বড়লেখা প্রতিনিধি॥ শনিবার রাইত (রাত) তাকি (থেকে) দুধ খাওয়া বন (বন্ধ) করায় সকালে আসপাতালে (হাসপাতাল) লইয়া গেলে ডাক্তর সাব জলদি (দ্রুত) ওসমানী আসপাতালো লইয়া যাওয়ার কথা কইন। বাচ্চার বাপ পট করি (তাড়াতাড়ি) এম্বুলেন্স চাইয়া রওয়া দেইন, কিন্তু পথে দুই জাগায় পরিবহন শ্রমিকরা গাড়ি আটকায়। মিনতি করায় ই দুই জাগা (স্থান) তাকি ছাড়া পাইলেও তিন নম্বর জাগা চান্দগ্রাম বাজারে ২০-২৫ জন এমনভাবে আটকায় কোনভাবেই ছাড়ছে না। আমার কোল ৭ দিনর পুড়ির (মেয়ের) ছরকাত (শেষ নিঃশ্বাস) অর বউত কলে (বিভিন্নভাবে) তারারে কইলাম। তারা কয় আমি তামশা করিয়ার। ডাইভাররে (ড্রাইভার) নামাইয়া মারধর করে।’
২৮ অক্টোবর রোববার বড়লেখার চান্দগ্রাম বাজারে ধর্মঘটের নামে পরিবহন শ্রমিকরা অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখায় বিনা চিকিৎসায় নিহত কন্যা শিশুর মা ছায়রা বেগম সোমবার দুপুরে নবজাতক মেয়ের মৃত্যুর নির্মম ও হৃদয়বিদারক কাহিনী এ প্রতিবেদকের কাছে এভাবেই তুলে ধরেন। এসময় তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।
এদিকে বিনা চিকিৎসায় মাত্র ৭ দিনের শিশু কন্যার মৃত্যুর ২৪ ঘন্টা অতিবাহিত হলেও রহস্যজনক কারণে স্থানীয় সামাজিক সংগঠন ও মানবাধিকার সংস্থা নিশ্চুপ রয়েছে। ঘটনার নিন্দা, প্রতিবাদ ও সুষ্ট বিচারের দাবীতে তাদের দৃশ্যমান কোন কর্মসুচি লক্ষ্য করা যায়নি। তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্মম ঘটনাটি ভাইরাল হওয়ায় সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
২৯ অক্টোবর সোমবার সরেজমিনে গেলে নিহত শিশুর বাবা কুটন মিয়া জানান, স্ত্রীর শরীর খারাপের খবর পেয়ে ২১ অক্টোবর তিনি দেশে ফিরেন। পরদিন স্ত্রীকে সিলেটের নর্থইস্ট হাপতালে ভর্তি করেন এবং এদিন সকাল সাড়ে দশটায় শিশু কন্যার নরমাল ডেলিভারী হয়। ২৪ অক্টোবর স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। শিশু কন্যার নাম খাদিজা আক্তার রাখার প্লেন করেও রাখেন। কিন্তু তা প্রকাশ করেননি। ভেবেছিলেন আকিকার দিন প্রকাশ করবেন। কিন্ত মেয়ের নাম প্রকাশের আগেই সে চলে গেল না ফেরার দেশে। কুটন মিয়া অভিযোগ করেন বিয়ানীবাজার হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে ফেরার পথেও পরিবহণ শ্রমিকরা দাসেরবাজারে অ্যাম্বুলেন্স আটকায় এবং চালককে মারধর করে। এতে বাড়ি ফিরতে অন্তত ৩০ মিনিট বিলম্ব হয়। সন্ধ্যা ৫টা ২০ মিনিটে গ্রামের সার্বজনিন গোরস্থান মাঠে জানাজা শেষে লাশ দাফন করেন। জানাজায় ইমামতি করেন শিশু কন্যার চাচা হাফেজ কাওছার আহমদ। নিহত শিশু খাদিজা আক্তারের বাবা কুটন মিয়া তার মেয়ের মৃত্যুর জন্য দায়ীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দাবী করে বলেন, যে কোন আন্দোলন-সংগ্রাম আর ধর্মঘটের নামে যেন বিনা চিকিৎসায় আর কোন বাবা-মায়ের সন্তানকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া না হয়। অ্যাম্বুলেন্স চালক সিপন আহমদ জানান, প্রথমে তিনি বড়লেখার মহদিকোনায় পরিবহণ শ্রমিকদের বাধার সম্মুখিন হন। এখানে প্রায় আধঘন্টা আটকানোর পর ছেড়ে দেয়। পরে দাসেরবাজারে আরো ২০-২৫ মিনিট এবং চান্দগ্রাম বাজারে প্রায় দেড়ঘন্টা আটকে রেখে তাকে মারধর করে। শিশুর মা-বাবা হাতে পায়ে ধরেও তাদের মন গলাতে পারেননি। বাচ্চার মৃত্যুর পর তারা গাড়ি ছেড়ে দেয়। এদিকে অজমির গ্রামের দুবাই প্রবাসী কুটন মিয়ার ৭দিনের নবজাতক কন্যা শিশুর মৃত্যুতে শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের হুইপ শাহাব উদ্দিন এমপি। শোক বিবৃতিতে, তিনি উক্ত হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক ঘটনায় যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন। হুইপের নির্দেশে সোমবার সকালে উপজেলা আ’লীগের সম্পাদক আনোয়ার উদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক ও পৌর মেয়র আবুল ইমাম মোহাম্মদ কামরান চৌধুরীসহ উপজেলা আ’লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ নিহত শিশুর শোকাহত পরিবারকে সান্তনা এবং সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এছাড়া নিহত শিশুর বাড়িতে গিয়ে আইনগত সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন থানার ওসি (তদন্ত) জসিম উদ্দিন।বড়লেখা থানার ওসি মো. ইয়াছিনুল হক অত্যন্ত অমানবিক এঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে সোমবার সন্ধ্যা পাঁচটায় জানান, নিহত শিশুর বাবা-মায়ের সাথে যোগাযোগ রয়েছে। তারা মামলা দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। মামলা পর যথাযথ আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।