নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
সৌদি আরব থেকে গত শনিবার রাতে দেশে ফিরে পরিবারের কাছে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এক নারী গৃহকর্মী। এর কারণ, তিনি পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তিনি ধারণা করছেন, পরিবার কিছুতেই তাঁকে গ্রহণ করবে না। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী—সবাই তাঁকে ‘খারাপ মেয়ে’ বলবে।
ওই নারীর সঙ্গেই দেশে ফেরা আরেকজন বাংলা প্রায় ভুলেই গেছেন। তবে আরবিতে যা বলছেন, সেটিও সম্পূর্ণ বাক্য হয় না। বেশির ভাগ সময় অসংলগ্ন কথা বলছেন তিনি। কাছে যাকে পাচ্ছেন, তাকেই জড়িয়ে ধরছেন। মানসিক ভারসাম্য প্রায় হারিয়ে ফেলা এই নারী বলছিলেন, তিনি আবার সৌদি আরব যাবেন এবং ওই দেশের মানুষকে ভালো করবেন। আবার কখনো বলছিলেন, তিনি কোনো অপরাধ করেননি। অন্যরা তাঁর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে। এ রকম অসংগলগ্ন অনেক কথার ফাঁকে বারবার বলছিলেন, তাঁর কোমরে ইনজেকশন দেওয়া হতো। তাঁর সঙ্গে কী করা হতো তা জানতেন না তিনি।
সৌদি আরব থেকে ফেরত আসা আরেক নারী পাবনার রেহানা। তাঁর দুই হাতে অসংখ্য কাটা দাগ দেখালেন। বললেন, তাঁকে খাবার দেওয়া হতো না। মারধর করা হতো। তবে ভাগ্য ভালো, কেউ তাঁর ‘সম্মান’ নষ্ট করেনি।
রোববার দুপুরে রাজধানীর আশকোনায় বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের লার্নিং সেন্টারে গিয়ে সৌদিফেরত ওই তিন নারীর সঙ্গে কথা হয়েছে প্রতিবেদকের। তাঁরা ৩ জনসহ ৪৩ জন নারী শনিবার রাতে সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন। মানসিক ভারসাম্যহীন নারী পরিবারের ঠিকানা বলতে পারছিলেন না। পরে তাঁর বাড়ির ঠিকানা খুঁজে বের করে পরিবারকে খবর দেন ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির কর্মীরা। বিকেলে পরিবারের সদস্যরা তাঁকে বাড়ি নিয়ে যান। অন্তঃসত্ত্বা নারীর পরিবারের কেউ তাঁকে নিতে আসেনি।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, আর্থিকভাবে অসচ্ছল পরিবারের নারীরা ভাগ্য পাল্টানোর জন্য সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ করতে যাচ্ছেন। বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়ে এমনকি কেউ কেউ অন্তঃসত্ত্বা এবং মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন। এই নারীদের পাশে পরিবার, সমাজ, বেসরকারি সংস্থা ও রাষ্ট্রকে সমন্বিতভাবে দাঁড়াতে হবে।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১ মে থেকে চলতি ২১ জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার ৫৫০ নারী সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন। বছরের শুরু থেকে হিসাব করলে প্রায় সাত মাসে ১ হাজার ৪০০ নারী সৌদি আরব থেকে ফিরেছেন। এই নারীদের অনেকের বাড়িতে ফেরার মতো পরিস্থিতি থাকে না। ফেরত আসার খবর পরিবারের সদস্যরাও অনেক সময় জানতেও পারেন না। সরকারের কোনো সংস্থা এখন পর্যন্ত এই নারীদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না।
সৌদিফেরত গৃহকর্মীদের বিষয়ে সরকার চোখ-কান বন্ধ করে বসে নেই বলে জানান প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, বিভিন্ন কারণে নারীরা সৌদি আরব থেকে ফিরে আসছেন। সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে প্রতিনিয়ত বৈঠক হচ্ছে। সরকার বর্তমানে গৃহকর্মীর কাজ করতে যাওয়ার আগেই বাছাইপ্রক্রিয়াটিকে বেশ কঠোর করেছে। এখন কেউ চাইলেই বিদেশ চলে যেতে পারছেন না। আর সৌদি আরব যাওয়ার আগে প্রশিক্ষণের বিষয়টিতেও সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে।
অভিবাসন খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, বিদেশে গিয়ে কোনো নারী নির্যাতনের শিকার হলে তার দায় ওই নারীর নয়। পরিবারের সদস্যরাই ওই নারীকে কাজের জন্য বিদেশ পাঠিয়েছেন। কোনো কারণে ওই নারী দেশে ফেরত আসতে বাধ্য হলে পরিবারে সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি দরকার। আর সৌদি আরবসহ বিদেশে যেসব বাংলাদেশি কাজ করছেন, তাঁরা সংগঠিত হয়ে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তির পাশে দাঁড়ালে নির্যাতনের মাত্রা কিছুটা কমে আসবে। তবে সবার আগে সরকারকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে।