কানাডিয়ান মেইন স্ট্রিম কালচারের সাথে সম্পৃক্ততা নির্বাচনে জয়ের পূর্বশর্ত

রেজাউল ইসলামঃ

সিটি কাউন্সিল নির্বাচনে আমার পর্যবেক্ষণ থেকে আমার মনে হয়েছে আমাদের প্রার্থী মহসিন ভূঁইয়া আরো ভালো করতে পারতেন কিন্তু কিছু ভুলের কারণে তিনি সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমাকে কিছু দিন আগে একজন ইনবক্স করে জানিয়েছিলেন, তিনি মহসিন ভূঁইয়ার ক্যাম্পেইন অফিসে যেতে আগ্রহী কিন্তু তিনি মহসিন ভূঁইয়ার চতুর্দিকে এমন সব ব্যক্তিদের দেখতে পান যারা সব সময় কমিউনিটির সব কিছুতে অহেতুক বাহাদুরী ফলাবার চেষ্টা করেন। তিনি তাদের দেখে ক্যাম্পেইন অফিসে যাবার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তার ধারণা সাধারণ ভোটাররা এই একই কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ক্যাম্পেইন অফিসে যাননি।

উপরে যে কথাটি বললাম তা হচ্ছে একজন নাগরিকের, একজন ভোটারের কথা।

এবার আসি আসল কথায়। আমি বহুবার এই বিষয়ে ইতিপূর্বে লিখেছি, সেটি হচ্ছে কানাডার মেইন স্ট্রিম কালচারের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে তার পক্ষে জয়ী হয়ে আসা কঠিন, কারণ শুধুমাত্র কানাডিয়ান-বাংলাদেশীদের ভোটে কোন দিন জয় লাভ করা সম্ভব নয়। কানাডিয়ান-বাংলাদেশীদের ভোট একটি মূল ফ্যাক্টর হলেও এটি জয় নির্ধারণের জন্য একমাত্র ফ্যাক্টর নয়। আমি মহসিন ভূঁইয়ার প্রাপ্ত ভোট থেকে ধারণা করতে পারি তিনি অধিকাংশই কানাডিয়ান-বাংলাদেশীদের ভোট পেয়েছেন, অন্যান্য কমিউনিটির ভোট তেমন একটা পাননি।

আপনি মেইন স্ট্রিমের কেউ নন, বিভিন্ন কমিউনিটিতে আপনার কোন কন্ট্রিবিউশন নেই, সব কমিউনিটির ভোটাররা কেন আপনাকে ভোট দিবে? হঠাৎ করে আপনি ভোটারদের বাসায় বাসায় যাওয়া শুরু করে দিলেন, তাদের নানা সমস্যার কথা শুনলেন, এটাই কি যথেষ্ট? ভোটাররা ভাবলো, ইনাকে তো আগে কখনো দেখিনি, কোথাও কোন নাম গন্ধ ছিল না, হঠাৎ কোথা থেকে আসলেন!! তারা বুঝতে পারলো আপনি শুধু ভোট চাইতে এসেছেন কোন রকম পূর্ব সামাজিক দায়বদ্ধতা, সামাজিক কর্মকাণ্ড ছাড়াই। তারা পাশাপাশি এও দেখলো অন্য বেশ কিছু প্রার্থীর সব কমিউনিটিতে যথেষ্ট কন্ট্রিবিউশন আছে। তাহলে কেন তারা আপনাকে ভোট দিবে? শুধু একটি কারণও দেখাতে পারলে তারা হয়তো আপনাকে ভোট দিতে রাজি হতো।

এবার আসি কোথায় কোথায় আমার দৃষ্টিতে ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছেঃ

১) ক্যাম্পেইন টিমের সদস্য নির্বাচনে ভুল ছিল। প্রতিনিয়ত লাইভে প্রদর্শিত কিছু কিছু সদস্যের কর্মকান্ড এবং কথাবার্তা দেখে মনে হয়েছে তারাই সব কৃতিত্ব হাসিল করতে চান। তাদের কথাবার্তা প্রার্থীকেও ছাড়িয়ে গেছে ক্ষেত্রবিশেষে। প্রার্থীকে মনে হয়েছে ম্রিয়মান, তাদের অধীনস্ত। যেখানে ক্যাম্পেইন টিম প্রার্থীর নিয়ন্ত্রানাধীন থাকার কথা সেখানে মনে হয়েছে প্রার্থী নিজেই অসহায়ের মত ক্যাম্পেইন টিমের নিয়ন্ত্রানাধীন হয়ে আছেন। ক্যাম্পেইন টিম অন্যান্য কমিউনিটির কাউকে সম্পৃক্ত না করে প্রতিদিন শুধু মাত্র নিজেদের কমিউনিটির মধ্যে বক্তৃতা, বিবৃতি দিয়ে কি প্রমান করতে চাচ্ছিলেন সেটাই এখনো পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না। ক্যাম্পেইন অফিসে অন্যান্য কমিউনিটির ভোটারদের তেমন কোন উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি। বাংলাদেশীদের মধ্যেই ক্যাম্পেইন অফিস সীমাবদ্ধ ছিল।

২) নির্বাচনী প্রচারণাকে মনে হয়েছে ট্রিপিক্যাল বাংলাদেশী প্রচারণা। স্ট্রিট সো, গাড়ি বহরের যাত্রা বাংলাদেশের রাজনীতিকেই মনে করিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের মডেল কি কানাডাতে চলতে পারে? এই সব প্রচারণায় ভোটারা উদ্ভুদ্ধ হবার বদলে বিরক্ত হয়েছে বেশি। প্রচারণার কোথাও অন্যান্য কমিউনিটির তেমন কোন প্রতিনিধিত্ব ছিল না। এই সব কর্মকাণ্ডে অন্যন্যা কমিউনিটির কাউকে কি আমন্ত্রণ করে আনা যেতো না? নাকি সেটা ম্যানেজ করার ক্যাপাসিটি তাদের ছিল না? প্রতিদিন নিজেদের মধ্যে নিজেরা আড্ডাবাজী, চা, বিস্কুট, সিঙ্গারা, খোশ গল্প, বক্তৃতা দিয়ে গলা ফাটিয়ে কি এমন লাভ হয়েছে? যে ভোটটা পাওয়া হয়েছে সেটি এইসব না করলেও পাওয়া যেত বলে মনে হয়। কার্যকর তেমন কিছুরই প্রাপ্তি ঘটেনি।

৩) একটি তথ্য থেকে জানা যায় যে, মহসিন ভূঁইয়াকে একটি ডিবেটে অংশ গ্রহনের আমন্ত্রণ জানানোর পরেও তিনি তাতে অংশ গ্রহন করেননি। সেটি আসলে কোন ডিবেটও ছিল না। সেটি ছিল অনেকটাই প্রার্থিদের পরিচিতি, তাঁরা নির্বাচিত হলে কি করবেন, কি তাদের পরিকল্পনা, ভিশন, মিশন ইত্যাদি বিষয়গুলি মিডিয়ার মাধ্যমে ভোটারদের কাছে তুলে ধরা। এমন একটি সুযোগ কাজে না লাগানোর পেছনে কোন যুক্তি থাকতে পারে না। এই অনুষ্ঠানটিতে আমরা গ্যারি ক্রেফোর্ড, মিশেল হোল্যান্ড, সুমন রয় প্রমুখ প্রার্থীদের বিষয়ে জানতে পেরেছি। কি এমন সমস্যা ছিল যে তিনি এমন একটি সুযোগ থেকে নিজেকে বিরত রাখলেন? এই বিষয়টিও প্রার্থীর সক্ষমতা সম্পর্কে ভোটারদেরকে ভাবিয়েছে।

৪) যিনি নির্বাচনে প্রার্থী হন তাকে সকল প্রকার সমালোচনা, ব্যাঙ্গ, বিদ্রোপ, কটাক্ষ সয্য করার ক্ষমতা অর্জন করতে হয়। তাকে মেনে নিতে হবে সবাই তাকে সমর্থন করবে না, কেউ কেউ সমালোচনা করবে, তীব্র ভাষায় আক্রমণ করবে। প্রার্থী নিজে যেমন সহিষ্ণুতার অধিকারী হবেন, তার নির্বাচনী টিমও সেই ধরনের সহিষ্ণুতার অধিকারী হবেন। প্রার্থীকে ভাবতে হবে যিনি তাকে ভোট দিবেন না তিনি তারও প্রতিনিধি। নানা রকম বিরূপতার মধ্য দিয়েই প্রার্থীকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছতে হয়। কেউ সমালোচনা করলেই রিএক্ট করা প্রার্থীর দুর্বলতাই প্রকাশ করে বরং সমালোচনাকে যুক্তি দিয়ে মোকাবেলা করাই উত্তম পন্থা হিসাবে স্বীকৃত। সমালোচনাকারীকে পারিপার্শ্বিক অবস্থা দিয়ে চাপ সৃষ্টি করা বোকামির নামান্তর। প্রার্থী নিজের উপর আস্থা এবং ভোটারদের উপর আস্থা থাকলে কোন কিছুই তাকে দমিয়ে রাখতে পারে না।

৫) প্রার্থীর সব চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে একটি পোল বা জনমত জরিপকে কেন্দ্র করে। একটি প্রতিষ্ঠিত পোলকে এনকাউন্টার করতে গিয়ে আরেকটি পোলকে নিয়ে আসা হয়েছে যা দিয়ে প্রার্থী এগিয়ে আছেন বলে দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছে। যে কথিত পোল দিয়ে পূর্বের একটি প্রতিষ্ঠিত পোলকে ডিফিউজ করার চেষ্টা করা হয়েছে সেটি প্রকৃত অর্থে কোন পোল ছিল না। এর মাধ্যমে প্রার্থী সম্পর্কে ভোটারদের মধ্যে ভুল বার্তা পৌছে দেওয়া হয়েছে। ভোটাররা ভেবেছে ভোট বৃদ্ধির জন্য প্রার্থী শঠতার আশ্রয় নিয়েছেন। প্রার্থী এমন একটি হাস্যকর জরিপের সংগে যুক্ত নন বলে দাবী বা বিবৃতি দিলে ভোটাররা আশ্বস্ত হতে পারতো। কিন্ত তিনি সেটি না করাতে ভোটারদের মনের মধ্যে একটি নেতিবাচক ধারনা ভোটের দিন পর্যন্ত শুপ্ত অবস্থায় ছিল। শেষ মুহূর্তে সেটি কফিনে শেষ প্যারেক ঠুকার মত কাজ করেছে। যাদের মস্তিষ্ক থেকে এই পরিকল্পনার উদয় হয়েছিল তাদের সম্পর্কে ভবিষ্যতে সতর্ক হবার অবকাশ আছে।

ভবিষ্যতে ফাস্ট জানারেশন থেকে কেউ প্রার্থী হতে চাইলে মেইন স্ট্রিম কালচারের সংগে সম্পৃক্ত হয়ে আসতে হবে, তানাহলে তিনি ভোট পেলেও জয়ী হতে পারবেন না। প্রকৃত অর্থে ফাস্ট জেনারেশন থেকে আমাদের এই চেষ্টা না করে আমাদের সন্তানদের মধ্যে সেই চেষ্টার প্রকাশ ঘটাতে পারি কিনা সেই দিকে মনোনিবেশ করা উচিত, কারন আমাদের সন্তানরা মেইন স্ট্রিম কালচারকে ধারন করে বড় হবে। তারাই পারবে কানাডার পাশাপাশি আমাদের বাংলাদেশের পতাকা বহন করতে। চলুন আমরা তাদেরকেই নেতৃত্বের জন্য উদ্ভুদ্ধ করি, উৎসাহ দেই।

আমি একজন ভোটার হিসাবে আমার চোখে যা ধরা পড়েছে তারই বর্ণনা দিলাম মাত্র। আমার এই লেখা কেউ ব্যক্তিগতভাবে নিবেন না বা কাউকে আহত করার উদ্দেশ্যে করা হয়েছে এমনও ভাববেন না। আমার এই বর্ণনার সংগে দ্বিমত, ভিন্ন মত থাকতেই পারে। যিনি দ্বিমত, ভিন্ন মত দিবেন সেটি তার স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং তারই ব্যক্তিগত মত হিসাবে গন্য হবে। আমি তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমার এই পর্যবেক্ষণ ভবিষ্যতে কোন উপকারে আসলে কার লাভ হবে সেটি চিন্তা করে দেখলে খুশি হবো।

পরিশেষে আমি মহসিন ভূঁইয়াকে অভিনন্দন জানাই। তিনি হারেননি, তাঁর কিছু ত্রুটিপূর্ণ প্রচেষ্টা হেরে গেছে।

লেখকঃ রেজাউল ইসলাম, টরন্টো, কানাডা

শেয়ার করুন