জনপরিবহনব্যবস্থার চূড়ান্ত নৈরাজ্য এবং এ বিষয়ে সরকারের নির্লিপ্ততার ফলে জনগণের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে। কিন্তু জাতি যেন এই দুঃসহ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে পাচ্ছিল না; অবশেষে জাতিকে সেই পথ দেখাতে রাস্তায় নেমে এসেছে স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা। ঢাকা মহানগরের অকার্যকর ট্রাফিক-ব্যবস্থার দায়িত্ব তারা নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। তারা শুধু যানবাহনের নিবন্ধনপত্র ও চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্সই পরীক্ষা করছে না, যান চলাচলও নিয়ন্ত্রণ করছে অত্যন্ত সুচারুভাবে, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে। তারা আপাতত রাস্তায় রাস্তায় ‘জাস্টিস’ বা ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রয়াস চালাচ্ছে। তাদের চূড়ান্ত দাবি নিরাপদ সড়ক। নিরাপদ সড়কের দাবি দীর্ঘদিনের জনদাবিই বটে। তাই তাদের এই আন্দোলনের প্রতি পুরো জাতির সমর্থন রয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস।
কিন্তু দুর্ঘটনামুক্ত নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার জন্য সরকার ও তার নীতিনির্ধারকদের যে আন্তরিক অঙ্গীকার, স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং সেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের তাগিদ থাকা প্রয়োজন, তা নেই। রাজধানীর জনপরিবহনব্যবস্থার নৈরাজ্য এক স্থায়ী ব্যাধির রূপ লাভ করেছে। এটা অল্প সময়ে সৃষ্টি হয়নি; বহু বছরের পরিকল্পনাহীনতা ও অব্যবস্থাপনার পুঞ্জীভূত কুফল আজকের ঢাকার সড়কগুলোর প্রাণঘাতী নৈরাজ্য। যানবাহন চলাচলব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও অঙ্গহানি দৈনন্দিন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এসবের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা প্রায় অকার্যকর। বিচারহীনতার সংস্কৃতি বেপরোয়া যান চালনাকে উৎসাহিত করে।
ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা, ট্রাফিক পুলিশের সদস্যদের বৃহদংশের অনৈতিকতা ও দায়িত্বহীনতার ফলে ঢাকা হয়েছে যানজটের নগরী। যানজটের ফলে মোটরযানের গতি কমতে কমতে হেঁটে চলার গতির প্রায় সমান হয়েছে। এর ফলে প্রতিদিন বিপুল কর্মঘণ্টার অপচয় হচ্ছে, যার অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকা।
ঢাকার জনপরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে রাজনৈতিক প্রভাবসম্পন্ন কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর হাতে, যারা নৈরাজ্যকেই তাদের মুনাফা অর্জনের মূল পন্থায় পরিণত করেছে। এদের প্রভাবের কাছে যানবাহন নিবন্ধনের বিধিবিধান, জনপরিবহন ব্যবসাসংক্রান্ত আইনকানুন অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তাদের কায়েমি স্বার্থের কাছে জনপরিবহন খাতের বিকাশ রুদ্ধ হয়ে আছে। ঢাকা মহানগরের চারপাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলো ব্যবহার করে চক্রাকার জলপথ চালু হলে সড়কগুলোর ওপর বাস, মিনিবাসসহ অন্যান্য যানবাহনের চাপ অনেকটাই হ্রাস পেতে পারে। কিন্তু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর কারণে তা সফল হয়নি। বড় আকারের যানবাহন পৃথিবীর সব সভ্য দেশের বড় শহরগুলোর জনপরিবহনের প্রধান চাপ বহন করে। কিন্তু ঢাকায় স্বল্প যাত্রী ধারণক্ষম ছোট ছোট যানবাহনই সড়কের অধিকাংশ জায়গা দখল করে থাকে। এ শহরে প্রাইভেট কারের দখলে থাকে ৬০ শতাংশের বেশি সড়ক, অথচ মাত্র ৭ শতাংশ যাত্রী বহন হয় প্রাইভেট কারে।
ঢাকা মহানগরের সড়কে চলাচল নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন সরকারের নীতিনির্ধারকদের এই উপলব্ধি যে এ মহানগরে আমরা যেভাবে চলছি, সেভাবে আর চলতে পারে না, চলতে দেওয়া যায় না। স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা যে উপলব্ধি থেকে রাস্তায় নেমে এসেছে, তা হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েও দিয়েছে কী নৈরাজ্যের মধ্য দিয়ে চলছে আমাদের জনপরিবহনব্যবস্থা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর লোকজনসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গাড়ির চালকদের লাইসেন্স নেই। তাঁরা চলছেন ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা না করে।
ঢাকার পরিবহনব্যবস্থার এই নৈরাজ্য অবসানে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। কাজটি সরকারকেই করতে হবে। পরিবহনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করার জন্য কারিগরি অবকাঠামো থেকে শুরু করে ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত সামগ্রিক কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণের জন্য বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে কমিশন গঠন করা উচিত। পৃথিবীতে জনবহুল নগরীর জনপরিবহনব্যবস্থার অনেক উন্নত মডেল আছে, আমাদের বিশেষজ্ঞরা সেসব মডেলের অভিজ্ঞতাও কাজে লাগাতে পারেন।