(এই ফুলগুলোর অসাধারণ সুগন্ধ আমাকে সবসময়ই তীব্রভাবে আকৃষ্ট করে। আমি বাগানে শুধুমাত্র তীব্র সুগন্ধির জন্য মেহেদী/মেন্দী এবং নিম গাছ লাগিয়েছি। যারা এই ফুলগুলোর তীব্র সুগন্ধি সম্পর্কে অবগত আছেন তারা তো জানেনই যারা অবগত নন কখনও সুযোগ পেলে দেখে নেয়ার অনুরোধ করছি । আর ছাতিম ফুলের সুগন্ধের কথা তো নতুন করে বলার কিছু নেই। মনে হয় কেউ যেন উপুড় করে শিশি শিশি আতর বাতাসে ঢেলে দিয়েছে। অগুরু সংস্কৃত শব্দ। আতর অর্থে ব্যবহৃত হয়।)
‘সাদা পাথরের রাজ্যে’ ভোলাগঞ্জ; সিলেট
রোজকার একঘেয়ে ক্লান্তিকর নাগরিক জীবন, স্ট্রেস, টেনশন, ডেডলাইন থেকে মাঝে মাঝে সাময়িক পালানোর ইচ্ছে হয় আমাদের। “কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে…” শুধু মনে মনে পুষে না রেখে বাস্তবেই সত্যি সত্যি উইকএন্ডে নৈসর্গপ্রিয় কিছু প্রিয় সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যদের সাথে ঘুরে এলাম ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্তবর্তী সিলেটের ভোলাগঞ্জের অপূর্ব সুন্দর সাদা পাথরের রাজ্য থেকে। মেঘালয় আসলেই মেঘের আলয়। দৃষ্টি সীমানা যতদূর যায় সবুজ পাহাড়ের গায়ে স্থুপ স্থুপ সাদা মেঘ আটকে আছে। আর সেই বরফ শীতল স্বচ্ছ পাহাড়ি ঢলে নেমে আসছে কোটি কোটি টাকা মূল্যমানের বালি, পাথর। বিশাল সব পাহাড়গুলো আমাদের সীমানায় পড়েনি বলে এতক্ষণ যে দুঃখবোধ হচ্ছিল তা মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেলো। কি আশ্চর্য সুন্দর টলটলে নীল জলের লেগুন। বরফ শীতল সে স্বচ্ছ জলধারা নিমিষেই সব ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। ভোলাগঞ্জ যাওয়ার পুরো যাত্রাপথই শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছবির মতো সুন্দর। পাহাড়গুলো থেকে তীব্র পাহাড়ি ঢলে মূল্যবান বালি, পাথর আমাদের সীমান্তে নেমে আসছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যা বিশাল ভূমিকা রাখছে। কর্মসংস্থান হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের, সুবহানাল্লাহ্। যাতায়াত পথ যথেষ্ট খারাপ হওয়ার কারণে দর্শনার্থীদের আনাগোনা কম। আর হয়তো এই কারণেই প্রকৃতির স্বাভাবিক নির্মলতা এখনও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। “পাথর নিয়ে প্রচলিত স্হানিয় দারুণ একটি মিথ রয়েছে ।” পাথরগুলো নাকি জীবিত ও পাথর থেকে নতুন পাথরের জন্ম হয়। কিন্তু মানুষের হাতের স্পর্শ পেলে পাথর মরে যায়, থেমে যায় সব বৃদ্ধি। কথাগুলো কতটুকু সত্যি জানিনা তবে এটা সত্যি প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের অনিয়ন্ত্রিত অনধিকার প্রবেশ প্রকৃতির স্বাভাবিক ছন্দকে ব্যাহত করে। যার উদাহরণ ভোলাগঞ্জ। সিলেটের অন্যান্য স্পটগুলো যখন মানুষের অনিয়ন্ত্রিত প্রবেশাধিকারের ফলে প্রকৃতির স্বাভাবিক সৌন্দর্য দ্রুত হারাচ্ছে যোগাযোগ ব্যবস্থা দুরূহ হওয়ার ফলে মানুষের কম যাতায়াতের কারণে ভোলাগঞ্জের প্রকৃতি এখনও অনেক বেশি অকৃত্রিম; স্বচ্ছ; নির্মল।
সমুদ্র সৈকতে
নির্জনতা মানে সমুদ্রের তুমুল গর্জন
পার্থিব আলোহীন জ্যোৎস্নালোকে ভেসে যাওয়া;
ক্যানভাসে আঁকা কোন বিমূর্ত ছবি
কবিতার পৃথিবীতে নিজেকে খুঁজে পাওয়া।
স্বাধীনতা মানে ডানা মেলা গাঙচিল
দূর দিগন্তে নীল তটরেখা;
সমুদ্রজলের আদুরে স্পর্শ মেখে
নির্জন সৈকতে হেঁটে যাওয়া একা।
গল্প মানে প্রবাল প্রাচীর
জমাট বাঁধা স্মৃতিকথা;
রঙিন স্মৃতির ডুব সাঁতারে
অবাক করা নীরবতা।
রোমাঞ্চকর সন্ধ্যা মানে; সাগরপাড়ে গনগনে
আগুনের পাশে, ঝলসানো সামুদ্রিক মাছের আস্বাদন,
অথবা, মোম আলোয় বাহারি খাবারের সাথে
অর্কিড সুবাসিত প্রিয় আলাপন।
খুব প্রিয় স্মৃতি মানে; রূপার থালার মতো চাঁদ
পূর্ণিমায় ভেসে যাওয়া রূপালী জলরাশি;
হাওয়ায় ওড়ানো এলোচুল; নীল আঁচল
সমুদ্র স্বাক্ষী রেখে; চোখে চোখ রেখে বলা ভালোবাসি।
স্বপ্নময় প্রভাত মানে
আঙুলে আঙুল ছুঁয়ে, না বলা অনেক কথা বলা;
প্রথম সূর্যালোকে নিজেকে নতুন করে চেনা
নতুন অনুভবে শুরু পথ চলা।
(চোখ বন্ধ করে নির্জনতা এবং অপার্থিব সৌন্দর্য কল্পনা করলে আমার সামনে ভেসে ওঠে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে নির্জন রাতে সমুদ্র সৈকতে কাটানো চমৎকার মুহূর্ত। সেন্টমার্টিন দ্বীপে এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎ পৌছায়নি। রাত দশটা’র মধ্যেই রিসোট্ এবং খাওয়ার হোটেলগুলোর জেনারেটর বন্ধ হয়ে যায়। পার্থিব আলোহীন জ্যোৎস্নালোকে ভেসে যায় পৃথিবী। সমুদ্রের তুমুল গর্জন; নির্জন বালুকাবেলা; রূপার থালার মতো ভরা পূর্ণিমার চাঁদের মায়াবী আলোয় রূপালী জলরাশি, এ যেন আক্ষরিক অর্থেই প্রিয় গানের দৃশ্য- “কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে; রাতের নির্জনে”
সমুদ্রপাড়ের সন্ধ্যাগুলোও যথেষ্ট রোমান্টিক। সাগরপাড়ে গনগনে আগুনে ঝলসানো লোভনীয় বাহারি সামুদ্রিক মাছ অথবা বিলাসী হোটেলে মোম আলোয় ( Candle Light) – অর্কিড সুবাসিত আলাপনও যথেষ্ট আকর্ষণীয়।
ডানা মেলা গাঙচিল; বালুকাবেলায়; ঢেউয়ের মেলায় খালি পায়ে হেঁটে যাওয়া; নীল তটরেখা; ভেসে যাওয়া সাম্পান; জমাট বাঁধা প্রবাল প্রাচীর মনে করিয়ে দেয় ফেলে আসা স্মৃতিকথা; ভাবায় বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে। চেনা গণ্ডীর বাইরে এ যেন নিজেকে নতুন করে চেনা; দারুণ উপলব্ধি। নতুন অনুভূতি নিয়ে পথচলা শুরু করা। সমুদ্র তাই আমদের বারবার হাতছানি দেয়; মায়াবী মুগ্ধতায়।
রঙিন ইচ্ছেগুলো
আমার চারপাশের রঙগুলো কোবাল্ট ব্লু, আইভরি ব্ল্যাক বা পয়জন গ্রীনের মতো খুব অচেনা নয়;
আমার চেনা রঙগুলো লাল, নীল, হলুদ আর অনেক অনেক সবুজ;
আমার ইচ্ছেগুলো খুব মাপা নয়, বরং অনেকটা খেয়ালী আর অবুঝ।
আমার আকাশ জানালায় কখনও বন্দী নয়,
অনেক অনেক বড় আর বিশাল সে আকাশ, ভালোবাসা আর স্বপ্ন দিয়ে বোনা;
শঙ্খচিলের নিত্য সেথা থাকে আনাগোনা।
আমার বাগানে নেই কোন বনসাইয়ের দুঃখ,
অশোক শিরিষে মাতামাতি সেথা বিশাল সব বৃক্ষ;
হাওয়াই মিঠাই মিঠেল রোদে প্রজাপতির পাখায়,
ভালোবাসার রঙ লেগে রয় কৃষ্ণচূড়ার শাখায়।
শিমুল তুলো স্বপ্নগুলো উড়ে নিটোল মায়ায়,
সারা বেলার ক্লান্তি জুড়ায় হিজল তমাল ছায়ায়।
শিউলি, বকুল, কাঠ গোলাপের রঙের মাখামাখি,
দোয়েল, শ্যামা, ময়না, টিয়ার অবাক ডাকাডাকি।
আমার নদী অলকানন্দা টলমল তার জল,
অতলান্তিক সেই নদীর যায় না পাওয়া তল;
জোনাক জ্বলা কাশের বন কেঁপে ওঠে অল্প,
শাপলা ফুলের সাথে হয় চাঁদমালাদের গল্প।
হেমন্তের আহ্বানে
হেমন্তের দীর্ঘ রাতে হিম হিম কুয়াশায়
আকাশে যখন জেগে থাকে ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ;
নবান্নের পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধে উদ্বেল বাতাসে
শিশিরের শব্দ, জোনাকের আলোয় হোক ভালোবাসা অবাধ।।
ডাহুক ডাকা শাপলা বিল, সাদা পাল, ছোট ডিঙি, দূরন্ত কৈশোর
পদ্মবনে মুগ্ধ মায়ার হাতছানি; মেঠো পথে রাখালের সুর;
পাখির নীড়, টুপটাপ শিশির, কুয়াশার মায়াবী আবরণ
কাশের বন, উদাসী মন, বাংলার প্রকৃতিতে হেমন্তের আগমন।।
পানকৌড়ির ডুব সাঁতারের মতো কৃষানীর চোখে খুশির ঝিলিক;
রাখালের বাঁশি, কৃষকের হাসি, শিউলির স্নিগ্ধ অনুভব
নতুন ধানের খই, পিঠে পুলির আয়োজন, বাংলার ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসব।।
(বাংলার প্রকৃতিতে হেমন্ত এক অসাধারণ ঋতু। আক্ষরিক অর্থেই প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর এক সময়। শরতের নীল আকাশে থাকে সাদা মেঘের ছড়াছড়ি আর হেমন্তের আকাশ থাকে ঝকঝকে নীল। হেমন্তে শিউলিগুলোও পূর্ণ বিকশিত হয়ে আকারে আরও বড় হয়ে উঠে। কৃষক; কৃষানীর হাসি, ডাহুক ডাকা শাপলা-পদ্ম ফোটা বিলে দূরন্ত কিশোরের সাদা পালের ছোট ডিঙি নিয়ে ছুটে চলা, পানকৌড়ির ডুব সাঁতার, নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধ, কিশোরীর চপলতা, চমৎকার আবহাওয়া, উপাদেয় পিঠে পুলির সমারোহে হেমন্ত ঋতু আবহমান বাংলার স্বচ্ছলতা ও প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর এক ঋতু। নতুন ধানের খড় নিয়ে নতুন অতিথির আগমনে নতুন নীড় গড়ার স্বপ্নে বিভোর থাকে পক্ষীকূলও।
হেমন্তের রাতও আসে অপার্থিব সৌন্দর্য নিয়ে। কুয়াশার মায়াবী আবরণে ক্ষয়িষ্ণু চাঁদের আলোয় এক অসাধারণ সৌন্দর্য ফুটে উঠে। শিশিরের টুপটাপ শব্দ; জোনাকের আলো আর পূর্ণ প্রস্ফুটিত শিউলির সৌরভে হেমন্তের রাতগুলো অপূর্ব মায়াবী হয়ে উঠে।
কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার বাংলা সাহিত্যে অন্যসব ঋতু নিয়ে তুমুল মাতামাতি হলেও একমাত্র প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ ছাড়া সব উল্লেখযোগ্য কবিই হেমন্ত ঋতুর বর্ণনায় আশ্চর্যরকম নীরব। এই ব্যাপারটি আমাকে প্রচন্ড আলোড়িত করে। হৃদয়কে নাড়া দেয়।