-
-
মামুন আহমদ:
১০২ টাকা মজুরী নিয়ে কাজ করে সংসার চলবে কেমনে স্যার?রোগবালাই লেগেই আছে?কাজের ফাঁকে কথা হচ্ছিল এক চা শ্রমিকের সাথে তখন আমার পায়ে রক্তচোষা জোঁক ধরে বসলো।আমি ভয়ে আতংকিত হয়ে চিৎকার দেওয়া শুরু করলাম,একজন মহিলা শ্রমিক হেসে,হেসে বললেন জোঁক দেখেই ভয় পেয়ে গেলেন দাদা,সকাল থেকে সেই বিকাল পর্যন্ত কতো যে জোঁকে আমাদের রক্ত খায় তাহা কি মনে রাখতে পারি দাদা।এটা একটি চা বাগানের মহিলা শ্রমিকের প্রশ্ন ছিল?রোদ্দুর মধ্যে কাজ,মাথার উপর সূর্য,ঝড়বৃষ্টি আসলে যাওয়ার জায়গা নেই,মেঘে ভিজে কাজ করতে হয় এটাই আমাদের জীবন!এটা একজন পুরুষ শ্রমিকের প্রশ্ন?দুটি পাতার একটি কুঁড়ি’ বললেই প্রথমেই আমাদের কল্পরাজ্যের মানসপটে ভেসে আসে সবুজে ঘেরা চা বাগানের উঁচু নিচু আঁকাবাঁকা টিলায় বেষ্টিত অনিন্দ্য সুন্দরের সমারোহ চাবাগান।আবার প্রতিদিন সকালে কিংবা কাজের ফাঁকে চায়ের কাপে চুমুক না দিলে দূর হয় না ক্লান্তি, নিঃশ্বাস ফেলি সজীবতার। কিন্তু এই চা উৎপাদনে জড়িতদের নিয়ে কেউ কি কখনো চিন্তা করেছেন। কয়জনই বা জানি তাহাদের নিরবে কান্নাকাটির কথা,এবং এসকল মানুষদের নিষ্পেষিত জীবন ব্যবস্থার কথা! আজ থেকে বহু বছর আগে বিট্রিশ শাসনামলে ভারত উপমহাদেশে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগমন ঘটে এসকল চা শ্রমিকদের।এরপর থেকে বংশ পরস্পরায় তারা কাজ করছে চা বাগানে এই শ্রমিকরা।তাহাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব সহ তাহাদের ভোটারাধীকার এর ব্যবস্থা করে দিলেন জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।তিনি চা বোর্ড গঠন করলেন।শ্রমিকদের কল্যাণে কাজ করতে সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।কিন্তু মালিকপক্ষ আমলে নেননা সরকারের নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্প।সরকার চাবাগানের শ্রমিকদের বাচ্ছাদের উন্নতমানের লেখাপড়ার জন্য স্কুল বানাতে চাইলে জায়গা দিতে মালিকপক্ষ গড়িমসি করেন বলে জানা গেছে!কিন্তু এই চাবাগানের জমির মালিক সরকার?এইতো কিছুদিন পূর্বে কালিঘাট রোডে পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নিতে ৭কোটি টাকা ব্যয়ে পর্যটন মোটেম বানানোর জন্য জায়গা নিয়েছিল সরকার,কাজও শুরু হয়েছিল কাজ চলছিল হঠাৎ ফিনলে কোম্পানি আদালতে মামলা টুকে দিয়ে কাজ বন্ধ করে দেন।এই উন্নয়ন কাজ থেকে শ্রীমঙ্গলবাসি বঞ্জিত হন।সরকারের পর্যটনশিল্পের উন্নয়নকাজ ঝিমিয়ে পড়ে।চা শিল্প বাংলাদেশের একটি অন্যতম একটি বৃহৎ শিল্প।বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও নেপথ্যের মানুষগুলো নানা বঞ্চনা আর অবহেলার শিকার হয়ে আসছে। চা শিল্পের মালিকদের উন্নয়ন হলেও ভাগ্যের পরির্বতন হয় না শ্রমিকদের। মধ্যযুগের ভূমিদাসের মতোই চা মালিকের বাগানের সঙ্গে বাধা তার নিয়তি।নেই উন্নত লেখাপড়া,এ যেন নীজ দেশে থেকে পরাধীন জীবনযাপন ব্যবস্থা।অনেক বাগানেরর স্যানিটারি ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা নেই, সুপ্রিয় বিশুদ্ধ পানীয়জলের ব্যবস্থা নেই।এই বিশাল,বিশাল চাবাগানেরছোট,ছোট চা গাছ ছেঁটে ছেঁটে যেমন ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেয়া হয় না।চা শ্রমিকের জীবনটাও তেমনি ছেঁটে দেয়া চা গাছের মতো, লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের একটা কুঁড়ে ঘরে বন্দি। বাস্তবিক অর্থে যারা চা শ্রমিকের জীবনমান,চলাফেরা কাছ থেকে দেখেছেন তারাই কেবল বলতে পারবেন চা বাগানে সবুজের ছায়া ঘেরা ভাণ্ডারে কতটা অমানবিক ও বর্বর জীবন কাটাতে হয় শ্রমিকদের।বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায়চা বাগানেই পাতা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত ৯৫ শতাংশ শ্রমিকই হচ্ছেন নারী। চা শ্রমিক নারীদের দিন শুরু হয় সেই কাকা ডাকা ভোরে। প্রতিটি নারী শ্রমিককেই তাড়াহুড়ো করে গৃহস্থালির কাজ শেষ করে ছোট ছোট সন্তানদের রেখে দলবেঁধে ছুটতে হয় বাগান পানে। এক চিমটে লবণ চা দিয়েই সকালের যাত্রা শুরু হয় চা শ্রমিকের। প্রতিদিন লাইন চৌকিদার, লেবার লাইনের নম্বরে যেয়ে চিৎকার দিয়ে চা শ্রমিকদের নম্বরের ঠিকানা দিয়ে থাকেন। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় তুফান সবকিছু মাথায় নিয়েই কাজে থাকতে হয় শ্রমিকদের। বৃষ্টি বা ঝড় আসলে সামান্যতম আশ্রয়ের জন্য বাগানগুলোতেই নেই কোনো শ্রমিক ছাউনি। এমনকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে এসকল নারী শ্রমিকদের কে ঝোপঝাড়ই ভরসা, নেই কোনো স্যানিটারি ল্যাট্রিনের ব্যবস্থাও। নারী শ্রমিকরা শুধু পাতি (চা পাতা) উত্তোলনের কাজই করেন না। তারা কলম কাঁটা, চারা গাছ রোপণ থেকে শুরু করে গাছের আগাছা পরিষ্কার ও করার কাজেও নিয়োজিত থাকেন।অথচ এসব নারী শ্রমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় উদাসীন বাগান মালিকরা। নেই তাদের পর্যাপ্ত চিকিৎসার সুবিধা।বিভিন্ন গণমাধ্যম থেকে জানা যায় বাগানে কর্মরত প্রায় নারীকেই দেখা যায় রক্তশূন্যতা, স্বাস্থ্যহীনতা, জন্ডিস, ডায়রিয়া, জরায়ু ক্যান্সারসহ নানা রোগে ভূগতে। অসচেতনতা, কাজের নোংরা পরিবেশ, পরিচ্ছন্ন পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থার অভাব, অপুষ্টিকর খাবার, নালা ও খালের পানির ব্যবহার, বাল্যবিবাহ, বেশি সন্তান নেয়া, নিয়ন্ত্রণহীন যৌনাচারসহ অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্নতার কারণেই চা শ্রমিকরা মূলত এসব রোগে আক্রান্ত হন।এটার মধ্য অপুষ্টি ও একটি কারণ।
-
আর্থিক অস্বচ্ছলতা, ভূমির সমস্যা, লোকবল বৃদ্ধি ও কিছুটা অভ্যাসগত কারণে চা বাগানের শ্রমিকদের ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ পয়:নিস্কাশন ব্যবস্থা নাজুক। বাগান কর্তৃপক্ষ, ইউনিয়ন পরিষদ ও এনজিও সমুহের মাধ্যমে কিছু ল্যাট্রিন বিতরণ করা হলেও বিশাল শ্রমিক পরিবারের মধ্যে সেগুলো পর্যাপ্ত নয়।সম্প্রতি ভাড়াউড়া,ভুড়ভুড়িয়া চাবাগানের ১৫০/১৬০ শ্রমিকরা ডায়রিয়া রোগে আক্রান্ত হলে বাগান ঘুরে দেখা যায় ফিনলে কোম্পানি তাহাদের বাসা,বাড়ির পাশের ড্রেইন পরিস্কার করে দেয়না,নাই বিশুদ্ধ পানি,লেট্রিন করে কিভাবে হাত পরিস্কার করতে হয় সেটাও জানা নেই এদের।সংসদ সদস্যর নির্দেশে তাহার পক্ষথেকে আওয়ামীগ নেতৃবৃন্দ বাগানে গিয়ে মানবিক সাহায্য, গভীর নলকূপ এবং খাবার সেলাইন সরবরাহ করে এসেছেন।গণমাধ্যম থেকে আরও জানা যায়চা শ্রমিকদের মধ্যে ১৫ শতাংশ নারী প্রাথমিকভাবে জরায়ুমুখে ক্যান্সারে আক্রান্ত এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে গবেষণামূলক সংস্থা সিআইপিআরবির এক জরিপে।এবছরের মে মাসে জরিপ অনুষ্ঠিত হয়।এতে দেখা গেছে দেশের মোট বাগান ১৬৪টি বাগানে প্রায় ৯ লাখ চা জনগোষ্ঠীর মধ্যে মাত্র ১লক্ষ শ্রমিক বাগানে কাজ কররে, অর্ধেক নারী শ্রমিক। এই অর্ধেক নারী শ্রমিকের ১৫ শতাংশের শরীরে বাসা বেঁধেছে মরণব্যাধি ক্যান্সার। মৌলভীবাজারের রাজঘাট, খেজুরীছড়া, আমরাইলছড়া, সাঁতগাও, হোসেনাবাদ, আলীনগর, শমসেরনগর, মিরতিংগা, মাধবপুরসহ ১০টি বাগানে পরিচালিত এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেহেতু দেশের সব চা বাগানে একই কাজ ও বাসস্থানের পরিবেশ বিদ্যমান সেহেতু চা বাগানগুলোতে একই অবস্থা থাকার সম্ভবনা প্রবল।গণমাধ্যমে আর প্রকাশ হয়,জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) অর্থায়নে জাতীয় স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও গবেষণামূলক সংস্থা সিআইপিআরবির কারিগরি সহযোগিতায় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ উদ্যোগে মৌলভীবাজার জেলার চা বাগানে প্রজনন ও মাতৃস্বাস্থ্য সেবার মান উন্নয়নে বিবাহিত নারীদের জরায়ুমুখের ক্যান্সার শনাক্তকরণের জন্য বিনামূল্যে ‘ভায়া’ টেস্ট কার্যক্রম শুরু হয়েছে।সিআইপিআরবি সূত্রে জানা যায়, মৌলভীবাজারের ৯২টি চা বাগানের মধ্যে দশটি চা বাগানে মোট তিন হাজার নারীর ভায়া টেস্ট সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে ৫১৯ জন দুরারোগ্য ক্যান্সার নামক ব্যাধিটি পজিটিভও এসেছে। এই ভায়া টেস্টের যে ভয়াবহ ফলাফল এসেছে তা চমকে দেয়ার মতো। তথ্যমতে চা বাগানে কর্মরত নারীদের শতকরা ১৫ জনের জরায়ুমুখে ক্যান্সারের লক্ষণ পাওয়া গেছে। এই কার্যক্রমে অংশ নেয়া নারীরা সাধারণত ২১ থেকে ৬৫ বছরের। চা বাগানে শিক্ষার অভাব থেকে ক্যান্সার তথা স্বাস্থ্য নিয়ে অসচেতনতা, কাজের নোংরা পরিবেশ, অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্নতা যা জরায়ুমুখে ক্যান্সারের জন্য দায়ী।একজন চা শ্রমিক দৈনিক যে মজুরী পান তা দিয়ে চিকিৎসা করানো দূরের কথা পরিবারের খরচ যোগানোই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। আর অধিকাংশ চা বাগানের নির্ধারিত কম্পাউন্ডারে (হাসপাতালে) গেলে সব রোগের ঔষধ হিসেবে দেয়া হয় কয়েকটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেট,আর কিছু ব্যান্ডেজ। চা গাছ ছেঁটে ছেঁটে ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেয়া হয় না। চা শ্রমিকের জীবনটাও তেমনি ছেঁটে দেয়া চা গাছের মতো, লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের একটা কুঁড়ে ঘরে বন্দি। বাস্তবিক অর্থে যারা চা শ্রমিকের জীবনযাত্রা কাছ থেকে দেখেছেন তারাই কেবল বলতে পারবেন চা বাগানে সবুজের ছায়া ঘেরা ভাণ্ডারে কতটা অমানবিক ও বর্বর জীবন কাটাতে হয় শ্রমিকদের। বাগানের সবুজের হাসি আমরা খুব দেখতে পাই কিন্তু দেখতে পাই না কেবল শ্রমিকের কান্না এবং আহাজারি! দেখতে পাইনা কীভাবে মাত্র ১০২ টাকা দৈনিক মজুরী দিয়ে এতো কষ্টে জীবনপার করে চা শ্রমিকরা। আমরা কখনো ভাবি না সবুজঘেরা বিস্তৃতপ্রান্তরে কীভাবে বর্বরোচিত জীবন যাপন আজও পরিচালিত করছে এই চাবাগানের শ্রমিকরা বিশেষত নারী শ্রমিকরা এটাই সচেতন মহলের প্রশ্ন?।
-
মো.মামুন আহমদ,লেখক ও সাংবাদিক-শ্রীমঙ্গল।
প্রশ্ন আছে! উত্তর নাই?
শেয়ার করুন