ভুমিখেকো চক্র ও অসাধু সেটেলমেন্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজস 

বড়লেখা প্রতিনিধি॥ বড়লেখায় দেবোত্তর সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা ও উইলের শর্ত ভঙ্গ করে ভুমিখেকো চক্র ও অসাধু সেটেলমেন্ট কর্মকর্তাদের যোগসাজসে সেবাইতরা নিজেদের নামে খতিয়ান সৃষ্ঠি করে কোটি কোটি টাকার দেবোত্তর সম্পত্তি বিক্রি করছে। জালিয়াতির মাধ্যমে সেবাইতদের ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ডভুক্ত এসব জমি ক্রয় করে সবচেয়ে বেশি প্রতারিত হচ্ছে প্রবাসীরা। এসব জমি ক্রয়ের পর নামজারি করতে না পারায় অনেকেই পড়েছেন মহাবিপাকে। এখন তাদের অবস্থা যেন আমও গেল ছালাও গেল পরিস্থিতি। গত ১৫ বছরে অন্তত ২০ কোটি টাকার দেবোত্তর সম্পত্তি বেহাত হয়েছে।

এদিকে ভূমিখেকো চক্রের কবল থেকে জবরদখলকৃত দেবোত্তর সম্পত্তি উদ্ধার ও রক্ষার দাবী জানিয়ে গত ১৮ জুন জেলা প্রশাসক বরাবরে দরখাস্ত করেছেন প্রয়াত সেবাইত রমাকান্ত রায় পুরকায়স্থের ছেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক রনজিৎ কুমার রায় পুরকায়স্থ। তার দরখাস্তের পরিপ্রেক্ষিতে জাল কাগজে দেবোত্তর সম্পত্তি হস্তান্তর সিন্ডিকেটের ৮ ব্যক্তির ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরা হলেন সেবাইত রাধাকান্ত রায় পুরকায়স্থ, রাজীব পুরকায়স্থ, প্রবাসী শামীম আহমদ, জসিম উদ্দিন, জালাল আহমদ, লাল মিয়া, আছার উদ্দিন ও আব্দুল হাসিব।

জানা গেছে, মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার পানিধার গ্রামের দেবভক্ত প্রয়াত জমিদার রামকুমার রায় পুরকায়স্থ প্রায় ৭৫ বছর পূর্বে উইলের মাধ্যমে কাঠালতলী মৌজাসহ কয়েকটি মৌজায় ১৩০৩ একর ভুমি শ্রী শ্রী লক্ষী নারায়ন জিউ নামে দেব্ত্তোর করে যান। দেবোত্তরে রূপান্তরের নিবন্ধিত দলিলের প্রথম শর্তে রামকুমার রায় পুরকায়স্থ ঘোষণা করেন জীবদ্দশায় উক্ত বিগ্রহ যুগলের তিনি নিজে সেবাইত এবং দেবোত্তর সম্পত্তির শাসন সংরক্ষণ ও পরিচালনা নিজেই করবেন। তার মৃত্যুর পর তিন ছেলে ও এক জামাতা পরিচালনা করবেন। অপর ছেলে সাবালক হওয়ার পর তাকে ব্যবস্থাপনা বোর্ডের সদস্য করতে হবে। দলিলের মোট ১৪টি শর্তের ৬ নম্বরে তিনি ঘোষণা করেন সেবাইতগন কিংবা তম্মধ্যে কেহ উক্ত দেবোত্তর সম্পত্তি কোন প্রকার দান, বিক্রী, হস্তান্তর, কোথাও দায়বদ্ধ কিংবা ভাগবাটোয়ারা করতে পারবেন না। বংশানুক্রমিক উত্তরাধীকারীগন দেবোত্তর সম্পত্তির সেবাইত থাকবেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বড়লেখা উপজেলার ১০৩ নং জেএলস্থিত কাঠালতলী মৌজার এসএ রেকর্ডে ২৪.৫৮ একর দেবোত্তর ভুমি শ্রী শ্রী লক্ষ্মী নারায়ন জিউ ষ্টেটের পক্ষে সেবাইত রাজেন্দ্র রাম রায় পুরকায়স্থ, রবীন্দ্র রাম রায় পুরকায়স্থ, রমেন্দ্র রাম রায় পুরকায়স্থের নাম রয়েছে। আরএস ৯৩৫ নং খতিয়ানের ৮৮২ নং দাগে চারা রকম ৪৩ শতাংশ এবং ৮৮৩ নং দাগে বাড়ি রকম ৩ একর ৫৪ শতাংশ ভুমি দেবোত্তর সম্পত্তি। দেবোত্তর সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা আইন অনুযায়ী জেলা প্রশাসক এ সম্পত্তির ট্রাস্টি এবং সেবাইতরা তার অধীনস্থ কর্মকর্তা/কর্মচারী মাত্র। কিন্তু দেবোত্তর সম্পত্তির সেবাইত রাধাকান্ত রায় পুরকায়স্থ সুকৌশলে বর্ণিত ৮৮২ নং দাগের পৌনে পাঁচ শতাংশ এবং ৯১১ নং দাগের ৪.৬৫ শতাংশ ভুমির আমমোক্তার নিযুক্ত করেন জনৈক আছার উদ্দিনকে (দলিল নং-১০৩৮)। গত বছরের ২১ জুন আছার উদ্দিন ১৯২৩ নং দলিলে উক্ত ৯ শতাংশ ৪৩ পয়েন্ট ভুমি ২১ লাখ টাকায় শামিম আহমদ, জসিম উদ্দিন ও জালাল আহমদের নিকট বিক্রি করেন। দলিলে সেবাইত রাধাকান্ত রায় পুরকায়স্থের নামে উক্ত ভুমি উল্লেখিত মৌজার ১২৪২ নং খতিয়ান থেকে হস্তান্তরিত উল্লেখ করলেও উপজেলা ভুমি অফিস ও ইউনিয়ন ভুমি অফিসের কোন ভলিয়মে এ খতিয়ান পাওয়া যায়নি। তবে বিক্রিত ভুমির রেকর্ডপত্র দেবোত্তর হিসেবে সংরক্ষিত রয়েছে।

আছার উদ্দিন জানান, রাধাকান্ত রায় ঢাকায় থাকেন। এ জমি দেখভালের জন্য তিনি তাকে পাকা দলিলে আমমোক্তার নিযুক্ত করেন। পরে তিনিই প্রায় ২১ লাখ টাকায় তা বিক্রি করেন। তার নির্দেশে আমি দলিলে স্বাক্ষর করি। বিক্রির টাকা সেবাইত রাধাকান্ত রায় নিয়েছেন।

একই মৌজায় এসএ ৬৪৮ দাগের ৩০ শতাংশ দেবোত্তর সম্পত্তির সেবাইত রনেন্দ্র কুমার পুরকায়স্থ, রমা কান্ত পুরকায়স্থ, রাধাকান্ত পুরকায়স্থ ও শ্যামাকান্ত পুরকায়স্থ ২০১১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ৪৭১৫নং দলিলে উপজেলার রফিনগরের ছিদ্দিকুর রহমান, ফয়জুর রহমান ও সুয়েদুর রহমানের নিকট ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। সেবাইত রনেন্দ্র কুমার রায় পুরকায়স্থ, রুদ্রেন্দ্র কুমার রায় পুরকায়স্থ, রমাকান্ত রায় পুরকায়স্থ, রাধাকান্ত রায় পুরকায়স্থ, শ্যামাকান্ত রায় পুরকায়স্থ এসএ ৮৩২ নং দাগের ৬১ শতাংশ দেবোত্তর জমি ভুয়া কাগজে নিজেদের নামে রেকর্ডভুক্ত করে ২০০৫ সালের ২৯ জুন ৩০৬৬ নং দলিলে পাখিয়ালা গ্রামের মৃত সুরুজ আলীর ছেলে আজমল আলীর নিকট হস্তান্তর করেন। এছাড়া অভিযোগকারী সেবাইত রনজিৎ কুমার রায়সহ অন্যান্য সেবাইতরা ২০১৫ সালের ১৪ মে ১৫৪৩ নং দলিলে ৭ শতাংশ ভুমি একেএম হেলাল উদ্দিন ও জাকিয়া সুলতানার নিকট বিক্রি করেন। সেবাইত রাধাকান্ত রায়, শ্যামাকান্ত রায় ও রনজিৎ কুমার রায় ২০১৪ সালের ৪ মে ১৪ শতাংশ দেবোত্তর সম্পত্তি পানিধারের বরইতলীর মৃত কুতুব উদ্দিনের ছেলে আব্দুর রাজ্জাকের নিকট হস্তান্তর করেন। সুত্র জানায় সম্প্রতি সেবাইত রুদ্রেন্দ্র কুমার পুরকায়স্থ ভোলা কাঠালতরী মৌজার পানিধারে ১৭ শতাংশ দেবোত্তর ভুমি ১০ লাখ টাকায় হস্তান্তর করেছেন। যার নিকট হস্তান্তর করেছেন সে ব্যক্তি ক্রয়কৃত ক্ষেতের জমি ভরাট করছে।

সেবাইত রুদ্রেন্দ্র কুমার পুরকায়স্থ ভোলা জানান, এ দেবোত্তর ভুমি তিনি বিক্রি করেননি। নিজে দোকানঘর করার জন্য মাটি ভরাট করছেন। ইতিপুর্বে দেবোত্তর সম্পত্তি বিক্রির ব্যাপারে জানান, নিজেদের নামে রেকর্ডভুক্ত কিছু জমি পারিবারিক প্রয়োজনে বিক্রি করেছেন। অন্যান্য সেবাইতরা তা করেছেন।

সেবাইত রাধাকান্ত রায় পুরকায়স্থের মোবাইল ফোনে (০১৭১৪৩৭৭৯৫৭) যোগাযোগ করলে তা বন্ধ থাকায় দেবোত্তর সম্পত্তি বিক্রির ব্যাপাওে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সেবাইত রনজিৎ কুমার রায় পুরকায়স্থ জানান, জনৈক আব্দুর রাজ্জাকের নিকট তিনি কোন দেবোত্তর সম্পত্তি হস্তান্তর করেননি। ভুমিদস্যুরা জালিয়াতি করেছে। পারিবারিক দেবোত্তরের কিছু জমি অন্যান্য সেবাইতদের সাথে তিনিও জনস্বার্থে হস্তান্তর করেছেন। এজন্য কোন অপরাধ হলে যেকোন শাস্তি মাথা পেতে নিবেন। ভুমিদস্যু লাল মিয়া আমাদের দেড়শ বছরের পুরনো বাড়ি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছিল। তা লিখে দিতে আমাকে হুমকি প্রদান করে। দেবোত্তর সম্পত্তি দখলমুক্ত করার জন্য আমি জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত অভিযোগ করি। বড়লেখা সহকারী কমিশনার (ভুমি) এ অভিযোগের তদন্তভার পেয়ে পক্ষপাতমুলক প্রতিবেদন দাখিল করেন। আমি এ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি দিয়েছি।

সহকারী কমিশনার (ভুমি) মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিন জানান, পারিবারিক দেবোত্তর বলে ভুমি অফিসে কোন রেকর্ড নেই। রাম কুমার রায় পুরকায়স্থের দেবোত্তর করা সম্পত্তি জবরদখল ও রক্ষার দাবীতে তারই ছেলের নাতি রনজিৎ কুমার রায় জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করেন। তদন্তে দেখা যায় দেবোত্তর সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা নীতিমালা লঙ্ঘন কর্ েঅভিযোগকারী রনজিৎ কুমার রায়ও অন্যান্য সেবাইতদের মতো দেবোত্তর সম্পত্তি হস্তান্তর করেছেন। নীতিমালা অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের পূর্বানুমতি ছাড়া তা ক্রয়-বিক্রয়ের সুযোগ নেই। কিন্তু রাম কুমার রায় পুরকায়স্থের দেবোত্তর সম্পত্তি জেলা প্রশাসকের পূর্বানুমতি ছাড়াই বিভিন্ন কৌশলে সেবাইতরা হস্তান্তর করেছেন। তবে অত্র অফিসে সমুদয় সম্পত্তি দেবোত্তর হিসেবে রেকর্ডভুক্ত রয়েছে। জাল-জালিয়াতির সব ঘটনাই এ অফিসের বাহিরে ঘটেছে। তাই হস্তান্তরিত কোন ভুমির নামজারী হয়নি। ইতিপূর্বে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে প্রেরণ করা হয়েছে।

 

শেয়ার করুন