বেশ কয়েক প্রজন্ম আগেকার কাহিনী। বাংলাদেশের দক্ষিনে বঙ্গপোসাগরের সম্পূর্ন বেলাভূমি তখন সুন্দরবনের অংশ ছিল।মনগ্রোভ অরন্যজুড়ে ছিল হরিন বানর মৌমাছি ও নানা পাকপাখালীর অবাদ বিচরন ক্ষেত্র। ডাঙ্গায় ভয়ংকর সব বাঘ আর জলে লুকিয়ে থাকা কুমিরের ভয়ে মানুষ বন পেরিয়ে সাগর পর্যন্ত পৌছানোর সাহস করত না। দক্ষিনের সুন্দরবন ও সংলগ্ন সাগর মানুষের মনে ভয় জাগাতো। সুন্দরবন জুড়ে সেকালেও ছিল জলদস্যুদের উৎপাত। জীবন ও জীবিকার তাগিদে দরিদ্র লোকজন বনে ঢুকে সেকালেও অবাধে প্রান হারাত। কেউ একটু অসাবধান হলেই চালান হয়ে যেত বাঘ কিংবা কুমিরের পেটে। জলদস্যুরা অনেককে ধরে নিয়ে মুক্তিপন আদায় করত কিংবা ক্রীতদাস হিসাবে বাহিরে বিক্রি করে দিত। সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামবাসীর জীবন ছিল কৃষি ও বনকেন্দ্রিক। বন ছিল তাদের জীবিকার উৎস অথচ এই বনই তাদের উপর প্রায়ই চাপিয়ে দিত নানা বিপদ। সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে বয়ে অসংখ্য নদীনালা নেমে গেছে সাগরে আর বয়ে আনা উর্বর পলি মোহনায় জমে জমে তৈরী হচ্ছে অসংখ্য চরাঞ্চল ও দ্বীপ। এমনই একটি চরের নাম দুবলারচর। প্রাচীনযুগের কিছু সাহসী জেলে খাল বেয়ে দুর্গম বন পার হয়ে চলে আসে এই দুবলার চরে। উত্থাল সাগর আর নির্জন জঙ্গলের সঙ্গমস্থলে তারা তীব্র জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সাগর ও অরন্য হতে তারা সংগ্রহ করে নিত্য জীবনের উপকরন। তাদের পরিশ্রমে গড়ে উঠে এক জেলে পল্লী।বনদেবীর সন্তুষ্টির জন্য গড়ে তুলা হয় মন্দির ও বছরারম্ভে হত রাসমেলা। আজও এই মেলায় জড় হয় অসংখ্য মানুষ এবং বঙ্গপোসাগরে গোছল করে পাপকে ধুয়ে মুছে বিসর্জন দেয়।
দুবলারচরের উর্বর মাটিতে এসে আশ্রয় নিতে থাকে অসংখ্য ছিন্নমূল মানুষ। বন ও সাগরের অবারিত প্রাকৃতিক সম্পদকে আশ্রয় করে বাড়তে থাকে জনপদ। এখানে কোন রাজা বাদশাহকে তাদের খাজনা দিতে হতনা কারন তখনকার দিনের রাজার লোকদের ঐ দুর্গম স্থানে পৌছানোর সাধ্য ছিল না। বনের সবচেয়ে পরাক্রমশালী জলদস্যু সরদারকে তারা হাতে রাখতো। দস্যু সরদারই তাদের নিরাপত্তা দিত কারন স্থানীয় দস্যুরাও নিরাপদ আশ্রয় ও প্রয়োজনীয দ্রব্যসামগ্রীর জন্য দুবলারচরবাসীর কাছে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এক বাংলা প্রবাদ রয়েছে-ডাকাতের ঘাটে কখনও নৌকা ডুবেনা। কাজেই চরবাসীর প্রতি স্থানীয় দস্যুরা যথেষ্ট সদয় ছিল ও এখানে তারা খুব একটা অনাচার করতনা।
তখনও ইউরোপীয় বনিকরা ভারত মহাসাগরে আসেনি। আরব বনিকরা সাগরের উপকূল ঘেষে ঘেষে পালের জাহাজে পন্য বুজাইকরে নিয়ে যেত মসলা দ্বীপপুজ্ঞে। বাগদাদ বসরা জেদ্দা এডেনের আরবী বানিজ্যবহর ভারত মহাসাগরের সৈকত ঘেষে ঘেষে পালতুলা জাহাজ চালিয়ে আরব সাগর, মান্নার প্রনালী, বঙ্গোপোসাগর ওদূরের সিঙ্গাপুর চ্যানেল পার হয়ে ইন্দোনেশিয়া হয়ে সুদূর চীন পর্যন্ত যাতায়াত করত। হজের মৌসুমে পূর্বাঞ্চলের হাজীগনের পালতুলা জাহাজ চলে যেত পশ্চিম দিকে, ফিরে আসতো আবার হজ্জ সমাপনে। আজিকার মত শীতে ঝাঁকে ঝাঁকে পরিজায়ী পাখিরা আসত, তাদের কিচির মিচিরে জেগে উঠতো নিরব বনবীথি ও চরাঞ্চল। শীত শেষে তারা আবার ফিরে যেত দেশে। জলদস্যুরা আল্লার মেহমানদের জাহাজে কখনও আক্রমনে সাহসী হতনা। তারা বলত হাজীদের জাহাজে হামলা করে আল্লার গজব হতে কেউ রেহাই পায়নি। ফলে হাজীদের জাহাজ এপথে নিরাপদেই চলাচল করত।
ইতিমধ্যে শকুনের ছুলানো গলার মত রক্তিমাভ গাত্রবর্নের বিচিত্র লোকের আবির্ভাব হলো সাগরে, তাদের পাটের মত সোনালীচুল, মার্বেলের মত নীল ও পিঙ্গল ঘোলা চোখ। লম্বা লাটির মত কি একটা জিনিসে চোখ রেখে জাহাজ চালিয়ে নিয়ে যায় দুর সাগরে। এদের আগমনের পরই দুবলারচরে এক অশান্তির সূত্রপাত হল। কিছুদিন পরপর মানুষ গুম হওয়া শুরু হল দুবলার চরে। স্থানীয় লোকজন এদের অপয়া ভাবত এবং তাদের নাম দিলো ফিরিঙ্গী। এই ভিনদেশী ফিরিঙ্গীরা বানিজ্য করত, সেইসাথে গোপনে মানুষ ধরে নিয়ে দাস বাজারে বিক্রি করে দিত। সময়ে সুযোগে সমুদ্র উপকূলে দস্যুবৃত্তি করে বেড়াতো-যদিও দুবলারচরবাসীর ঐক্য ও সাহস তাদেরকে এদিকে পা বাড়াতে উৎসাহী করতনা। আরবরা যুগযুগ ধরে জাহাজে বানিজ্য করলেও তারা জলদস্যুতায় কখনও লিপ্ত হতে কেউ শুনেনি। তারা ছিল ন্যায়নিষ্ট ও ধর্মপরায়ন। বানিজ্য ও ধর্ম প্রসারের বাহিরে অন্য কোন অনৈতিক কাজে তারা কখনও জড়ায়নি।
দুবলার দক্ষিনে উত্থাল সমুদ্রের মধ্যে এক অজানা জঙ্গলা দ্বীপে ফিরিঙ্গীরা তাদের ঘাঁটি গড়ে তুলে। ফিরিঙ্গীরা সমুদ্রচারী জাতি। এরা হঠাৎ দানবের মত এসে মুহূর্তের মধ্যে লোটতরাজ করে দূরসাগরে অদৃশ্য হয়ে যেত। এদের অত্যাচারে বাংলার দক্ষিন উপকূল দিয়ে আরব ও স্থানীয়দের নৌচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দুবলারচরে একজন আরবদেশীয় লোক বসবাস করতেন, তার নাম ইবনে বদর। তিনি নৌপথে এসে এখানে অবস্থান করেন। সুফী ধরনের এই আলোকিত লোক এখানে ধর্মচর্চা ও হেকিমি চিকিৎসা সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে মানুষের মন জয় করেন। রহস্যময় এই মানুষটি মাঝে মধ্যে হারিয়ে যেতেন, আবার কিছুদিন পর আবিভূত হতেন। লোকে মনে করত তিনি মাছের পিঠে ছওয়ার হয়ে এসেছেন, তাই তারা তাকে মাহিছওয়ার নামে ডাকত। তার কাছে এখানকার জেলেরা প্রথম আল্লাহ-নবীর নাম শুনতে পায় ও ইসলামের দিকে পা বাড়ায়। দুবলারচরে কয়েকঘর মানুষ মুসলমান হয় ও একটি মসজিদ গড়ে উঠে। মাওলানা শাহ বদর মাহিছওয়ার দুবলারচরবাসীর ধর্মীয় পীর ও ইমামের আসনে অধিষ্টীত হন। তিনি চরবাসীকে চিকিৎসা সেবা বিতরনের জন্য সুন্দর বনের ভিতরে ঢুকে নানা ঔষদি লতা পাতা খোঁজে বেড়াতেন। হজরত মাওলানা মাহিছওয়ার একদিন হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যান। পূর্বে তিনি চলে গেলেও আবার কিছুদিনের মধ্যে ফিরে আসতেন কিন্তু এবার ফিরে এলেন না। দুবলারচরবাসী বিষ্ময়ের সহিত লক্ষ্য করল- মাওলানা দুরাচার ফিরিঙ্গীদের অভিশাপ দিতে দিতে একসময় নিখোঁজ হয়ে গেলেন। মাওলানার মুর্শিদরা পীরের অপেক্ষায় অস্থির হয়ে দিন কাটাতে থাকেন। তারা বিশ্বাস করত তাদের পীর অত্যাচারী ফিরিঙ্গী হার্মাদদের তাড়িয়ে দিয়ে ফিরে আসবেন কিন্তু বহুদিন চলে গেল, তারপরও তিনি এলেন না। প্রশ্ন হলো তাহলে তিনি গেলেন কোথায়। লোকেরা বলাবলি করে হুজুর আবার মাছের উপর ছওয়ারহয়ে আল্লাহ নবীর বাড়ি আরবদেশে চলে গেছেন।
বহুদিন অপেক্ষার পর একদিন দুবলারচরবাসী দেখতে পেলো হুজুর মাহিছওয়ার একটি বড়সড় ডিঙ্গী বেয়ে সাগরের ঢেউ ভেঙ্গে তীরের দিকে আসছেন। হুজুরের সাথে আরও দুইজন কংকালসার লোক নৌকার বৈঠা টানছে। মনে হচ্ছে তারা অসুস্থ ও পুষ্টিহীনতার শিকার। তাদেও গায়ে কাপড় নেই, কেবল লজ্জা ঢাকারমত কোমরে কিছু কাপড় জড়ানো রয়েছে। দুবলারচরে হৈচৈ পড়েগেল। সবাই দৌড়ে সাগরপারে চলে গেল।হুজুরের সাথী দুইজনের পরিচয় বেরিয়ে আসে। এরা মানিক ও ভেড়াই মাঝি। এই দুবলারই বাসিন্ধা। একসময় এই উত্থাল সাগরে ও সুন্দরবনের খালে মাছধরত। পোষা ভোদড় নিয়ে মাছ শিকারে বের হয়ে বছর কয়েক আগে একদিন তারা গুম হয়ে গিয়েছিল। খালের পারে তাদের পোষা ভোদড় ও খালি জাল নৌকা পড়ে আছে। স্বজনরা চোখের জল ফেলতে ফেলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সবাই মনে করত এরা হয়ত বাঘ মামার পেট মোকামে চলে গেছে, নয়তো হার্মাদরা ধরে নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে। তারা তীরে আসিলে দুবলারচরবাসী অবাক হয়ে দেখতে পেল তিনজনের পায়ে লোহার জিজ্ঞির পরানো। মানিক ও ভেড়াই মাঝি অত্মীয় স্বজনের গলা জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
রাতে দুবলার মসজিদে জলসা বসে। জলসা লোকে লোকারন্য। মানুষ হজরতের অন্তর্ধান রহস্য ও মানিক ভেড়াইয়ের উদ্ধার কাহিনী শুনতে উদগ্রীব। হুজুর প্রথমেই আল্লাহর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন ও তার প্রতি শুকর গোজার করেন। তারপর রসুলের প্রতি দুরূদ জ্ঞাপন করে বক্তব্য আরম্ভ করেন। হুজুর বয়ান করছেন আর লোকেরা উদগ্রীব হয়ে শুনছে।
“সেদিন শীতের ভোর ছিল। মসজিদে ভোরের নামাজে ইমামতি সেরে একাকী হাঁটতে বের হই। গাড় নীল আকাশ। পায়ের কাছে আছড়ে পরছে একটার পর একটা সাগরের ঢেউ। পাতলাকুয়াশা ও শিরশির ঠান্ডা হাওয়া বইছিল। ঔষধি গাছের খোঁজেখোঁজে লোকালয় ছেড়ে সৈকতরেখা বরাবর বহুদূর চলে যাই আমি। পশ্চিম সাগরে লাল থালার মত অপূর্ব সুন্দর সূর্যের মুখ তখন ভেসে উঠে।”
হুজুর বলছেন, এমন সময় বন থেকে বেরিয়ে আসে একদল জলদস্যু হার্মাদ। মুহূর্তের মধ্যে হাত বেঁধে নিয়ে যায় মাইলখানেক পশ্চিমে তাদের কাটের জাহাজে। আমি অর্থাত এই শিকারের প্রানীটিকে নিয়ে জাহাজটি দ্রুত সাগরের দিকে ধাবিত হয়। আমি অনবরত খতমে ইউনুসের দোয়া পড়তে থাকি। সারাদিন জাহাজ চালিয়ে বাদ আসর সাগরে একটি ছায়া দেখা দেয়। জাহাজ সামনের দিকে যতই অগ্রসর হচ্ছিল ছায়াটি ততোই স্পষ্ট হচ্ছিলো- এ যে এক গহীন অরণ্যময় দ্বীপ। একটি ছোট নদী এসে পড়েছে সাগরে, এই নদী পথে জাহাজটি ঢুকতে শুরু করে। ইতিমধ্যে রাত নেমে এসেছে। মশাল জ্বেলে জলদস্যুরা আমাকে তাদের আস্থানায় নিয়ে যায়। বজ্জাত লোকগুলো যখন দেখলো আমার মত প্রৌড় লোককে বিক্রি করে তেমন অর্থ পাওয়া যাবেনা তখন তারা আমাকে তাদের ঘাটির একজন কৃতদ্বাস বানালো। ইতিপূর্বে আরব বনিকদের জাহাজে চড়ে ইসলামের দাওয়াতি কাজে অনেক উপকূলীয় মুলুক গিয়াছি। অনেক ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক পথে চলাচল করেছি। কিন্তু তেমনটা বিপদে পড়িনি। বিপদ ভয়ঙ্কর বিপদ, ওরা আমার পায়ে জিজ্ঞির পরিয়ে দিল যাতে পালিয়ে না যাই। সারাদিন জিজ্ঞির পরা অবস্থায় কঠিন কঠিন কাজ করাতো, সামান্য ভূলভ্রান্তি হলে গায়ে পড়ত চাবুকের ঘা। খেতে হত তাদের বাসী ও উচ্ছিষ্ট খাবার। অনেক সুন্দরী মেয়েমানুষ এবং লোকজনকেও আমাদের মত দস্যুরা বন্দী করে রেখেছে। সবার অবস্থা সঙ্গীন। মেয়ে মানুষগুলো চাবুকের ঘা খেয়ে প্রানভয়ে ওদের জৈবিক পাপাচারের সঙ্গী হতে বাধ্য হচ্ছে।
ভেড়াই মাঝি সহজ সরল লোক, মানিক অনেকটা বুদ্ধিমান। এবার মানিক জলসার লোকজনকে বলতে শুরু করে, “দুবলারচরের সম্মানীত ঈমাম সাহেবকে তারা চরম তুচ্ছ তাচ্ছিল্ল্য করত। সেখানে হুজুরের সাথে দেখা হয় আমি ও ভেড়াই মাঝির- যে আমরা অনেকপূর্বে হারিয়ে গিয়েছিলাম দুবলারচর হতে। সর্বক্ষন জিজ্ঞির পরা আমি ও ভেড়াই কান্নাকাটি করে হুজুরের দোয়া কামনা করতাম প্রভু যেন এই দুহসহ জীবন থেকে আমাদেরকে মুক্ত করেন। দস্যুদের জন্য জ্বালানী কাট সংগ্রহ, বুনো পশু শিকার, নাপাক শুকর পালন, মাছ ধরা, রান্না-বান্না কত কিছুইনা করতে হত আমাদের। স্বজনদের জন্য বুকটা হাহাকার করে উঠত, নিরবে চোখের জল ফেলে আমরা অমানুষিক কাজ করে যেতাম।এভাবে আমরা শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। হুজুরের আগমনে আমাদের মনের বল বেড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত হুজুরের দোয়ার জন্যই আমরা রক্ষা পেলাম।”
জলসায় পিনপতন নিরবতা। হুজুরের কারামতি শক্তি কেমন করে মানিক ও ভেড়াই মাঝিকে মৃত্যুর গোহা থেকে বের করে নিয়ে আসলো-তা জানতে সবাই উদগ্রীব। মানিক বলে যাচ্ছে আর ভেড়াই উ-আ বলে সায় দিয়ে যাচ্ছে।
“ফিরিঙ্গীদের অত্যাচারের মাত্রা অসহনীয পর্যায়ে পৌছে গিয়েছিল।আমরা বন্দি-বন্দিনীরা সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যার চিন্তা করতাম কিন্তু আত্মহত্যা মহাপাপ, তাই খোদার ভয়ে বিরত হতাম। একদিন এই নৌকায় করে আমরা তিনজন মিলে দস্যুদের খাবারের জন্য মাছ ধরতে যাই। সেদিন সমুদ্রে তেমন মাছ ধরা যাচ্ছিলো না। আমরা ভীত হয়ে পড়ি। শূন্য হাতে ফিরে গেলে হার্মাদদের হাতে মার খেতে হবে। মাছের সন্ধানে আমাদের ডিঙ্গী দ্বীপটির দূর প্রান্থরে চলে যায়। আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়ি। বিশ্রামের জন্য তীরে উঠি। মুহূর্তের মধ্যে অসংখ্য পিপড়া আমাদেরকে আক্রমন করে। আমরা প্রান বাঁচাতে সমুদ্রে ঝাপ দিয়ে ডিঙ্গীতে উঠে আত্মরক্ষা করি। সন্ধ্যায় পর্যাপ্ত মাছ নিয়ে না আসায় এক হার্মাদ দস্যু আমাদের পিটুনী দেয়। পরদিন আবার আমরা সেদিকে যাই। এবার দেখতে পাই ঐ প্রান্তে লক্ষ লক্ষ রাক্ষুসে পিপড়া খিলবিল করছে। এই পিপীলিকারা দ্বীপের ঐ প্রান্তের কচ্ছপ সাপ শৃগাল এমনকি রোদ পোহাতে তীরে ওঠা কুমিরটিকে মেরে সাবাড় করে ফেলেছে, পড়ে আছে কুমির হরিনের কংকাল। এই দৃশ্য দেখে ভয়ে আমরা কাঁপতে থাকি। দ্রুত ডিঙ্গী বেয়ে এইপ্রান্ত হতে প্রস্থান করি। তৃতীয় দিন মাছ ধরতে বের হই। ঐ দিন কোন মাছ ধরা যাচ্ছিলো না। কোন মাছ নিয়ে ফেরত আসতে না পারলে বজ্জাতরা আমাদের পিঠের চামড়া তুলে ফেলবে। মাছ ধরার প্রানান্ত চেষ্টায় দিন পেরিয়ে যায়। সন্ধ্যায় ভয়েভয়ে দস্যুদের আস্থানায় ফিরে এসে ডিঙ্গীতে বসে এক অভাবনীয় দৃশ্য আমাদের দেখতে হয়। কোটি কোটি ভয়ংকর মাংশাশী রাক্ষুষে বড় বড় অগ্নি-পিপড়া ডাকাতদের আস্থানা ঘেরাও করে প্রচন্ড আক্রমন রচনা করেছে। দস্যুরা আগুন জ্বালিয়ে পিপীলিকা তাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু দলে দলে আগুনে ঝাপিয়ে পড়ে আগুন নিভিয়ে দিচ্ছে, কেউ কেউ গাছের মগডালে উঠেও প্রাণ বাঁচাতে পারছেনা, সেখানেও আক্রমন করছে। নদীতে নেমেপড়া একজন দস্যুকে পিপড়েরা সাঁতরে আক্রমন করে পানিতেই মেরে ফেলেছে। ডাকাতদের নোঙ্গর করা সবকটি জাহাজ ও নৌকায় উঠে পরেছে হাজারে হাজার পিপড়ে। বজ্জাত ডাকাতগুলো বাঁচাও, বাঁচাও বলে চিতকার করছে। কিন্তু মাংশাষি পিপীলিকারা তাদেও রক্ত মাংশ নাড়িভুড়ি খেয়ে ফেলছে। একে একে ডাকাতদের কংকাল পড়তে দেখা যাচ্ছে। আরবী হুজুর বললেন এই পিপড়া আসলে পিপড়া নয় আল্লার গজব, আফ্রিকার ভয়ংকর যাযাবর যুদ্ধা পিপীলিকা মনে হচ্ছে। এই পিপীলিকার দলকে দেখে বাদশা সুলায়মান নবীও ভয় পেয়ে গিয়া ছিলেন। এই পিপড়া বাহিনী সামনে যা পাচ্ছে সব খেয়ে মেসাকার করে ফেলছে। সম্ভবত ডাকাতদের একজনও পালাতে পারেনি।
হজরত বদর মাহিছওয়ার সাত সাগর পশ্চিমের লোক, সমুদ্রে অনেক ভ্রমন করেছেন। তিনি জানতেন উত্তর দিকে ডিঙ্গী চালাতে থাকলে একসময় খোদার মর্জি হলে তীর পাওয়া যাবে। তিনি বললেন হার্মাদদের পাপাচারে এই দ্বীপে আল্লার গজব নেমেছে। এখানে বেশীক্ষন অপেক্ষা করা ঠিক হবেনা, নতুবা গজব আমাদেরকেও গ্রাস করে ফেলবে। হুজুর বললেন আকাশের শোকতারা নিশানা করে উত্তর দিকে বৈঠা টানো।উত্থাল সমুদ্রে ইসমে আজম জপে জপে আমরা তিন জন সারারাত দাড় বেয়ে পরদিন সৈকতের দেখা পাই ও উপকূল বরাবর পশ্চিমদিকে এসে দুবলার বেলাভূমিতে উপনীত হই। তিনজনের পায়ে জিজ্ঞির অথচ আজ দাসত্বের অবসান হলো।
হজরত মাহিছওয়ারের কারামতি দেখে তাজ্জব দুবলারচরবাসী হজরত ফিরে এসেছেন দস্যু ফিরিঙ্গী হারমাদদের বদ করে। হজরতের দোয়ায় হার্মাদেরা মরে ভূত হয়ে যায় ও আর কোন দিন হানা দেয়নি দুবলারচরে। এবার দলে দলে দুবলার লোকেরা তাঁর মুরিদ হয় ও চলে আসে ইসলামের ছায়াতলে। আজও মানুষ দুবলারচরে এসে শ্রদ্ধাভরে জেয়ারত করে যায় হজরত শাহ বদরমাহি ছওয়ারের মাজার।
আজ ২০১২ সালে আমি যখন লোকমুখে শুনে দুবলারচরের উপাখ্যান লিখছি তখন আমার মনে প্রশ্ন হচ্ছে- এই ভয়ংকর আফ্রিকান যাযাবর রাক্ষুষে পিপড়া বাংলার দক্ষিনের এই দ্বীপে আসলো কেমন করে।উত্তরটিও সহজ। ফিরিঙ্গীরা দক্ষিন আফ্রিকার উপক’ল ঘেষে আসার সময় তাদেরই অজান্তে দুচারটা পিপড়ে হয়ত উঠে গিয়েছিল তাদের জাহাজে এবং সুবিধামত সময়ে তারা নেমেপড়ে ঐ দ্বীপে। তারপর দ্বীপের এক কোনে বংশ বৃদ্ধি করে একসময় চেঙ্গীস খানের অপরাজেয় ও নিষ্টুর মোঙ্গর বাহিনীর মত ঝাঁপিয়ে পড়ে সমগ্র দ্বীপে। মুহূর্তের মধ্যে তছনছ করে দেয় মানুষসহ দ্বীপের প্রাণীজগত। এই বড় বড় অগ্নি-পিপড়ারা পৃথিবীর সবচেয়ে হিংস্র ও প্রানীখাদক পিপীলিকা। এরা জাতিতে যাযাবর ও ভয়ংকর সাহসী নৃশংস যোদ্ধা। আফ্রিকার দক্ষিনাঞ্চলে এক জায়গায় কিছুদিন অবস্থান করে সবকিছু খেয়ে ফেলে যখন লক্ষ লক্ষ পিপীলিকা সৈনিক বাহিনী কয়েক মাইল এলাকা জুড়ে দল বেঁধে রওয়ানা হয় তখন যাত্রা পথে সামনে পড়লে কারও রক্ষা নেই, বাঘ, হরিন, সিংহ, মানুষ সবাইকে খেয়ে কংকাল ফেলে চলে যায়। এরা অনেক সময় পানিতে ঝাপিয়ে পড়া শিকারকে জলে সাঁতরে ধাওয়া করে, তাদের আত্মঘাতি বাহিনী আগুনে ঝাপ দিয়ে আগুনও নিভিয়ে ফেলে।আফ্রিকার সব দুর্দান্ত প্রাণীরা এদের উপস্থিতি টের পেলে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়ে পালাতে থাকে। প্রশ্ন আসতে পারে দুবলার ধারের দ্বীপ থেকে এখন ওরা গেল কোথায়। এর উত্তরটি আরো সহজ। হয়ত কোন সামুদ্রিক জলোচ্ছাসে তারা সমুদ্রে তলিয়ে গেছে চিরতরে। এদের বংশধররা আর উঠে আসতে পারেনি বাংলার ডাঙ্গায়, তাইতো রক্ষা পেয়েছে বাংলাদেশ।