- তাসনীম হাসান, চট্টগ্রাম
- সারাক্ষণ হইহুল্লোড়ে মেতে থাকাই ছিল তাঁর অভ্যাস। বন্ধুমহলে তাঁর পরিচিতিও চঞ্চল হিসেবে। সেই আকিমুর রহমানকে চেনাই এখন দায়। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় দেখা গেল অন্য রূপে—এলোমেলো চুল, চেহারায় বিষণ্নতার ছাপ। মুখ থেকে হাসি উধাও। ১০ দিন ধরে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে তিনি যেন খুব ক্লান্ত।
এই আকিমুর মর্মান্তিক হত্যার শিকার রাজধানীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইদুর রহমান পায়েলের বন্ধু। ২১ জুলাই হানিফ এন্টারপ্রাইজের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরার পথে তাঁর পাশের আসনেই বসেছিলেন পায়েল। ২৩ জুলাই গজারিয়ার ভাটের চরে নদীতে পায়েলের লাশ পাওয়া যায়। এরপর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে—পায়েল বাথরুমের কথা বলে গাড়ি থেকে নেমেছিলেন। পুনরায় গাড়িতে ওঠার সময় আহত হয়েছিলেন তিনি। পরে রক্তাক্ত পায়েলকে হাসপাতালে পাঠানোর পরিবর্তে মুখ থেঁতলে নদীতে ফেলে দেন বাসের কর্মীরা।
মা লায়লা আরজুমান আর চার বন্ধু মাহফুজুল হাসান, মুনতাসির মাহমুদ, এ বি এম আকাশ ও মাকসুদুল হাসানের হাত ধরে ১ আগস্ট সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের হালিশহরে পায়েলের বাসায় এসেছিলেন আকিমুর রহমান। গত ২৩ মার্চ আচমকা মারা যান আকিমুর রহমানের বাবা আনোয়ারুল ইসলাম। সেই শোক কাটিয়ে উঠতে সব সময় তাঁকে সাহস জোগাতেন পায়েল। বাবাকে হারানোর ধাক্কা সামলে ওঠার চেষ্টার মধ্যেই তাঁর জীবনে এখন নতুন শোক। এবার জীবনের সবচেয়ে কাছের বন্ধুকেই হারানো। পায়েলের কথা তুলতেই আকারে-ইঙ্গিতে বোঝালেন এই সংকটের মুহূর্তে তাঁকে যেন একান্তে শোক প্রকাশের জন্য কিছুটা অবসর দেওয়া হোক। তবে ১০ মিনিট চুপ থাকার পরেই মুখ খুললেন আকিমুর। পায়েলকে নিয়ে স্মৃতির ঝাঁপিটা খোলার শুরুতেই তুলে ধরলেন সেই রাতের কথা।
‘বাবার মৃত্যুর পর থেকে আমি বেশ বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলাম। সেই শোক থেকে শরীরে নানা রোগও বাসা বেঁধেছিল। ওই দিন রাতে কুমিল্লার একটি রেস্তোরাঁর সামনে গাড়ি থামালে আমরা তিন বন্ধুই গাড়ি থেকে নামি। আমরা দুজন ভারী নাশতা খেলেও পায়েল শুধু কফি পান করেছিল। এরপর গাড়ি ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি। হয়তো আমি অসুস্থ ছিলাম বলে আমাকে সে গাড়ি থেকে নামার সময় ডাকেনি। তাঁর সঙ্গে গাড়িতে কাটানো সময়টাই যে ১১ বছরের বন্ধুত্বের শেষ স্মৃতি হয়ে যাবে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি।’ কাঁপা গলায় বলতে থাকেন আকিমুর।
মাহফুজুল ইসলামের সঙ্গে পায়েলের শেষ কথা হয়েছিল। মাহফুজুল বলেন, ‘আমি ফেসবুক মেসেঞ্জারে রাত ২টার কিছুটা পরে ফোন দিয়েছিলাম পায়েলকে। ২টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত কথা হয় তাঁর সঙ্গে। কথা বলার একপর্যায়ে আমি আকিমুরকে ফোন দিতে বলেছিলাম। কিন্তু পায়েল বলেছিল, ‘আকিমুর অসুস্থ, ঘুমাচ্ছে। তার ঘুম ভাঙানো ঠিক হবে না।’
- আকিমুরের সঙ্গে পায়েলের পরিচয় সেই চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই। দুজনের বাসাই হালিশহরে হাঁটা দূরত্বে। এলাকার এম বি গ্রামার স্কুল থেকে একসঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন দুজন। এরপর একসঙ্গে না পড়লেও দেখা হতো প্রায় প্রতিদিনই। আর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিস্টার এগিয়ে থাকলেও পায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্বটা ছিল আগের মতোই। ঢাকায় এক বাসাতেই থাকতেন তাঁরা। তাই তাঁর সঙ্গে হাজারো স্মৃতি আকিমুরের। বলেন, কোনো বন্ধু বিপদে পড়লে তাকে টেনে তোলা, পথে-ঘাটে কোনো অসহায় মানুষ দেখলে তাঁকে সহযোগিতা করা—এসব ক্ষেত্রে সবার আগে ছুটে আসত পায়েল। আর আমার সেই বন্ধুকেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে উল্টো নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। ভাবতেই পারছি না। সেই রাতটা যদি না আসত।
- আকিমুর রহমান বলেন, ‘পায়েলকে যে শেষবারের মতো দেখব, সে অবস্থাও রাখেনি হত্যাকারীরা। হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হলে শান্তি পাব, বন্ধু হারানোর শোক কিছুটা হলেও ভুলতে পারব।’
- আর আর…বলতেই গলা ধরে আসে আকিমুরের। অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘আমার বন্ধুটাকে বড্ড মিস করছি। প্রতিমুহূর্তে, প্রতিক্ষণে।’
- সর্বশেষ: হানিফ পরিবহনের চালক, সুপারভাইজার ও চালকের সহকারীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তিনজনই এখন জেলে আছেন। বাসটির সুপারভাইজার সে দিনের নৃশংসতার কথা আদালতে স্বীকার করেছেন।
বন্ধু, বড্ড মিস করছি তোকে…
শেয়ার করুন