- সাইফুল ইসলাম:
৫সেপ্টেম্বর,বুধবার সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমানের নবম মৃত্যু বার্ষিকী। নবম মৃত্যুবাষির্কী উপলক্ষে নানা কর্মসূচী পালন করছে এম সাইফুর রহমান স্মৃতি পরিষদ,মরহুমের পরিবার ও তার রাজনৈতিক সংগঠন বিএনপি।
জ্যৈষ্ঠ পুত্র সাবেক এমপি ও মৌলভীবাজার জেলা বিএনপির সভাপতি এম নাসের রহমান জানান, নবম মৃত্যুবার্ষিকীতে এম.সাইফুর রহমান স্মৃতি পরিষদ ও মরহুমের পরিবারের পক্ষ থেকে তার গ্রামের বাড়িতে (সদর উপজেলার বাহারমর্দনে) মরহুমের কবরে পুস্পস্তবক অর্পণ,কবর জিয়ারত,কোরানে খতম,মিলাদ,দোয়া, শিরনী বিতরন ও স্মৃতি পরিষদের উদ্যোগে শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফলজ বৃক্ষ রোপনসহ নানা আয়োজন পালন করা হচ্ছে। এম.সাইফুর রহমান স্মৃতি পরিষদ ছাড়াও দলীয়ভাবে বিএনপির স্থানীয় জেলা ও উপজেলার নেতাকর্মীরা আজ সকালে মরহুমের কবরে পুস্পস্তবক অর্পণ,মিলাদ মাহফিল,দোয়া ও আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচী পালন করছেন মৌলভীবাজার জেলা ও উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা।
সাইফুর রহমানের জন্ম ১৯৩২ সালের ৬ই অক্টোবর, মৌলভীবাজারের মোস্তফাপুর ইউনিয়নের বাহারমর্দনে। পিতা মোহাম্মদ আবদুল বাছির, মাতা তালেবুন নেছা। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিলেন তিনি। মাত্র ৬ বছর বয়সে তার পিতা মারা যান। সে সময় তার অভিভাবকক্ত গ্রহণ করেন চাচা মোহাম্মদ সফি।
শিক্ষাজীবন, গ্রামের মক্তব ও পাঠশালা শেষ করে তিনি ১৯৪০ সালে জগৎসী গোপালকৃষ্ণ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর ১৯৪৯ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিকুলেশনে উত্তীর্ণ হন।
সিলেটের এমসি কলেজ থেকে আইকম পাস করে ১৯৫১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য লন্ডনে চলে যান। সেখানে পৌঁছার পর মত পাল্টে যায় তার।
ব্যারিস্টারির পরিবর্তে পড়েন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি। ১৯৫৩-৫৮ সময়কালে পড়াশোনার পর ১৯৫৯ সালে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস ইংল্যান্ড এন্ড ওয়েলস ফেলোশিপ অর্জন করেন। এছাড়া তিনি আর্থিক ও মুদ্রানীতি এবং উন্নয়ন অর্থনীতিতে বিশেষায়িত শিক্ষা গ্রহণ করেন।
১৯৬০ সালের ১৫ই জুলাই বেগম দূররে সামাদ রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ৩ পুত্র ও এক কন্যাসন্তানের জনক। এম সাইফুর রহমান ১৯৪৯ সালে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে লেটার মার্ক পেয়ে মেট্রিক, ১৯৫১ সালে সিলেট এমসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন সময়ে তিনি ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন সাইফুর রহমান এবং কারাবরণ করেন।
তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৭৬ সালে জিয়াউর রহমান সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা হিসেবে। তিনি ১৯৭৯ সালে মৌলভীবাজার-৩ (সদর-রাজনগর) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করলে এম সাইফুর রহমান ওই বছরের ২০ মার্চ থেকে ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৬ সালে তিনি আবার মৌলভীবাজার-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০১ সালের নির্বাচনে মৌলভীবাজার-৩ (সদর-রাজনগর) এবং সিলেট-১ (সদর-কোম্পানীগঞ্জ-১) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করার পর সাইফুর রহমান অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব পান। অর্থমন্ত্রী হিসেবে সংসদে ১২ বার বাজেট উপস্থাপন করে রেকর্ড করেন সাইফুর রহমান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি তিন ছেলে ও এক কন্যাসন্তানের জনক ছিলেন। বড় ছেলে এম নাসের রহমান মৌলভীবাজার সদর – রাজনগর নির্বাচনী এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য ও মৌলভীবাজার জেলা বিএনপি’র বর্তমান সভাপতি। ২০০৩ সালে তার স্ত্রী দুররে সামাদ রহমান ইন্তেকাল করেন।
তার শেষ ইচ্ছানুযায়ী বাহারমর্দনে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপির) প্রতিষ্ঠালগ্নে দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তাকে আপন করে ডাকলেন দল গঠনে অংশ নিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিত হতে। তিনি তাই করলেন।
রাজনীতিতে এলেন, আলোকিত করলেন, আলোকিত হলেন। ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ ও সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৌলভীবাজার-৩ আসন ও ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে মৌলভীবাজার-৩ ও সিলেট-১ আসন থেকে বিপুল ভোটে এমপি নির্বাচিত হন। ২০০৬ সালের ৮ই জুন তিনি সংসদে দ্বাদশ বাজেট পেশ করে দেশের সংসদীয় ইতিহাসে সর্বাধিক সংখ্যক বাজেট পেশকারী হিসেবে রেকর্ড গড়েন।
তিনি দীর্ঘদিন দেশের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন ছাড়াও বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনসহ দেশ-বিদেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোতেও নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
১৯৬৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় বেতন কমিশনে প্রাইভেট সেক্টর হতে একমাত্র সদস্য মনোনীত হন।
১৯৭৩ ও ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বেতন কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করেন।
১৯৭৬ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য ও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯১-৯৬ মেয়াদে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সময় তিনি দেশে মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) চালু করেন।
সাইফুর রহমান ১৯৯৪-৯৫ সালে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের ভাইস-চেয়ারম্যান, ১৯৮০-৮২ ও ১৯৯১-৯৫ সময়কালে তিনি বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক, ইসলামী উন্নয়ন ও ইফাড এর বাংলাদেশ গর্ভনরের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অর্থনৈতিক কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটি একনেকের চেয়ারম্যান ছিলেন।
তার জীবদ্দশায় দেশ ও বৃহত্তর সিলেট নিয়ে যে উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা করেছিলেন তার অনেকগুলো বাস্তবায়ন হলেও পুরোটা বাস্তবায়ন করতে পারেননি।
হঠাৎ এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিভে যায় তার জীবনপ্রদীপ, স্তব্ধ হয়ে যায় তার দেখা উন্নয়ন মহাপরিকল্পনার স্বপ্ন।
সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমানের নবম মৃত্যু বার্ষিকী
শেয়ার করুন