‘পাঠশালা’, তাজুল মোহাম্মদ ও আমাদের ছোট্ট অদিতি

ফারহানা আজিম শিউলিঃ

‘দেখেন, আমি জীবনে বহু মানুষের সঙ্গে মিশেছি। বহু অনুষ্ঠানে গেছি। আমাকে নিয়েও আয়োজন হয়েছে বেশ কিছু। আমি কিন্তু মানুষের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বুঝি। আসরে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি মানুষ অসীম নীরবতায়, অখণ্ড মনোযোগে, শ্রদ্ধা নিয়ে বইগুলো নিয়ে পুরোটা আলোচনা শুনেছেন, শুনেছেন প্রতিটা শব্দ, হৃদয়ে নিয়েছেন, গ্রহণ করেছেন প্রতিটা তথ্য। একটু নড়াচড়া পর্যন্ত করেননি কেউ। এমন অভিজ্ঞতা অনন্য, এমন অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম।’

‘পাঠশালা’র আসর সম্পর্কে কথাগুলো বলেন গত ১৫ ডিসেম্বর টরন্টোর এগ্লিন্টন স্কয়ার লাইব্রেরীতে দুপুর ২টা থেকে শুরু হওয়া ‘পাঠশালা’র সর্বশেষ আসরের আলোচক তাজুল মোহাম্মদ।

কোনো পরিকল্পনা করে তাজুল মোহাম্মদ ‘গবেষণা’  করেননি। সিলেটের কুলাউড়ায় ক্ষেতমজুর সমিতি করতেন। তাঁর নেতৃত্বে বালাগঞ্জ, চরখাই, এওলারটুকে সফল ক্ষেতমজুর আন্দোলন হয়েছে। বামপন্থী রাজনীতির সুবাদে ঘুরে বেরিয়েছেন নানা জায়গায়। পড়াশোনা, চাকরিজীবন সিলেটেই। তো, যেখানেই যেতেন, শুনতে পেতেন ৭১ এর পাকবাহিনীর নির্যাতনের কাহিনী, বর্বরতার কাহিনী, দেখতে পেতেন পাকবাহিনীর অত্যাচারের ক্ষত শরীরে বয়ে বেড়ানো মানুষদের, দেখতে পেতেন অসংখ্য বধ্যভূমি। তাঁর মনে হয়, সিলেট যেন বধ্যভূমিরই অঞ্চল। তখন থেকেই অর্থাৎ ৮০র দশকের শুরু থেকে, নিজের বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে শুরু করেন বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের গণহত্যার তথ্য সংগ্রহ। এভাবে ৮১ থেকে ৯৪, আবার ওয়ার ক্রাইমস ফাইল টিমের হয়ে মধ্য ৯৪ থেকে মধ্য ৯৫ – ১৪টা বছর – তিনি বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল চষে বেরিয়েছেন। আর এই কাজ করতে গিয়ে তাঁকে পৈতৃক জানটা বাঁচাতে দেশ ছাড়তে হয় ১৯৯৫ সালে।

৮০র দশকের তথ্য সংগ্রহ আর এখনকার তথ্য সংগ্রহ এক কথা নয়। কোন কোন জায়গায় ৩০ মাইল পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেছেন, না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, নিজের জানটা হাতে নিয়ে, সাথে রাষ্ট্রযন্ত্রের চরম বৈরিতা। গণহত্যার তথ্য সংগ্রহে একদিকে যেমন তাঁর চোখের জল বইতো, আবার জল মুছেই তাকে ভাবতে হয়েছে, রাতে মাথা গুঁজবেন কই, খাবেন কী, নিরাপদে সেদিনের রাতটা পার করতে পারবেন তো?

এই চারণ লেখককে পাঠশালার আসরে বক্তা হিসেবে হাজির করতে রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছে। প্রাথমিক যোগাযোগের সময় বলেন – ‘দেখেন, আমি অতি ক্ষুদ্র মানুষ, তার চেয়েও ক্ষুদ্র আমার কাজ। আর আমি একেবারেই বক্তা নই। আমার কোনো একটা বই নিয়ে আপনি বরং আলোচনাটা করে দেন। আমাকে ক্ষমা করেন।’…  যাই হোক শেষ পর্যন্ত একটু ভিন্ন ফরম্যাটে সাক্ষাৎকারভিত্তিক আলাপচারিতায় যোগ দেন তিনি। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ৪৬ টি বই নিয়েই কথা হয়।

অদিতি জহির। আমাদের অদিতি। আমি বলি, ছোট্ট অদিতি। ছোট বেলায় তার মা তাকে তরকারি নাড়তে দিয়ে কয়েক মিনিটের জন্য দূরে গিয়েছিলেন। ফিরে দেখেন, মেয়ের একহাতে একটা বই, মন দিয়ে পড়ছে, আর তরকারির পাত্র থেকে দূরে অন্য একটা জায়গায় চামচ দিয়ে নাড়াচাড়া করছে। খুব পড়ুয়া সে শৈশব থেকে। কানাডায় বেড়ে ওঠা অদিতি বাংলা বই পড়ে, মুক্তিযুদ্ধের কথা জানে, আরো জানতে চায়। ‘পাঠশালা’য় অদিতি নিয়মিত। ভিডিও ধারণের দায়িত্বটাও সে করে। একেবারে সামনে বসে অসীম মনোযোগে শোনে প্রতিটি পর্বের আলোচনা। এবারে তাজুল মোহাম্মদের পর্ব শেষে মায়ের ব্যাগ খালি করে তাজুল ভাইয়ের ৯ টা বই কিনে নিয়ে বাড়ি গেছে। অদিতির মা পরে আমাকে বলেছেন, ‘থাক্। মেয়েটার তো শুধু একটাই চাওয়া – বই, আর কিছু না।’ অদিতি আসর শেষে আমাকে জানায় –

‘অনেক উপভোগ করেছি আন্টি। অনেক ভাল লেগেছে। যে বইগুলো সেদিন এনেছি, সেগুলো শেষ করার লোভ সামলাতে পারছি না।’

তাজুল মোহাম্মদের অডিয়েন্সের ব্যাপারে অতি মূল্যবান পর্যবেক্ষণ আর ছোট্ট অদিতির আসরে এসে আনন্দ পাওয়া – এই ছোট ছোট অনুভূতিগুলোই ‘পাঠশালা’র সম্পদ হয়ে থাক। ‘পাঠশালা’ সামনের পথ হাঁটতে চায় এই ভালবাসা-ভাললাগাগুলোকে সাথে নিয়ে

ছবিতে – মাঝে অফ হোয়াইট শার্ট পরিহিত তাজুল মোহাম্মদ, সামনে বেইজ কালার পোশাকে অদিতি, আর বাদবাকি আমরা সবাই, তাজুল ভাইয়ের ভাষ্যে ‘সেন্সিবল’ অডিয়েন্স।

 

শেয়ার করুন