বিশেষ প্রতিনিধি:
উপমহাদেশের রাজনীতি সাধারণত পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। একজনের পরিবর্তন হলে অন্যজন হাল ধরেন। বাংলাদেশের রাজনীতিও এর ব্যতিক্রম নয়। এখানকার রাজনীতি অনেকটাই পরিবার-আত্মীয়দের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, একই পরিবারের সদস্য বা আত্মীয় ভিন্ন ভিন্ন দলের রাজনীতিতেও রয়েছেন।
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দেখা যাচ্ছে, এক পরিবার থেকে একাধিক ব্যক্তিকে নির্বাচনে প্রার্থী হতে। শুধু পরিবারের সদস্য নন, সেই সাথে শীর্ষ নেতৃত্বের আত্মীয়-স্বজনরাও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
পরিবারগুলোর মধ্যে বিশেষ করে- জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিবার, নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবার, টাঙ্গাইলের সিদ্দিকী পরিবারসহ আরো অনেক পরিবার রয়েছে।
তবে ১৯৯১ সাল থেকে দেশে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পরিবারের একাধিক ব্যক্তি অংশ নিলেও এবারের অবস্থা পুরাটাই আলাদা। কারণ জিয়া পরিবারের তেমন কেউ নেই আসন্ন নির্বাচনে।
সংসদীয় ৩০০টি আসনে নিচের ৬টি পরিবার (রক্ত ও বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ) মোট ৩৩টি আসনে প্রার্থী হয়েছেন। নির্বাচনে এদের সবাই বিজয় হলে ১০% শতাংশ সংসদীয় আসন হবে তাদের দখলে।
১৯ আসনে প্রার্থী বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়-পরিজন:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোপালগঞ্জ-৩ ও রংপুর-৬ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়বেন।
নির্বাচনে লড়বেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চাচাত ভাই শেখ আবু নাসেরের ছেলে সংসদ সদস্য শেখ হেলাল উদ্দীন এবং তার ছেলে শেখ সারহান নাসের তন্ময়। শেখ হেলাল উদ্দীন এবারও বাগেরহাট-১ থেকে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন। বাগেরহাট-২ আসন থেকে নির্বাচন করবেন তন্ময়। আর তার মেঝ চাচা শেখ সালাউদ্দিন জুয়েল খুলনা-২ আসনের মনোনয়ন পেয়েছেন।
আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ বরিশাল-১ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন করবেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই। আবার হাসনাত আবদুল্লাহর ছোট বোনের দেবর হলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। তিনি কুষ্টিয়া-৩ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আরেক ফুফাতো ভাই হলেন মাদারীপুরের সাবেক এমপি প্রয়াত ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী। ইলিয়াস চৌধুরীর বড় ছেলে নূর-ই-আলম চৌধুরী (লিটন চৌধুরী) আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক হুইপ ও এবারের নির্বাচনে মাদারীপুর-১ আসনের প্রার্থী।
শেখ ফজলুল হক মনির ছেলে শেখ ফজলে নূর তাপস। শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাপসের নানা এবং শেখ হাসিনা তার খালা। তিনি ঢাকা-১০ আসনে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করছেন।
শেখ ফজলুল করিম সেলিম (শেখ সেলিম নামে বেশি পরিচিত) হলেন শেখ মুজিবুর রহমানের আরেক ভাগ্নে অর্থাৎ যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শেখ ফজলুল হক মনির ছোট ভাই। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই। গোপালগঞ্জ-২ আসন থেকে নির্বাচন করছেন তিনি।
আর জামালপুর-১ (দেওয়ানগঞ্জ-বকশীগঞ্জ) আসনে মনোনয়ন পেয়েছেন শেখ সেলিমের ভায়রা আবুল কালাম আজাদ।
শেখ হাসিনার প্রয়াত স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার বড় বোনের নাতনি হলেন মাহবুব আরা গিনি। তিনি গাইবান্ধা-২ আসনে (সদর) আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন। একই আসনে বর্তমান এমপি তিনি।
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন ফরিদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের শ্বশুর। আর মোশাররফ হোসেনের মেয়ে-জামাই অর্থাৎ সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ননদের স্বামী অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত মুন্না। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন সিরাজগঞ্জ-২(সদর-কামারখন্দ)আসন থেকে।
অন্যদিকে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত আইভী রহমান হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট বোন শেখ রেহানার খালা শাশুড়ি। সেই হিসেবে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান (আইভী রহমানের স্বামী) হলেন শেখ হাসিনার তালই। আর জিল্লুর রহমান ও আইভী রহমানের সন্তান হলেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। কিশোরগঞ্জ-৬ (ভৈরব-কুলিয়ারচর) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়েছেন পাপন।
সম্পর্কে শেখ হাসিনার ফুফা হলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য ও বর্তমান শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। ঝালকাঠি-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন তিনি। তার স্ত্রী প্রয়াত ফিরোজা হোসেন সম্পর্কে শেখ হাসিনার ফুফু।
জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থের আপন মামা হচ্ছেন শেখ সেলিম। আর বাগেরাটের শেখ হেলাল হচ্ছেন তার শ্বশুর। সেই হিসেবে শেখ হাসিনা হচ্ছেন তার ফুফা শাশুড়ি এবং ভাগ্নেও (শেখ সেলিমের দিক থেকে)।
তিনি নির্বাচন করবেন ভোলা-১ আসন থেকে। অবশ্য পরিবারের স্রোতের বিপরীত দিকে অবস্থান তার। তিনি নির্বাচন করছেন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট থেকে।
শেখ সেলিমের ছেলে বিয়ে করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর মেয়েকে। তিনি (টুকু) দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় সিরাজগঞ্জ-২ আসনে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। তার স্থলে বিএনপির প্রার্থী হয়েছেন তার স্ত্রী অর্থাৎ শেখ সেলিমের বিয়াইন রোমানা মাহমুদ।
শেখ সেলিমের আরেক ছেলে বিয়ে করেছেন আলোচিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরের মেয়েকে। এই মুসা বিন শমসেরের ছেলে ববি হাজ্জাজ এবার গণঐক্য জোট গঠন করে হারিকেন প্রতীক নিয়ে ঢাকা-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন।
দুই আসনে প্রার্থী ওসমান পরিবার:
নারায়ণগঞ্জে রাজনীতির মাঠে ওসমান পরিবার সরব। সব সময় তাদের আধিপত্য ছিল। এবারের নির্বাচনেও নারায়ণগঞ্জ-৪ (ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম ওসমান। আর তার ভাই একেএম সেলিম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৫ (সদর-বন্দর) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে লড়বেন।
৭ আসনে এরশাদ পরিবারের সদস্যরা:
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ঢাকা-১৭ (গুলশান-ক্যান্টনমেন্ট-ভাষানটেক) আসনের জন্য মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। এ ছাড়াও তিনি রংপুর-৩ থেকে নির্বাচন করবেন। তার আপন ভাই গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান। তিনি লালমনিরহাট-৩ আসন থেকে নির্বাচন করবেন।
এরশাদের স্ত্রী ও বর্তমান সংসদের বিরোধীদলীয় প্রধান রওশন এরশাদ ময়মনসিংহ-৪ ও ময়মনসিংহ-৭ আসন থেকে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন।
এরশাদের ভাগনি জামাই ও পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু রংপুর-২ (বদরগঞ্জ-তারাগঞ্জ) আসন থেকে নির্বাচন করছেন।
৩ আসনে সিদ্দিকী পরিবারের আধিপত্য:
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবারো আলোচনায় রয়েছে টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী সিদ্দিকী পরিবার। এ পরিবারের দুই সন্তান জাতীয় রাজনীতির হেভিওয়েট প্রার্থী। তারা হলেন- আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী আর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকী (বীরউত্তম)।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী টাঙ্গাইল-৪ ও ৮ আসনে মনোনয়ন নিয়েছিলে ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে। কিন্তু ঋণ খেলাপির কারণে তার উভয় মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে। অবশ্য টাঙ্গাইল-৮ আসনে তার মেয়ে ব্যারিস্টার কুঁড়ি সিদ্দিকীর ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র বৈধ হয়েছে।
এ ছাড়া টাঙ্গাইল-৪ আসনে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রার্থী কাদের সিদ্দিকীর ছোট ভাই আজাদ সিদ্দিকীর মনোনয়নপত্র বৈধ হয়েছে।
অন্যদিকে, কাদের সিদ্দিকীর বড় ভাই আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী টাঙ্গাইল-৪ আসনে এবং ছোট ভাই মুরাদ সিদ্দিকী টাঙ্গাইল-৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন। তাদের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।
জিয়া পরিবারের প্রার্থী একজন
১৯৯১ সাল থেকে প্রতিবার নির্বাচনে খালেদা জিয়া ও জিয়া পরিবারের অন্য সদস্যরা ভোটে অংশ নিয়েছেন। এমনকি ভোটে প্রার্থী না হলেও বিভিন্ন সময় খালেদা জিয়া ও জিয়াউর রহমানের পরিবারের সদস্যরা ভোটের মাঠে ছিলেন। কিন্তু এবার মাঠে নেই তেমন কেউ।
চূড়ান্ত মনোনয়ন তালিকায় দেখা গেছে, জিয়া পরিবার থেকে শুধু একজনই রয়েছেন বিএনপির প্রার্থী তালিকায়। তিনি হলেন নীলফামারী-১ আসনে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী রফিকুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি খালেদা জিয়ার ছোট বোন সেলিনা ইসলাম বিউটির স্বামী। তার মনোনয়ন বৈধ ঘোষণা করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা।
একটি আসনে বি. চৌধুরীর পরিবার:
সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরী যুক্তফ্রন্ট গঠন করে এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট থেকে নির্বাচন করছেন। তবে বি. চৌধুরী কোনো মনোনয়ন নেননি। তার ছেলে দলটির যুগ্ম-মহাসচিব ও যুক্তফ্রন্টের মুখপাত্র মাহী বি. চৌধুরী মুন্সীগঞ্জ-১ ও ঢাকা-১৭ আসন থেকে মনোনয়ন নিয়েছেন।
জানা গেছে, মহাজোট থেকে তাকে মুন্সীগঞ্জ-১ আসন থেকে মনোনয়ন দেওয়া হবে, সেক্ষেত্রে তিনি ঢাকা-১৭ থেকে মানোনয়ন প্রত্যাহার করে নিবেন।