সাইফুল ইসলাম
কমলা চাষে কৃষি বিভাগের সহযোগিতায় এবার কমলার ভালো ফলন হয়েছে মৌলভীবাজারের জুড়ি উপজেলায়। এদিকে বানরের আক্রমন ও অতিরিক্ত বৃষ্টির কারনে ঝড়ে পড়ছে কাঁচা কমলা। মৌসুমের শুরুতেই ভারতীয় কমলা বাজারে চলে আসায় বাধ্য হয়ে মৌসুমের আগে কমলা বিক্রি করে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন চাষীরা।
মৌলভীবাজার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসূত্র জানায়, এবছর জেলার জুড়ি, কুলাউড়া, বড়লেখাসহ বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ২৫০ একর জমিতে কমলার চাষ হয়েছে। এরমধ্যে জুড়ী উপজেলায় ১৫০, বড়লেখা ৭৫ একর এবং কুলাউড়ামহ অন্যান্য উপজেলায় বিচ্ছিন্নভাবে ২৫ একর জমিতে কমলার চাষ হয়েছে। সারা জেলায় বড় ১৩০টি বাগানের পাশাপাশি রয়েছে বেশ কয়েকটি ছোট কমলা বাগান। কমলাচাষী রয়েছেন ৪৫২ জন। গত বছর প্রতি হেক্টরে কমলা উৎপাদন হয়েছিল তিন থেকে সাড়ে তিন টন। এ বছর উৎপাদন হয়েছে চার থেকে সাড়ে চার টন।
জুড়ি উপজেলার গোয়ালবাড়ি ইউনিয়নের রূপাছড়া ও লালছড়ার পাহাড়ি এলাকায় কমলা বাগান চাষিরা জানান, গাছে গাছে সবুজ সোনালি ফল ঝুলে আছে। গাছভর্তি ফলন না হয়েও কোন গাছই খালি নাই কমবেশি সকল গাছেই রয়েছে ফল। বাগানে বাগানে চলছে কমলা পাড়া, বাছাই ও কমলা ভর্তি ঝুড়ি তৈরি নিয়ে ব্যস্ত চাষী ও শ্রমিকরা। সেখান থেকে পাইকাররা কমলা কিনে ছোট ট্রাকে করে সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যাচ্ছেন। এলাকার প্রায় প্রতিটি টিলাতেই ছোট বড় কমলার বাগান রয়েছে। বাড়ির মধ্যে ঘরের পাশেও আছে কমলার গাছ।
লালছড়া গ্রামের কমলাচাষী রুবেল মিয়া ও মুর্শেদ মিয়া জানান, প্রায় ১ হাজার কমলা গাছ রয়েছে। এবছর প্রায় আড়াই লাখ টাকার কমলা বিক্রি করেছেন। চার থেকে পাঁচ লাখ টাকার কমলা বিক্রির আশা করছেন। তবে ভারতীয় কমলা আমদানীর কারনে সঠিক মুল্য পাচ্ছে না বলে। ভারতীয় কমলা আমদানী বন্ধ করার দাবী করেন তিনি।
রূপাছড়ার কমলাচাষী ফারুক মিয়া ও মো. বাবুল মিয়া জানান, ‘তাদের বাগানে শ’দুয়েক গাছ আছে। এরমধ্যে অধিকাংশ গাছে কমলা এসেছে। কিন্তু প্রতিদিন গাছ থেকে কমলা ঝরে পড়ছে। এ ছাড়া বানরের কারনে কমলা ঝরে পড়ে।’
রূপাছড়ার ফখর উদ্দিন জানান, ‘একটা গাছে ৫০ থেকে ১ হাজার পর্যন্ত কমলা ধরে। কিন্তু ৪০ শতাংশ কমলা ঝরে পড়ছে। এ কারণে চাষীরা আগাম বিক্রি করে ফেলছেন। কমলা বড় হওয়ার আর সময় পায় না। মিষ্টি হতে পারে না। যার কারনে কমদামে বিক্রি করতে হচ্ছে’
লালছড়ার মো. মন্তু মিয়া বলেন, ‘ফলন ভালো হয়েছে কিন্তু ঝরে পড়ায় তারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন। আগে কমলা চাষের একটি প্রকল্প ছিল। ২০০৮ থেকে সেই প্রকল্পটি বন্ধ রয়েছে। প্রকল্পের সময় প্রশিক্ষণ ও তাৎক্ষণিক পরামর্শে কমলাচাষীরা উপকৃত হয়েছেন। পূণরায় সেই প্রকল্প চালুর দাবি জানান তিনি।’
লালছড়ার খালেদ আহমদ জানান, ‘অনেক চাষীই অভাবী। এরা অগ্রিম বিক্রি করে ফেলে। এরজন্য সঠিক দাম পায় না।’
কমলাচাষীরা জানিয়েছেন, তারা স্থানীয়ভাবে পাইকারের কাছে ১০০ কমলা ২০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করেছেন।
জুড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দেবল সরকার বলেন, ‘এখানে নাগপুরী, দার্জিলিং ও খাসি এই তিনজাতের মধ্যে খাসি জাতেরই বেশি চাষ হয়ে থাকে। ফল পাকার সময়েই গান্ধিপোকা আক্রমন করে। আমরা নিয়মিত পরামর্শ দিই চাষীদের।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার কার্যালয়ের তথ্যমতে, কমলার উৎপাদন নিশ্চিত করতে বর্ষার পরপর কমলা গাছের ডাল ছাঁটাই এবং খরার সময় সেচ দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে পৌষ থেকে ফাল্গুন মাসে সেচ দিলে রোগ ও পোকার আক্রমন কম হবে।
অন্যদিকে কমলা গাছে কার্টাপ গ্রুপের কীটনাশক ব্যবহার করলে গান্ধী, লিপমাইনরসহ অন্যান্য পোকা দমন সম্ভব। লেবু জাতীয় ফলে আগা মরা (ডাই বেক) ও গামোসিস (গাছ থেকে আঠার মতো কষ ঝরা) ধরনের রোগ দমনে কপার অক্সিক্লোরাইড ও হেক্সাকোনাজল গ্রুপের ছত্রাকনাশক ১৫ দিন পর পর তিন বার ¯েপ্র করলে এই জাতীয় রোগ দমন করা যায়।
এই ব্যাপারে জুড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষ্ণ রায় জানান, কমলা বাগান গুলোতে রোগ বালাইসহ নানা সমস্যায় ভোগান্তি নিরসনের ফলে বাম্পার ফলন হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজার কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. শাহজাহান বলেন, ‘নিয়মিত সেচ, সার ও কীটনাশক প্রয়োগের অভাবে কমলা ঝরে পড়ছে। গাছে যে পরিমাণ কমলা আসে সঠিক ব্যবস্থাপনা না থাকায় গাছ তা ধরে রাখতে পারে না। নিয়মিত কীটনাশক ¯েপ্র করলে গান্ধিপোকা দমন সম্ভব। তাছাড়া লেবু জাতীয় গাছে আগা মরা রোগ হয়ে থাকে। এটাতেও ছত্রাকনাশক ¯েপ্র করলে সুফল পাওয়া যায়। কৃষি বিভাগের মাঠকর্মীসহ উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা চাষীদের এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। সঠিক পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনা থাকলে এ অঞ্চলে কমলার উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পাবে। ভারতীয় কমলা আমদানীর কারনে দেশী কমলা বাজার হারাচ্ছে তা স্বীকার করে জেলা কৃষি কর্মকতা জানান,কমলা চাষ উন্নয়ন প্রকল্প চালু হলে মৌলভীবাজার অঞ্চলের কমলা ঐতিহ্য ফিরে আসবে
দেশী কমলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে কমলা চাষ উন্নয়ন প্রকল্প চালুসহ কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সহযোগীতা অব্যাহত রাখার এমনটাই দাবী কমলা চাষীদের।