উদিসা ইসলাম
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদের উপ-নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো কম ছিল। বৃহস্পতিবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) সকাল আটটায় শুরু হওয়া এই নির্বাচনে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, অনেক কেন্দ্রেই সকাল ১০টায়ও ভোটারের দেখা মেলেনি। সকালে রাজধানীতে বৃষ্টি থাকার কারণে ভোটার সংকট বলে ধারণা করা হলেও বেলা বাড়ার পর রোদ উঠলেও সেই সংকট কাটেনি। কেন ভোটকেন্দ্রে ভোটাররের কম উপস্থিত বলতে গিয়ে সাবেক নির্বাচন কমিশনার, সমাজ গবেষক ও মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, মানুষ গত কয়েকটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছে এবং যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায়, তাদের ভোটকেন্দ্রে আনা যাচ্ছে না। এদিকে, যদিও নির্বাচন শেষ হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘মেয়র পদে উপ-নির্বাচনে বড় কোনও প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় ভোটারদের উপস্থিতি কম ছিল।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল মনে করেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াগুলোর প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়েছে। ভোটকেন্দ্রে ভোটার কম কেন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যখন কোনও একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে মানুষ অংশগ্রহণ করে না, তখন সেই প্রক্রিয়ার ওপর মানুষের আস্থা নেই, বিশ্বাস করছে না। আমি বাড়ি থেকে বের হবো, ভোট দেবো, কিন্তু ভোটের ফলাফল যেটি হবে, সেটির সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা খুঁজে পাচ্ছি না। তখন মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র অংশগ্রহণ। সেখানে অংশগ্রহণই হচ্ছে না, মানে গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াগুলোর ওপর মানুষের আস্থা চলে গেছে। আমি একটা কাজ করলে যে সেটার ফলাফল পাবো, কিন্তু সেটি হচ্ছে না— এই বোধটাই তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে।’ একটা শাসন ব্যবস্থার জন্য এটি উদ্বেগের উল্লেখ করে সুলতানা কামাল আরও বলেন, ‘এটা নিয়ে চিন্তা করা দরকার যে, কেন মানুষ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে।’
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার এম. সাখাওয়াত হোসেন কারণগুলো চিহ্নিত করতে গিয়ে বলেন, ‘এখানে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, যারা ভোটারদের আকৃষ্ট করবেন, তেমন ব্যক্তিত্বও নেই, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নেই, ভোটের প্রচারণা ছিল না। একরকম নিভৃতেই ভোট হয়েছে। গত কয়েকটি নির্বাচন দেখার পরে সাধারণ ভোটাররা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তারা ধরেই নিয়েছে, যার জেতার সে জিতবে। আন্তর্জাতিকভাবেই একটি বিষয় স্বীকৃত— পরপর কয়েকটি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হলে মানুষ আগ্রহ ও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান মনে করেন, ভোটারদের ভোট দেওয়ার উৎসাহ কমে গেছে। তিনি বলেন, ‘রাজনীতি, নির্বাচন, ভোট বাক্স — এসব বাঙালির সবচেয়ে পছন্দের বিষয় ছিল। অথচ আমরা নির্বাচনের দিন দেখলাম— কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি লক্ষণীয় মাত্রায় কম। আমাদের এতকালের রাজনৈতিক ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। নাগরিকের অন্যান্য অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেবার দায়িত্ব সম্ভবত রাষ্ট্রের ওপরই বর্তায়! ভোটের মাঠ তো হবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার, সেটা নেই বলে হয়তো ভোটারদের আগ্রহ কমে গেছে।’
এদিকে, ডিএনসিসি’র মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলামের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল ভোটার কমের কারণ। তিনি বলেন, ‘আজ সকাল থেকেই ঢাকায় বৃষ্টি নেমেছে। সব চেয়ে বড় কথা হচ্ছে— একটি দল নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেনি। তারা আসলে নির্বাচন আরও সুন্দর হতো।’
নির্বাচন শেষ হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘মেয়র পদে উপ-নির্বাচনে বড় কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় ভোটারদের উপস্থিতি কম ছিল। তবে যেসব কেন্দ্রে কাউন্সিলর পদে ভোট হয়েছে,সেখানে ভোটার উপস্থিতি অনেক বেশি ছিল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে উপ-নির্বাচন ও দুই সিটির (উত্তর ও দক্ষিণ) সম্প্রসারিত অংশে কাউন্সিলর পদের নির্বাচনে সব মিলিয়ে ৫০ শতাংশের মতো ভোট পড়তে পারে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, একবছর মেয়াদ থাকায় নির্বাচনকে গুরুত্ব দেননি ভোটাররা। এ বিষয়ে আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে সময়টা বড় কথা নয়, একটি বড় রাজনৈতিক দল নির্বাচনে আসেনি। এটা বাস্তব সত্য কথা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের সামনে যে স্বল্প সময় আছে, তার জন্য আমরা একটা পরিকল্পনা করেছি। এই পরিকল্পনার কথা আমাদের ইশতেহারেও জানিয়েছি। আমরা ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী চলবো। সুতরাং, আমি এক বছর সময়টাকে কম মনে করি না।’
উদিসা ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনের চিফ রিপোর্টার।