সিলেটকে সংক্ষেপে সবার সামনে তুলে ধরার ক্ষুদ্র প্রয়াস

গত বছরেরর কথা। বিপিএল চলছে। খেলা ছিল সিলেট রয়ালস এবং বরিশাল বানার্সের।

ক্লাসে স্যার প্রশ্ন করলেন, সিলেটের সমর্থক কারা?

আমি লম্বা করে হাত তুললাম।

-বরিশালের সাপোর্টার কারা?

বাকি সবাই একযোগে হাত তুলল।

স্যার আমাকে বললেন, তুমি সিলেটি?

-জ্বি স্যার।

-এ জন্যই সিলেট সাপোর্ট করছ।

আমি আশ্চর্য হলাম এবং একটা জিনিস বুঝলাম সিলেটি না হলে সিলেট সাপোর্ট করা যাবেনা।

সেমি ফাইনালের দিন একই অবস্থা। মেসের দশজনের মাঝে নয়জনই ঢাকাকে সাপোর্ট করল। আমি একাই সিলেট। অথচ ঢাকা বিভাগের ছিল মাত্র তিনজন। যে কোন তর্কে সবাই নিজ এলাকার পক্ষে না গেলেও সিলেটের বিপক্ষে যাবে এটা নিশ্চিত। কিন্তু কেন? জাস্ট ঈর্ষা? কেন ঈর্ষা? আমরা সবাই জানি। আসুন তবু আরেকবার জেনে নিই।

প্রথমেই নামকরণে আসি।

সিলেটের নামকরনের ইতিহাস অনেক প্রসিদ্ধ। হিন্দু মিথ মতে সতী সীতার কাটা হস্ত এখানে এসে পড়ে তাই এর নাম শ্রী হস্ত ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৪র্থ শতকে এরিয়ান গ্রন্থে সিলেটকে সিরিওট নামে অভিহত করা হয়। ২য় খ্রিষ্টাব্দে এলিয়েন গ্রন্থে সিরটে এবং পেরিপ্লাস অব দ্য এরিথ্রিয়ান গ্রন্থে সিসটে বলা হয়।

৬৪০ সালে বিখ্যাত হিউয়েন সাং সিলেটকে শিলিচল হিসেবে বর্ণনা করেন।বখতিয়ার খলজি বাংলা বিজয়ের পর সিলেটের নাম দেয়া হয় সিলাহেট।

১৩০৩ সালে হযরত শাহ জালাল সিলেট বিজয়ের পর তাঁর নামানুসারে নাম জালালাবাদ করা হয়।

এভাবেই নানা বিবর্তের মাধ্যমে এ পবিত্র ভূমির নাম সিলেট হয়েছে।

(তথ্য সূত্রঃ Journal of the Royal Aiastic Society, part 1 by Yuan Chwang)

সিলেটের আরেকটি অনন্য বৈশিষ্ট্য সিলেটি ভাষা। বাংলাদেশে অনেকগুলো উপভাষা থাকলেও সিলেটেরই রয়েছে নিজস্ব লিখন পদ্ধতি “নাগরী”।

যারা সিলেটি ভাষা নিয়ে নাক সিটকান তাদের বলছি, শুধু নাগরী সাহিত্যের উপর গবেষণা করে ৩ জন ডক্টরেট ডিগ্রি পান। তাঁরা হলেন ড.গোলাম কাদির, ড.মুছব্বির ভূইয়া এবং ড.মুহাম্মদ সাদিক।

আবার অনেকে বলেন সিলেটিরা সাহিত্যচর্চায় দুর্বল। তাদের জন্য তথ্য, ইতিহাসবিদ সৈয়দ মোস্তফা কামালের মতে সিলেটই হচ্ছে উপমহাদেশের সাহিত্যের পথপ্রদর্শক। কারণ সিলেটিরা সাতটি ভিন্ন ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেছে যা ইতিহাসে বিরল। শুধু সাহিত্যচর্চার জন্য তারা একটি লিখিত ভাষা আবিষ্কার করেছে।

আমাদের হয়ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নেই, তবে মুজতবা আলীর মত সাহিত্যিক আছেন। মহাভারত এর প্রথম বাংলা অনুবাদকও সিলেটের-মহাকবি সঞ্চয়। তাছাড়া কে না জানে হুমায়ূন আহমেদ এবং জাফর ইকবালের সাহিত্যচর্চার পেছনে সিলেটের কতটুকু প্রভাব।

রাজনীতির প্রসঙ্গে আসি।

সিলেটের রাজনীতি সব সময়ই শান্তির। এখানে আ.লীগ, বিএনপি সমযোজাতা করে কর্মসূচি পালন করে। যুদ্ধপরাধ নিয়ে অনেক বিতর্ক।আমি শুধু একটা কথাই বলব, অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা থাকলে সিলেটের কোন জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়নি।

আপনি অর্থমন্ত্রীকে যতই রাবিশ বলুন, শি্ক্ষামন্ত্রীকে যতই টাকলা বলুন, গত সরকারে যে ৪ জন মন্ত্রীর সম্পদ কমেছে তাদের মধ্যে এ দুজন অন্যতম। তারা কখনই মারমার বলে চেচাননা।

একবার একজন আমাকে বলেছিল সিলেটে আবুল মাল আছে। আমি বলি, সিলেটের একজন আবুল মালকেও অর্থমন্ত্রী করা হয়, সিলেটিরা ছাড়া বাজেট পেশ হয়না, তাহলে আসল মালদের অবস্থা চিন্তা করেন।

আসুন এবার আসল মালদের পরিচয় দেই।

প্রথম বাংলাদেশী মার্কিন সিনেটর হাশিম ক্লার্ক, প্রথম বাংলাদেশী বৃটিশ এমপি রোশনারা আলী, হ্যামলেট শহরের মেয়র আব্দুস সালিক, লুৎফর রহমান, মেয়র সাঈদ আহমেদ, বৃটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী, রাণীর শেফ টমি মিয়া, লন্ডন কেন্দ্রীয় মসজিদের ইমাম আজমল মাশরর, প্রথম মুসলিম এবং প্রথম এশিয়ান হিসাবে হাউস অব লর্ডসে বসা পোলা মিয়া, বারনেস মিয়া এরা সবাই সিলেটি।

কয়েকদিন আগে একজন তরুণ যাকে নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক হইচই হয়, সাবেরুল ইসলাম- বিশ্বের সেরা দশজন উদ্যক্তার একজন, তার বাড়িও সিলেট। বাংলাদেশে বোন মেরু রিপ্লেস করে যিনি ইতিহাস গড়েছেন তিনিও সিলেটের।

সিলেটের মানুষদের আঞ্চলিক প্রীতি বেশি, তাই দেশপ্রেম কম এটা একটা কমন অভিযোগ। দেখুন, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক সিলেটের, প্রথম স্বাধীন হওয়া উপজেলা (জকিগঞ্জ) সিলেটের।

তাছাড়া আরোকটা ঐতিহাসিক তথ্য, আমরা গণভোট দিয়ে বাংলাদেশে এসেছি। চাইলে ভারতেও যেতে পারতাম। এটা কি প্রমাণ করে? আমাদের দেশপ্রেম কম? আর স্বাধীন হওয়ার পর শুধু সিলেটের একটা জায়গা (জকিগঞ্জ) নিয়েই ভারতের সাথে যুদ্ধ করে সিলেটিরা বিজয় এনেছে।

আমাদের অভিনেতা, গায়ক নেই। তাই না?

সালমান শাহর নাম শুনছেন তো? তার মত নায়ক আরেকটা আসবে বলে মনে হয়? আর যে সুবীর নন্দীর গান শুনেনি সে গান কি বুঝবেই না, আর গুডলাক বাংলাদেশ খ্যাত শুভ্রদেবের নাম শুনেনি এমন লোক বিরল। সিলেটের আব্দুল করিম, হাসন রাজা, রাধা রমন, শিতালং শাহ যত গান লিখেছেন আগামী একহাজার বছরেও তত গান কোন অঞ্চলের কেউ লিখতে পারবে না। আমাদের শিবলী মোহাম্মদের মত নৃত্যশিল্পী নাই তবে আকরাম খানের মত নৃত্য শিল্পী আছে। এই ভদ্রলোক লন্ডন অলিম্পিকের উদ্ভোধনী অনুষ্টানের নৃত্য পরিচালনা করেন। ক্রিকেটে আমাদের সাকিব নাই তবে এনামুল জুনিয়র আছে।তার কল্যানে বাংলাদেশ প্রথম টেস্ট সিরিজ জয় করে। এছাড়া বাংলাদেশ হ্যাট্রিক করা শেখানো, আইসিএল মাতানো কাপালীকে কে চেনে না? ফুটবলে কায়সার হামিদের নাম যে শুনেনি তার ফুটবল জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তুলা যায়। আর দাবার কিংবদন্তী রাণী হামিদও আমাদের সিলেটের। আমাদের নোবেলজয়ী নেই কিন্তু একমাত্র নাইট উপাধী প্রাপ্ত বাংলাদেশী ফজলে হাসান আবেদ আছেন। আমাদের হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সাবেক সভাপতি। আর এই কীর্তি কেউ গড়তে পারবে?

আর ইসলামিস্টরা তো সবাই সিলেটেরই।

বাংলাদেশের আলেম সমাজের বড় অংশই সিলেটের। আপনি বলবেন, কই নাম তো শুনিনি। আসলে তাঁরা রাজনীতি করেন না তো, তাই জানেন না। তারপরও বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের খতিব, অবিসাংবাদিত আলেম উবায়দুল হককে এখনও মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। সিলেটের প্রকৃতি, সিলেটের সম্পদ তা নিয়ে নাই আলোচনা করলাম।

হযরত শাহজালাল (র.) উড়ে এসে সিলেটে জুড়ে বসেননি। আরবের মাটির সাথে সিলেটের মাটির মিল আছে বলেই এসেছেন। আমরা তাঁর উত্তরসূরী।

অতীতে একটা কথা ছিল “শ্রীহট্টে মধ্যমা নাস্তি।” মানে সিলেটের লোক হয় উত্তম নয় অধম। মাঝামাঝি নেই। আর আমরা তো জানি, মাঝামাঝিরাই সমস্যা করে বেশি। আমরা বিশ্বাস করি, দু একজন অধম ছাড়া আমরা সবাই উত্তম। পচনশীল রাজনীতির মাঝেও সিলেটের ফরিদ গাজী, আব্দুস সামাদ আজাদ, সাইফুর রহমান তাঁরা স্বমহীমায় উজ্জ্বল ছিলেন। 

আমরা ১২৫৯৫.৯৫ বর্গকি.মি. এলাকার প্রায় এককোটি মানুষ আমাদের সিলেটকে গভীরভাবে ভালোবাসি। আমরা সিলেট নিয়ে গর্ব করি। আপনারা যারা সিলেট নিয়ে বিরোধীতা করেন তারা ভেবে দেখুন, আমরা যদি হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জের সীমানায় বিদ্যুৎ গ্যাসের লাইন কেটে দিয়ে, ৯২%রেমিটেন্স নিয়ে বাংলাদেশ থেকে আলাদা হই তাহলে কি খারাপ থাকব? তবে আমরা আলাদা হবনা। কারণ এদেশ ভালোবাসি বলেই গণভোট দিয়ে এদেশে এসেছি।

সবশেষে একটা কথাই বলি, জ্বি ভাইজান, আমি একজন গর্বিত সিলেটি।

(তথ্যগত কোন ভুল থাকলে ধরিয়ে দেবেন প্লিজ)

নাফিসা রফিক, শাবিপ্রবি

শেয়ার করুন