মৌলভীবাজার ৯৩টি চা বাগানের শ্রমিকরা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে!

 

সাইফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউন /ঢাকা ট্রিবিউন-মৌলভীবাজার
মৌলভীবাজার জেলায় ৯৩টি চা বাগানে নারী চা শ্রমিকরা যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। যেমন চা বাগানে ও বাড়িতে স্যানেটারী ল্যাট্রিন ব্যবস্থা না থাকায় চা বাগানে খোলা জায়গায় মল ত্যাগ করতে হয়। এতে প্রভাব পড়ে গর্ভবতী ও প্রসূতি চা শ্রমিক নারীদের।
২২ডিসেম্বর শনিবার দুপুরে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাতগাঁও ইউনিয়নের আমরাইল চা বাগান এলাকায় সরজমিনে গর্ভবতী ও প্রসূতি নারীদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা যায়।
এছাড়া যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের ব্যাপারে চা বাগান গুলোতে মোটেই গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না। যার ফলে প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবে নারী চা শ্রমিকরা অনেক বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।
যেমন, সস্তান জন্মদানের প্রক্রিয়ার সঙ্গে নারী ওতপ্রোতভাবে দীর্ঘ সময় ধরে জড়িত থাকেন। নারীর গর্ভে ভ্রূণ থেকে একটি শিশু বেড়ে ওঠে এবং জননপথ দিয়ে বেরিয়ে এসে পৃথিবীর আলো দেখে। জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ খেয়েই তাকে জীবনধারণ করতে হয়।
যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যের একটি বড় অধ্যায় হচ্ছে বিয়ে। চা শ্রমিকের বেলায় বাবা-মায়েরা মেয়েদের দ্রুত বিয়ে দেয়াটাই ভাল বলে মনে করেন। বিয়ের পর অপুষ্ট অল্পবয়সী মেয়েটিকে প্রমাণ করতে হয় সে বন্ধ্যা নয়। আর ১৫/১৬ বছরে অপুষ্ট শরীরে সন্তানধারণের কারণে তারা গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন জটিলতায় পড়ে, এমনকি মারাও যায়।
অন্যদিকে‘চা বাগানের নারী শ্রমিকরা মাসিকের সময় স্যানেটারী ন্যাপকিন ব্যবহার করতে পারছে না। তারা স্যানেটারী ন্যাপকিনের পরিবর্তে কাপড় ব্যবহার করে। যদিও সেসব কাপড় পরিস্কার না বলে জানা গেছে। এমনকি মাসিকের কাপড় রোধে শুকাতে গিয়ে নানা রোগে সমস্যা হতে হচ্ছে তাদের। চা বাগানে যদি স্যানেটারী ন্যাপকিন বিনামূল্যে চালু বিষয়টি চা বাগান মালিক ও চা সংশ্লিষ্টরা বিবেচনা করা উচিত মনে করেন স্কুল পড়–য়া হুগলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের কিশোরী শেফালী দাস।’

সাতগাঁও চা বাগানে কাঁঠালটিলা লাইনের রিনা রিকিয়ান (২৬) এর সাথে কথা হয়। ৬ বছর আগে কার্তিক রিকিয়ান সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তার ঘরে শিউলী রিকিয়াশন নামে কণ্যা শিশু জন্ম নেয়। বর্তমানে শিউলীর বয়স আড়াই বছর।
আবার ১১দিন আগে তার ঘরে পুত্র শিশু জন্ম নেয়। দাই এর মাধ্যমে নরমাল ডেলিভারী হয়েছে তার নিজ বসতবাড়ীতে। পরিবারের মধ্যে স্বামী ও স্ত্রী রোজগারী করেন। অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে রিনা ১০২ টাকা মজুরীতে চা পাতি উত্তোলনের কাজ করেন।
খাবার দাবার ব্যাপারে তিনি বলেন,শাক-সবজি, করলা বরবটি খাইছি। মাঝে মধ্যে মাছ ও মাংস খাইছি। সব সময় তো খাওয়া সম্ভব হয়নি। যেসব নারী চা শ্রমিক গর্ভবতী হয়েছেন তাদের গর্ভাবস্থায় সেবা গ্রহণ বিষয়ক জ্ঞান সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তারা জানান, গর্ভাবস্থায় কমপক্ষে চার বার হাসপাতাল ও কমিউনিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে চেকআপের কথা জানান।

আরেক গর্ভবতী খোকন দাসের স্ত্রী শুকুর মণি দাস (১৯)। সে আমরাইল চা বাগানের গটিবাড়ী লাইনের বাসিন্দা। শুকুর মণি তার শাশুড়ী নির্মলা দাস (৬০) হাতের হাড় ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে বদলী অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে ৪ বছর ধরে কাজ করছেন। শুকুর মণি ৭ মাসে গর্ভবতী। ২০১৪ সালে তার বিয়ে হয়। তার বাড়ী সিলেটের দলদলি চা বাগানে। সে সিলেট কাজী জালাল উদ্দিন বহুমূখী বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী ছিল। তার বাবার সংসার অভাব অনটন থাকায় তাকে বিয়ে দেয় শ্রীমঙ্গলের আমরাইল ছড়া চা বাগানে।
শুকুর মণির ১০.৯.২০১৮ইং তারিখে চা বাগানে মাও শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য বই সুত্রে জানা যায়, তার কর্মস্থলের দূরত্ব ৩ কিলোমিটার। তিনি পায়ে হেটে কাজে যান । সময় লাগে ১.২০মিনিট। তার রুজিতে পরিবারের চার সদস্য সংসার ভরণ পোষণ চলছে। তিনি দুইবার হাসপাতালে ও দুই বার কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা নিয়েছেন।
স্যানেটিশনের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চা বাগানে ভেতরে খোলা মাঠে মল ত্যাগ করেন। সেখানে পানির কোন সুব্যবস্থা নেই। বাড়িতেও তার কোন স্যানেটারী ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা নেই। খাবারের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবজি খাই,তবে সময় মাছ মাংস ক্ষেতে পারি না।
ওই লাইনের বাসিন্দা আরেক গর্ভবর্তী ইসুরী দাস (১৮),তার স্বামী আপন দাস,তিনি একজন রাবার বাগানের শ্রমিক। ইসুরী দাস ৮ মাসের গর্ভবতী। তারই একই অবস্থা। তবে তার বাগানে কোন কাজ না থাকায় তিনি বাড়িতে থাকেন। রীতা দাস (১৮), তার স্বামী তপন দাস। সে তিন মাসের গর্ভবতী। একই অবস্থা গর্ভবর্তী স্বপ্না দাস (২৫)। তবে তাদের মধ্যে কেউ গর্ভকালীন ভাতা পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাম ভোজন কেরী বলেন,‘ চা শ্রমিকরা সঠিক হিসাব রাখতে পারে না। বিশেষ গর্ভবতী নারীরা। সঠিক সময় ছুটি যেতে পারে না। তবে এটা বড় ধরণের সমস্যা । অনেকে মাতৃকালীন ছুটি নিছে তিন মাসের । কিন্তু তিনমাস অতিক্রিম করার পর দেখা গেছে তার তার প্রসব হয়নি।’
চা শ্রমিকদের আইন নিয়ে তিনি বলেন, একটা রাষ্ট্র আইন করবে তার নাগরিকের কল্যাণের জন্য। কাউকে বঞ্চিত করার জন্য কোন আইন হইতে পারে না। চা শ্রমিকদের বড় ধরণের আইন হয়নি। আমরা উপেক্ষিত ন্যাশনাল পলেসির কারণে। এ জন্য নতুন আইন প্রণয়নের পাশাপাশি শ্রম আইন আরো শক্তিশালী করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।’
শ্রীমঙ্গল উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জয়নাল আবেদিন টিটু বলেন, ‘চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ৬ হাজার ১৬২ জন নারীর সুস্থ ও নিরাপদভাবে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। এর মধ্যে ১ হাজার ৪২১ জন নারী ছিলেন চা শ্রমিক। এই সময়ে গর্ভবতী নারীর মৃত্যু সংখ্যা ছিল ১১ জন, আর কেবল চা বাগান এলাকায় মারা গেছেন ৭ জন নারী।’ তিনি আরও বলেন,৯টি চা বাগানে ৩১টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। তাদের কার্যক্রম আরো বাড়বে। যারা গর্ভবতী নারী কমিউনিটি ক্লিনিকে আসবে,তারা স্বাস্থ্য পরামর্শ গ্রহণ করবে। আর যারা আসবে না তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্য পরিদের্শিকা পরামর্শ দিবেন। জরায়ু ক্যান্সার পরীক্ষার জন্য শ্রীমঙ্গল হসপিটালে সপ্তাহে ৬দিন বায়ো-চেষ্ট করা করা হবে।

বি:দ্র: শনিবার (২২ ডিসেম্বর) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্তু শ্রীমঙ্গল শহরের উত্তরসুর এলাকার ব্রাক লানিং সেন্টারে এই কর্মশালা হয়। এর উদ্বোধন করেন সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড) এর পরিচালক ফিলিপ গাইন। আমরাইল ছড়া ও আরেকটি গ্রুপ কালাপুর ইউনিয়নের ডাকছড়া চা বাগানের একটি শ্রমিক লাইন পরিদর্শন ও গর্ভবতী মায়েদের সঙ্গে কথা বলে।

সৌজন্য:সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড)।

শেয়ার করুন