সোনার ভরি তিন হাজার টাকা!

  • গোলাম মওলা
  • তিনি  বলেন, ‘নিলাম ডাকা হলে ব্যবসায়ীরা ৪০ হাজার টাকার সোনার দাম বলে তিন হাজার টাকারও কম। এ কারণে গত ১০ বছর ধরে সোনার নিলাম হয়নি।’ তিনি উল্লেখ করেন, ২০০৮ সালের নিলামের সময় স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা জানিয়েছিলেন, ‘দেশে নাকি সোনার চাহিদা নেই।’ তবে সোনা ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সভাপতি গঙ্গাচরণ মালাকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক এখন আমাদের কাছে আন্তর্জাতিক বাজার দরে সোনা বিক্রি করুক, আমরা সব সোনা নিয়ে নেবো।’ তিনি বলেন, ‘তখনকার পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, এখন আমরা কম দাম দেবো না। আন্তর্জাতিক বাজারে যে দাম আছে, তা-ই দেবো।’

    অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, দুই কারণে সোনার নিলাম হচ্ছে না। প্রথমত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে জমা রাখা বেশিরভাগ সোনার বিষয়ে মামলা এখনও বিচারাধীন। দ্বিতীয়ত, নিলাম ডাকা হলে সোনা ব্যবসায়ীরা দাম হাঁকেন খুবই কম।

    এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক (কারেন্সি অফিসার) আওলাদ হোসেন চৌধুরী  বলেন, ‘বেশিরভাগ সোনা সংক্রান্ত মামলাই বিচারাধীন। আর বিচারাধীন থাকার কারণে সোনার নিলাম হচ্ছে না।’

    জানা গেছে, যেসব সোনার বিপরীতে করা মামলার নিষ্পত্তি হয় এবং ভল্টে রাখা সোনা যদি আদালতের মাধ্যমে সরকারের অনুকূলে জব্দ করা হয়, সেসব সোনা শুরু নিলাম করা হয়। তবে যেসব সোনার বার বা ‘বিস্কুট’ আকারে আছে, সেগুলোকে বিশুদ্ধ স্বর্ণ মনে করা হয়। এগুলো সাধারণত বাংলাদেশ ব্যাংক কিনে নেয়। পরে তারা এগুলোকে রিজার্ভে দেখানোর জন্য ভল্টে রেখে দেয়। নিলামের টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে দিয়ে দেয়।

    প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বশেষ সোনার নিলাম ডেকেছিল ২০০৮ সালে। ওই বছর চার দফায় ৯১ কেজি সোনা নিলাম করা হয়। তারপর থেকে এ পর্যন্ত ৯৬৩ কেজির কিছু বেশি পরিমাণ জব্দ করা সোনা আদালতের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের অস্থায়ী খাতে জমা পড়েছে।

    সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর থেকে জব্দ হওয়া সোনার মধ্যে রাষ্ট্রের অনুকূলে আদালত থেকে বাজেয়াপ্ত হওয়া দুই হাজার ৩০০ কেজি সোনা কিনে রিজার্ভে যোগ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বছরে ১৮ কেজি সোনা রিজার্ভে নেওয়ার কথা ছিল। এছাড়া, ১০ কেজি সোনা নিলামে বিক্রির কথা থাকলেও আপাতত তা স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

    ভল্টে জমা থাকা এই সোনা নিয়ে তৈরি শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের এক প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শুল্ক গোয়েন্দারা যে সোনা নিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছেন, তার মধ্যে অস্থায়ী খাতে আছে ৯৩৫ কেজি ৪৫০ গ্রাম, যার বিপরীতে এখনও মামলা চলমান রয়েছে। আর আদালত থেকে নিষ্পত্তির পর সম্প্রতি স্থায়ী খাতে জমা করা হয়েছে ২৮ কেজি সোনা। এরমধ্যে প্রথম শ্রেণির ১৫৫টি বারের ১৮ কেজি সোনা কিনে নিতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ১০ কেজি সোনার অলঙ্কার নিলামের জন্য সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনজন কর্মকর্তাসহ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিসহ মোট পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। তবে ওই সোনার পরিমাপ ও মান নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের এক প্রতিবেদন নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে নিলাম প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

    জানা গেছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত শুল্ক গোয়েন্দারা বিভিন্ন জায়গা থেকে মোট চার হাজার ৬৪৫ কেজি বা ১১৬ মণের বেশি সোনা জব্দ করেছে। এরমধ্যে অধিকাংশই আদালত বাজেয়াপ্ত করেছে। বাজেয়াপ্ত সোনার মধ্যে দুই হাজার ২৯৯ কেজি বা ৫৭ মণ ১৯ কেজি সোনা সমসাময়িক আন্তর্জাতিক দরে কিনে নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর বাইরে ২৪ মণ বা ৯৬৩ কেজি সোনা নিয়ে এখন আদালতে মামলা চলছে। এর বাইরে বিভিন্ন সময়ে নিলামের মাধ্যমে কিছু সোনা বিক্রি হয়েছে। এছাড়া, আদালতের নির্দেশে শুল্ক পরিশোধ সাপেক্ষে কিছু সোনা ফেরত দেওয়া হয়েছে।

    সর্বশেষ নিলামটি হয়েছে ২০০৮ সালের ২৩ জুলাই। সে সময় ২১ কেজি ৮২২ গ্রাম সোনা বিক্রি করা হয়েছিল। একই বছরে আরও তিন ধাপে ২৫, ২৫ ও ২০ কেজি সোনা নিলামে বিক্রি করা হয়।

    বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, ট্যারিফ কমিশন ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে ২০১১ সালে পরিচালিত তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বৈধ উপায়ে কোনও সোনা আমদানি হয় না। এ অবস্থায় দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ কয়েকটি দেশ থেকে একশ্রেণির চোরাকারবারির সহায়তায় সোনা এনে তা এখানকার বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।’

    এদিকে, বাণিজ্যিকভাবে সোনা আমদানির সুযোগ না থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকে পড়ে থাকা সোনা কিনতে চান ব্যবসায়ীরা। এ ধরনের সোনা কেনার জন্য সোনা ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি’ (বাজুস) গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের কাছে একটি চিঠি দিয়েছে। তবে সোনা আমদানির প্রক্রিয়া জটিল হওয়ায় ব্যবসায়ীদের আগ্রহ কম বলে জানিয়েছেন বাজুসের সাধারণ সম্পাদক দিলিপ কুমার আগারওয়াল। তিনি  বলেন, ‘সোনার চাহিদা বাড়লেও আমদানির জটিলতা কারণে ব্যবসায়ীরা সেদিকে যেতে পারেন না।’

    জানা গেছে, দেশের সোনার বাজার মূলত চোরাচালান নির্ভর। চোরাই পথে আসা সোনার একটা অংশ চলে যাচ্ছে জুয়েলারির দোকানগুলোতে। প্রতিবছর চাহিদার প্রায় ৯০ ভাগই চোরাচালানের মাধ্যমে আসা সোনার মাধ্যমে পূরণ হচ্ছে। যদিও দেশে বছরে সোনার চাহিদা রয়েছে ৩০ থেকে ৪০ টন। এই চাহিদার পুরোটাই আমদানির মাধ্যমে পূরণ হওয়ার কথা। কিন্তু তা না হয়ে এর অধিকাংশই আসছে চোরাচালানির মাধ্যমে।

শেয়ার করুন