নির্মমতাকে হার মানায় ২ ছাত্র ও অ্যাম্বুলেন্স আটকে শিশু হত্যার ঘটনা

বড়লেখা প্রতিনিধি॥ বড়লেখায় বিদায়ী ২০১৮ সালে অনেকগুলো লোমহর্ষক হত্যাকান্ড ও চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। আলোচিত ঘটনাগুলোর মধ্যে বছরের শুরুতেই ঘটে লোমহর্ষক স্কুলছাত্র হাসান হত্যাকান্ড। শেষের দিকে কলেজছাত্র প্রান্ত হত্যাকান্ড এবং ধর্মঘটী পরিবহণ শ্রমিকরা অ্যাম্বুলেন্স আটকে ৭ দিনের শিশুকন্যা খাদিজা হত্যাকান্ড শুধু বড়লেখায় নয়, নির্মম হত্যাকান্ডগুলো ‘টক অব দি কান্ট্রিতে’ পরিণত হয়। এছাড়াও আরো অনেকগুলো চাঞ্চল্যকর ঘটনা বছর জুড়েই ছিল দেশব্যাপি আলোচিত ও সমালোচিত।

উপজেলার দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউপির মোহাম্মদনগর গ্রামের দুবাই প্রবাসী আব্দুর রহিম ও গৃহিনী নাজমা বেগমের ছেলে আব্দুল্লাহ হাসান (১৫) সিলেটের দক্ষিণ সুরমার মনির আহমদ একাডেমি ক্যাডেট কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিল। ছুটি কাটাতে ১৮ জানুয়ারী হাসান বাড়িতে আসলে বাবার প্রাইভেট কারের চালক তুচ্ছ ঘটনায় নির্মমভাবে তাকে খুন করে পাশের জঙ্গলে লাশ ফেলে রাখে। নিখোঁজের ১০ দিন পর স্কুলছাত্র আব্দুল্লাহ হাসানের (১৫) ছিন্নভিন্ন লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় পুলিশ সন্দেহভাজন ৩ জনকে গ্রেফতার করলেও আসল ঘাতক থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাহিরে। এ হত্যা মামলাটি পিবিআইতে স্থানান্তরিত হলে অবশেষে ঘটনার ৪ মাস পর হত্যাকারী গাড়ি চালক এরশাদ মিয়াকে ১ জুন পিবিআই পুলিশ গ্রেফতার করে। পরে সে আদালতে হাসান হত্যার স্বীকারোক্তি প্রদান করে।

বছরের শেষের দিকের দুইটি নির্মম হত্যাকান্ড অনেকদিন বড়লেখা তথা দেশব্যাপি মানুষের চোখের জল ঝরাবে। উপজেলার সুজানগর ইউপির বাঘমারা গ্রামের সনত চন্দ্র দাসের ছেলে প্রান্ত দাস (১৯) প্রায় ৬ বছর ধরে বর্নি ইউপির নয়াগ্রামে (মিহারী) পিসির (ফুফু) বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতো। গত বছর সে পিসির বাড়ির কাছের বর্নি এম. মুন্তাজিম আলী কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। প্রেমঘটিত কারণে পিসাতো সুমন দাস ২৮ অক্টোবর কলেজছাত্র প্রান্তকে শ্বাসরুদ্ধে হত্যার পর পরিত্যক্ত রান্না ঘরে হাত-পা বেধে লাশ ঝুলিয়ে রাখে। ঘটনার দুইদিন পর আত্মহত্যার নাটক সাজিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি পিসাতো ভাই সুমনের। ময়না তদন্ত প্রতিবেদনে হত্যার আলামত স্পষ্ট হওয়ায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। আদালতে সে প্রান্ত হত্যার স্বীকারোক্তি প্রদান করে।

২২ এপ্রিল রাতে যুবলীগ নেতা আব্দুল মালিক বটল (২৮) নিখোঁজ হন। পরদিন রাত একটার দিকে সীমান্তবর্তী বোবারতল ষাটঘড়ি এলাকায় টিলার নিচের পাহাড়ি ছড়া (খাল) থেকে পুলিশ তার গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে। বটল দক্ষিণ শাহবাজপুর ইউপির বোবারতল ষাটঘরির আব্দুর রহমানের ছেলে। ২৮ এপ্রিল বটল হত্যাকারী পেশাদার খুনি সুলতান আহমদকে পুলিশ গ্রেফতার করে।

১ জুন প্রতিপক্ষের দা ও ছুলফির আঘাতে নির্মমভাবে খুন হন যুবলীগ নেতা মো. সমছুল ইসলাম (৫৫)। তিনি উপজেলার তালিমপুর ইউপির গলগজা গ্রামের মৃত লুৎফুর রহমানের ছেলে এবং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি।

প্রেমঘটিত কারণে উপজেলার উত্তর শাহবাজপুরে বাবার বাড়িতে নির্মমভাবে খুন হন ১ সন্তানের জননী স্বামী পরিত্যক্তা ফরিদা বেগম। প্রেমিক জুমেল আহমদ ১২ জুন সহযোগী নিয়ে খুন করে ফরিদাকে। হত্যার ঘটনায় পুলিশ প্রেমিক জুমেলসহ দুইজনকে গ্রেপ্তার করে।

৮ আগষ্ট রাতে সর্পদংশনে নিহত হন উপজেলার দাসেরবাজার ইউনিয়নের সুনামপুর গ্রামের মনোরঞ্জন দাসের মেয়ে কলেজছাত্রী শিবানী রানী দাস (২৫)। চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করলেও ভন্ড ওঝারা তন্ত্রমন্ত্রে নিহত ছাত্রীকে জীবিত করার খেলায় মেতে উঠে। ওঝাদের অলৌকিক এ ক্ষমতার খবর ছড়িয়ে পড়লে ওই কলেজছাত্রীর বাড়ীসহ সমস্থ গ্রামের হাজার হাজার হাজার মানুষের ঢল নামে। ভিড় সামলাতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে রীতিমত হিমসিম খেতে হয়। অবশেষে চারদিন পর মৃত কলেজছাত্রীর সৎকার করা হয়।

২৩ জুলাই উপজেলার গ্রামতলার আত্তর আলীর মেয়ে পারভিন বেগমের (৩০) রহস্যজনক মৃত্যু ঘটে। স্বামীর বাড়ির লোকজন আত্মহত্যায় মৃত্যু দাবী করলেও পিতৃপক্ষ হত্যার পর আত্মহত্যার নাটক সাজানোর অভিযোগ করে। এ ঘটনায় নিহত গৃহবধুর বোন আছমা বেগমের মামলায় পুলিশ স্বামী ময়নুল ইসলাম ও দেবর ফয়জুল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে।

২০১৮ সালের শেষ দিকের বড়লেখার সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও সমালোচিত নির্মম ঘটনা পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘট চলাকালে অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখায় বিনাচিকিৎসায় নিহত ৭ দিন বয়সি সেই শিশুকন্যার মৃত্যু। এ ঘটনায় দেশব্যাপি তোলপাড় শুরু হয়। উচ্চ আদালতের নির্দেশে থানায় হত্যা মামলা হয়। উপজেলার অজমির গ্রামের দুবাই প্রবাসী কুটন মিয়ার শিশু মেয়ে খাদিজা আক্তার অসুস্থ হলে ২৮ অক্টোবর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হয়। চিকিৎসক শিশুটিকে দ্রুত সিলেটে নেয়ার পরামর্শ দেন। অভিভাবকরা অ্যাম্বুলেন্সে রওনা দিলে পথে পুরাতন বড়লেখা বাজার, দাসেরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে পরিবহন শ্রমিকরা অ্যাম্বুলেন্সটি আটকে রাখে। অনেক অনুনয়ের পর তিন স্থান থেকে ছাড়া পেলেও চান্দগ্রাম বাজারে দেড়ঘণ্টা আটকে রাখায় বিনাচকিৎসায় অ্যাম্বুলেন্সেই শিশুটি মারা যায়। ঘটনার ৩ দিন পর গত ৩১ অক্টোবর শিশুটির চাচা আকবর আলী ১৬০ থেকে ১৭০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে থানায় মামলা করেন। গত ১৪ নভেম্বর হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ইন্সপেক্টর জসিম উদ্দিন ভিকটিম শিশুর লাশের সুরতহাল রিপোর্ট ও ময়না তদন্তের জন্য কবর থেকে লাশ উত্তোলনের আবেদন করেন। পরে দাফনের ৩৮ দিন পর ময়না তদন্তের জন্য কবর থেকে শিশুটির লাশ উত্তোলন করা হয়।

শেয়ার করুন