পাওয়া যাবে এমন ধারণা ছিল জঙ্গিদের।

তিনি আরো বলেন, জঙ্গিরা আরো কয়েকটি স্থান রেকি করেছিল। কিন্তু  হলি আর্টিজানের নিজস্ব তেমন কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকার কারণে সেটিকেই বেছে নেয়া হয়। হলি আর্টিজানের ঘটনার আগে জঙ্গিরা আরো কয়েকটি স্থানে রেকি করেছিল। কিন্তু, তাদের বিচারে বেরিয়ে এসেছে, তারা হোলি আর্টিজানেই চালাবে। তিনটি কারণে তারা সেখানে হামলা চালিয়েছিল। এখানে নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা তেমনটি ছিল না। পালানো সুবিধাজনক হবে এবং সেই রেস্তেরাঁয় অনেকগুলো বিদেশিকে একসঙ্গে পাওয়া যাবে। ঘটনার দুই থেকে তিনদিন আগে এইস্থানটিকে তারা টার্গেট করে।

তিনি আরো বলেন, এই নারকীয় হামলায় নিহত পাঁচ জঙ্গির মধ্যে নেতৃত্ব দিয়েছিল রোহান ইমতিয়াজ ও খায়রুল ইসলাম পায়েল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশকে অস্থিতিশীল করা। বাংলাদেশকে জঙ্গি রাষ্ট্র বানানো। সরকারকে কোণঠাসা করে দেশের অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করা। সরকার যাতে চাপে পড়ে। বিনিয়োগকারীরা যাতে দেশ ছেড়ে চলে যায়। জনমনে যেন আতঙ্ক তৈরি হয়। জঙ্গিরা এও মনে করেছিল, যারা হামলায় অংশ নেবে তারা সেখান থেকে পালাবে। আসল জঙ্গিদের না ধরতে পেরে নিরীহ মানুষকে নির্যাতন নিপীড়ন করা হবে। এতে মানুষ যাতে অতিষ্ঠ হয়ে পড়বে সরকারের ওপর। সরকার বেকায়দায় পড়বে।

মনিরুল ইসলাম আরো বলেন, জঙ্গিরা শহুরে ব্যাকগ্রাউন্ডের চার জন যুবককে বাছাই করে। একজনকে শোলাকিয়াতে কাজে লাগায়, বাকি তিন জন রোহান ইমতিয়াজ, মোবাশ্বির ও নিবরাস ইসলামকে হলি আর্টিজানে কাজে লাগায়। তাদের যেহেতু পূর্ব অভিজ্ঞতা কম, তাই গাইবান্ধায় কথিত প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করে প্রশিক্ষণ দেয় এবং বাস্তব অভিজ্ঞতার জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক অপারেশনে প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে পাঠায়। পাশাপাশি গ্রাম থেকে আসা উজ্জ্বল ও পায়েলকে এই তিন জনের সঙ্গে দেয়া হয়েছিল। তিনি আরো বলেন, এ হামলায় বিদেশি ১৭ জন, তিন জন বাংলাদেশি নাগরিক এবং দুই জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। তাদের আমরা রক্ষা করতে পারিনি, এটি আমাদের ব্যর্থতা। তবে, আমরা চেয়েছি নিহত ব্যক্তিদের হত্যাকারী অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করতে।
হামলার ঘটনায় ১৭ জন সার্ভাইভার যারা ভেতরে ছিলেন, তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করিয়েছি, ৭৫টি আলামত আদালতে পাঠিয়েছি।

নিহত ব্যক্তিদের সঙ্গে থাকা বিভিন্ন জিনিসপত্র স্বজনদের কাছে ফেরত দিয়েছি। এ মামলার সব মিলে মোট সাক্ষীর সংখ্যা ২১১ জন। এদের মধ্যে ১৪৯ জন ঘটনা সম্পর্কে জানে কিংবা ঘটনা দেখেছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জানে।  তিনি আরো বলেন, এই ঘটনায় ২১ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এই ২১ জনের মধ্যে ১৩ জন বিভিন্ন সময়ে নিহত হয়েছে আর জীবিত আছে আট জন। এর মধ্যে ছয় জন কারাগারে ও দুই জন পলাতক রয়েছেন। ঘটনার দিন পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়েছে।

তারা হলো-  রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, মীর সামেহ মোবাশ্বের, নিবরাস ইসলাম, শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল। এ ছাড়াও পুলিশের বিভিন্ন অভিযানে নিহত আট আসামি হলো- তামিম আহমেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, তানভীর কাদেরী, মেজর (অব.) জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ, রায়হান কবির তারেক, সারোয়ান জাহান মানিক, বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট ও মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান। জীবিত অভিযুক্ত আট জনের মধ্যে কারাগারে রয়েছেন- রাজীব গান্ধী, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, হাতকাটা সোহেল মাহফুজ, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান সাগর, রাশেদ ইসলাম ওরফে আবু জাররা ওরফে র‌্যাশ। পলাতক রয়েছে দুই আসামি। তারা হলো- শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ ও মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন।

মামলায় আগে গ্রেপ্তারকৃত হাসনাত করিম ও শাওনের অভিযোগপত্রে নাম নেই কেন প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান,  মামলার এজাহারের কলামে কোনো আসামির নাম ছিল না। বডিতে নাম ছিল। যাদের জীবিত উদ্ধার করেছি, এমন ১৭ জনের জবানবন্দি আদালতে দেয়া হয়েছে, পাশাপাশি যে আসামি জীবিত উদ্ধার হয়েছে, তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং আলামত যাচাই-বাছাই করে যাদের সম্পৃক্ততার নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে, তাদের নাম চার্জশিটে দেয়া হয়েছে।

ওই হামলা নিয়ে হাসনাত করিম পুলিশকে কী বলেছেন প্রশ্ন করা হলে মনিরুল ইসলাম বলেন, যারা জীবিত উদ্ধার হয়েছে, তাদের দেয়া তথ্যের পাশাপাশি আমরা আরো জানতে পেরেছি, নব্য জেএমবির একটি সাংগঠনিক পরিকল্পনা নিয়ে এ হামলা করা হয়েছে। তাদের এই পরিকল্পনার কোথাও আমরা হাসনাত করিমের সম্পৃক্ততা পাইনি। এ ছাড়া যারা জীবিত গ্রেপ্তার হয়েছে, তাদের কোনো কথায়ও হাসনাত করিমের নাম আসেনি। সুতরাং হাসনাত করিমের দেয়া ব্যাখ্যার চেয়েও অন্য যারা প্রত্যক্ষদর্শী ছিল, তাদের জবানবন্দির ওপর আমরা ডিপেন্ড করেছি এবং চার্জশিটে আদালতকে ব্যাখ্যা করেছি। জঙ্গি হামলার হাসনাত করিমের ছবিগুলো আমরা ব্যাখ্যা করেছি।

গুলশানের হামলায় আন্তর্জাতিক কোনো গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে কী-না প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, নব্য জেএমবির কোনো শীর্ষ নেতাকে আমরা জীবিত ধরতে পারেনি। অন্য যাদেরকে ধরা হয়েছে তাদের কাছে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের কোনো যোগসূত্র পাইনি। তামিম ছিল এ ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী। আন্তর্জাতিকভাবে কারও সঙ্গে তারই যোগাযোগ থাকার কথা ছিল। তামিমকে ধরার সময় তার ইলেকট্রনিক ডিভাইসগুলো অভিযানের আগেই ধ্বংস করে পুড়িয়ে দিয়েছে। তাই বিদেশি কোনো সংগঠন, আইএস কিংবা আল-কায়েদা, হিযবুত তাহ্‌?রীর কিংবা অন্য কোনো সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য আমরা পাইনি।

এদিকে, গতকাল বিকালে পৌনে ৪টার দিকে গুলশান থানার আদালতের জিআর শাখায় এই চার্জশিটটি দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের ওসি হুমায়ুন কবীর।

শেয়ার করুন