শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি
মৌলভীবাজার জেলার পাইকারি ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল শ্রীমঙ্গল। এখান থেকে জেলাসদরসহ আশপাশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করে থাকেন। শ্রীমঙ্গলের পাইকারি বাজারে প্রতিদিন শত কোটি টাকার পন্য কেনা-বেচা হয়। পর্যটন কেন্দ্রিক শহর হওয়ায় এ উপজেলায় আন্তর্জাতিক মানের হোটেল, কটেজ ও রিসোর্ট গড়ে উঠছে। কিন্তু ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে দিন দিন ব্যাপক পরিচিত লাভ করলেও ব্যবসায়ীদের অবহেলায় নিজস্ব অর্থায়নে পাহারাদার না রাখায় রাতের বেলায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো অরক্ষিত অবস্থায় থাকছে।
রাতের বেলা অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেরই নিরাপত্তা প্রহরী রাখছেন না ব্যবসায়ীরা, অনেক দোকান, মার্কেট বাসা বাড়িতে রাতে নিরাপত্তা আলো পর্যন্ত থাকে না । এ অবস্থায়ই দরজা-জানালা খুলে ঘুমিয়ে থাকেন অনেক বাসিন্দা। এ পরিস্থিতিতে শহরে প্রায়ই ছোট-খাট চুরির ঘটনা ঘটছে। গত ৬ আগস্ট রাতে শহরের গুহ রোডে অবস্থিত গ্রামীণ ফোনের ডিস্টিবিউটর অফিসে গ্রামীণ ফোনের ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার মোবাইল কার্ড চুরি হয়। এর আগে গত ২ আগস্ট দিবাগত রাতে উত্তর-উত্তসুর এলাকায় এক ব্যবসায়ীর বাড়ীতে দুঃসাহসি চুরির ঘটনায় টাকা, ডলার, মোবাইল ফোন ও স্বর্ণসহ প্রায় ৫ লক্ষাধিক টাকার মালামাল খোঁয়া যায়।
আর এর সব দায় এসে পড়ছে থানা পুলিশের উপর। অপ্রতুল জনবল দিয়ে শহরের হাজার হাজার দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ির নিরাপত্তা দিতে হিমশিম খাচ্ছে থানা পুলিশ। পুলিশের পক্ষে বলা হয়েছে, সীমিত জনবল দিয়ে এতোবড় থানার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাসা বাড়ির নিরাপত্তা দেয়া দুরূহ ব্যাপার।
মঙ্গলবার দিবাগত রাত ১২ টা থেকে ভোর রাত ৪টা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন রোডে অবস্থিত মার্কেট বিপণী বিতান, দোকান ও গুরুত্বপূর্ণ আবাসিক এলাকা ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
রাত সাড়ে ১২ টায় অনেক খোজাঁখুজি করেও শহরের গুরুত্বপূর্ণ আবাসিক এলাকা হাউজিং এস্টেট ও এর আশপাশ এলাকায় কোন পাহারাদার দেখা মেলেনি। এই এস্টেটে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার সার্কেল কার্যালয়, কর বিভাগের অফিস, কমিউনিটি সেন্টার, সরকারী স্কুল, উর্দ্ধতন সরকারী কর্মকর্তাসহ লন্ডন-আমেরিকা প্রবাসীদের বাসভবন ও বহুতল ভবন অবস্থিত। সেখানে দেখা গেছে হাউজিং এস্টেটের অনেক বাসার দরজা-জানালা খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছেন বাসিন্দারা। এছাড়া মৌলভীবাজার সড়কের ৫ নং পুল থেকে থানা এলাকা পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন মার্কেট, দোকান, ফিলিং স্টেশন ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেরই কোন নিজস্ব পাহারাদারদের দেখা পাওয়া যায়নি। রাত ১টা ৩০ মিনিটে ৫নং পুল এলাকায় আলআমিন ম্যানশন ও এর আশপাশ এলাকায় ৩০/৩৫টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকলেও এখানে কোন পাহারাদার পাওয়া যায়নি। তেমনি পাওয়া যায়নি জেটি রোড আবাসিক এলাকাতে। এর অপর দিকে গ্রামীণ ব্যাক, মিজান ভিউ মার্কেট, রবি ডিস্টিবিউটর, নাহার ফিলিং ষ্টেশন এলাকায় কোন পাহারাদার ছিল না। থেকে ভাড়াউড়া বাগান সড়কে ২জন পাহারাদার পাওয়া গেলেও তারা জানায়, বেতন স্বল্প হলেও ঠিকমত সেই বেতনই পাওয়া যায় না। একই সড়কে কৃষি ব্যাংক আঞ্চলিক মূখ্য কার্যালয়, নজরুল কমিউনিটি সেন্টার, বেঙ্গল মটর সাইকেল শো’রুম, মদিনা মার্কেট, সপ্তডিঙ্গা সরবরাহ দোকান ও দোকান সংলগ্ন আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কেটে ২০/২৫টি সিএনজি অটো এবং কার মাইক্রোবাসারে পাকিং থাকলেও এই এলাকার কোন ব্যবসায়ী পাহারাদার নিযুক্তের প্রয়োজন মনে হয়নি। ফলে এখানকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কোটি কোটি টাকার সম্পদ অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়।
১নং পুলে এবি ব্যাংক এলাকার আজিজ মার্কেট, খাঁন ম্যানসন, নীলিমা ম্যানসন ও আল ফখরী এলাকায় এলাইছ মিয়া নামে ষাটর্ধো এক পাহারাদার পাওয়া গেলেও তিনি জানান এ মার্কেট ও দোকান পাহারা দিয়ে চাঁদা তুলে সর্বসাকূল্যে ৩৭শ’ টাকার উপর পাওয়া যায় না। এলাইছ মিয়া জানান, টাকা কম পেলেও পেটের তাগিদে এ কাজ করছি। এখান থেকে সড়কে চৌমুহনা দিকে একটু এগিয়ে ভিক্টোরিয়া স্কুল মোড়ে সিঙ্গার, বাটারফ্লাই, বেষ্ট বাই, ভিশন ইলেক্ট্রনিক্স, রিগ্যাল, এসএ পরিবহন, ডিএসবি বেলালের স’ মিল, গ্রান্ড তাজ হোটেল ও প্রাইম ব্যাংক ও বিলাস সপিং মলের মতো বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থাকলেও এখানে মাত্র ১জন পাহারাদার দিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তার কাজ করানো হয়। রাত পৌণে ২ টায় গ্রান্ড তাজের সামনে লুঙ্গি গেঞ্জি গায়ে সজাগ বসে থাকতে দেখা যায় পাহারাদার আনোয়ার আলীকে। তিনি বললেন, এসব দোকান প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অর্ধেকরই মালিক কোন টাকা দেন না। অন্যরা যা দেন তা মিলিয়ে ৪ হাজার-৪২শ’ টাকার মতো পাই। রাত ২টায় থানা মোড় এলাকায় গিয়ে দেখা যায় অর্ধ শতাধিক পাইকারি দোকান -গুদামের সামনে এলোপাতারি ভাবে পিয়াজ-রসুনের বস্তা ফেলে রাখা। রাত সোয়া ২ টায় হবিগঞ্জ রোডের চৌমুহনা থেকে নূর ফুড্স এলাকা পর্যন্ত মক্কা মার্কেট, ইউনাইটেড সপিং সেন্টার, সৈয়দ ফসিউর রহমান মার্কেট, মতিন শপিং সেন্টার, হাবিব মার্কেট, সোনালী মার্কেট, আখরা মার্কেট, উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়সহ দোকান, ব্যাংক, মেডিকেল সেন্টার, থাকলেও এই এলাকায় কোন পাহারাদার খুজেঁ পাওয়া যায়নি। পাহারাদার না থাকার পাশাপাশি এই এলাকার অনেক দোকানের সামনে কোন বাতি জ্বলতে দেখা যায়নি। সেখানকার বেবী ষ্ট্যান্ড থেকে নোয়াখালী হোটেল পর্যন্ত কয়েকশ’ দোকান ও ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য পাহারাদার পাওয়া যায় মাত্র ১জন। নকুল দাস নামে পাহারাদার জানান, ব্যবসায়ীরা লাখ লাখ টাকার মুনাফা করলেও পাহাদারদের জন্য টাকা দিতে চায় না। রাত সোয়া তিনটার দিকে চৌমুহনা থেকে ষ্টেশন সড়কের রহমান ফিলিং স্টেশন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক এলাকায় এটিএম বুথের সিকিউরিটি গার্ড ছাড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ২/৩জন পাহারাদার দেখা পাওয়া গেলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এছাড়া ষ্টেশন রোড, ভানুগাছ রোড, গুহ রোড ও কলেজ রোড ঘুরে বেওয়ারিশ কয়েকটি কুকুর ছাড়া কোন জনমানবের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। শহরের প্রধান প্রধান সড়কের এই চিত্রের পাশাপাশি শহর ও শহরতলীর আবাসিক এলাকার রাতের পরিস্থিতি আরো নাজুক। বেশীরভাগ আবাসিক এলাকাতেই কোন পাহারা ব্যবস্থা নেই। এছাড়া হাউজিং এস্টেট, সন্ধানী, বসুন্ধরা, কলেজ রোড, গুহ রোড, কোর্ট রোড, ডাক বাংলো রোড, ভানুগাছ রোড, রেল গেইট এলাকা, জালালিয়া রোড, মিদাদ মিশন রোড, মাষ্টার পাড়া পূবালী আবাসিক এলাকা, আলী ট্রেডার্সেও পেছনের আবাসিক এলাকা, সাগরদিঘি ও শাপলাবাগ এলাকায় কোন পাহারাদার নেই। ষ্টেশন রোড এলাকায় অনিক সুপার মার্কেট, সুফিয়া ম্যানশন, হিরণময় প্লাজা, আহমেদ বিপনী রূপালী সপিং সিটিতে কোন পাহারাদার দেখা যায় নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসব আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ও মার্কেটের ব্যবসায়ীরা স্থানীয়ভাবে কোন পাহারাদার নিয়োগ দেননি।
শ্রীমঙ্গল থানা সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৪৫১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত শ্রীমঙ্গল থানা। এ থানার জনসংখ্যা প্রায় ৩ লাখ ১৮ হাজার ২৫ জন। এসব জনসংখ্যা হারে নিরাপত্তা দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র ৫৭জন পুলিশ সদস্য।
এর মধ্যে ৩ জন ওসি, ৯জন এসআই, ১১জন এএসআই এবং ৪জন ড্রাইভার, ৩ জন কম্পিউটার অপারেটর, সেন্ট্রি ডিউটি ৩জন এবং কনস্টেবল ৩৪জন।
এর মধ্যে থানার প্রশাসনিক কাজ ও সেন্ট্রি পোষ্টে সার্বক্ষনিক দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন ১২ জন সদস্য। বাকি জনবল আইনশৃংখলা রক্ষা, ভিআইপি প্রটোকল, মামলা তদন্ত, পরিদর্শনসহ শহরের মার্কেট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ির নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত থাকেন।
এদিকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে পৌর এলাকায় কমিউনিটি পুলিশের কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। একই ভাবে ইউনিয়ন পর্যায়ে গ্রাম পুলিশের কার্যক্রমও ভেস্তে গেছে।
শ্রীমঙ্গল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি এএসএম ইয়াহিয়া বলেন, আমরা সমিতি থেকে ব্যবসায়ীদের আগেও জানিয়ে দিয়েছি মার্কেট ও নিজ নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা প্রহরী রাখতে। প্রয়োজনে আবারও সতর্ক করা হবে- মার্কেট মালিক না ব্যবসায়ীরা যৌথ ভাবে প্রহরী নিয়োগ করা জন্য। এরপরও তারা যদি তা না করে আর কোন চুরি বা দুর্ঘটনা ঘটে তার দায় শুধু পুলিশের উপর দিলে হবে না। আমরাও (সমিতি) তার দায় বহন করবো না।এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গল উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও কমিউনিটি পুলিশিং উপজেলা কমিটির সভাপতি রনধীর কুমার দেব বলেন ‘রাতের নিরাপত্তা বিধানে কমিউনিটি পুলিশের কর্মকান্ড আপাতত না থাকলেও সামাজিক নানা বিরোধ নিস্পত্তি কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম চালু আছে। পৌর পুলিশের তৎপরতা বিষয়ে মুঠোফোনে পৌরসভার চেয়ারম্যান মো.মহসিন মিয়ার সাথে যোগাযোগ করেলে তিনি বলেন‘ ‘পয়সার অভাবে পৌরসভার কমিউনটি পুলিশিং কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাত পেতেও ৫০-১শ’ টাকা পাওয়া যায়না। এসব কারণে এই সেবা বন্ধ রয়েছে’।
প্যানেল চেয়ারম্যান ও কাউন্সিলর মীর এম এ সালাম জানান, ২০০৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত পৌর পুলিশের তৎপরতা ছিল। এরপর জনগনের সহায়তা না পাওয়ায় অর্ধ লক্ষাধিক টাকার দেনার ভারে পৌর পুলিশের তৎপরতা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (শ্রীমঙ্গল সার্কেল) আশরাফুজ্জামান বলেন ‘জনগনের জান মাল রক্ষার্থে পুলিশ যথাসাধ্য চেষ্টা করছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে মালিকদের নিজস্ব পাহারাদার না থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, এবিষয়ে ওসি সাহেবকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শহরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে মার্কেট মালিকদের সাথে আলোচনা করতে। পাশাপাশি শহরের বিভিন্ন সোসাইটির সাথে কথা বলতে। অফিসারদের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। যাতে প্রতিটি পাড়া মহল্লায় ১জন ২ জন করে পাহারাদার নিয়োগ রাখা যায়। রাতের বেলা যে কোন পরিস্থিতিতে পুলিশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে। এতে করে রাতে শহরের নিরাপত্তা সম্পুর্ণ নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব হবে। জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কে এম নজরুল বলেন‘ শ্রীমঙ্গল থানায় ওসির দায়িত্ব নেয়ার সময় অনেক মর্কেট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক এলাকায় পাহারাদার ছিল। এখন প্রায় সবাই পাহারা বন্ধ করে দিয়েছে। জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে এখন চুরি হয় না। একারণে সীমিত জনবল নিয়ে রাতের জননিরাপত্তা বিধানে হিমশিম খাচ্ছি। তিনি বলেন রাতে জন নিরাপত্তার জন্য মাঠে ৭টি টীম কাজ করছে। ঈদকে সামনে রেখে আরো ২টি টীম বাড়ানো হবে।
অরক্ষিত রাতের শ্রীমঙ্গল
শেয়ার করুন