শাকির আহমদ :: নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে দুটি মসজিদের হামলার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্নকে ইমেইল করেছিলেন বাংলাদেশের এক চিকিৎসক।
ওই ইমেইলে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্নের ভূমিকা ও তার কিছু বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানান বাংলাদেশি চিকিৎসক।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীকে মেইল পাঠান বাংলাদেশি চিকিৎসক ডা. সাঈদ এনাম ওয়ালিদ। তিনি দেশের একজন প্রখ্যাত মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে ডা. সাঈদ এনাম সিলেটের দক্ষিণ সুরমা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন।
বাংলাদেশি চিকিৎসকের দেয়া ওই ইমেইলের পাঁচ দিন পর এর জবাব দিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ডা. সাঈদ এনাম বলেন, জাসিন্ডা আরডার্ন আমার সেই মেইলের রিপ্লাই দিয়ে ধন্যবাদ দিলেন। এটা অটো রিপ্লাই নয়। সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ধন্যবাদ ও মতামত জানানো হয়। আমার মতো একজন ব্যক্তির মেইলের জবাব দিয়ে তিনি আবারো প্রমাণ করলেন, তিনি সত্যিই একজন মহানুভব নেতা।
তিনি জানান, নিউজিল্যান্ড প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার কার্যালয়ের একান্ত সচিব ডায়না অকেবা ডা. সাঈদ এনামকে মেইলটি প্রেরণ করেন।
ডা. সাঈদ এনামের সেই মেইলের জবাবে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন তা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
ধন্যবাদ তোমাকে মেইলের জন্য, নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এমন সময়ে হাজারো মানুষের সমর্থন সাহসে আর পাশে পেয়ে অনুপ্রাণিত।
নিউজিল্যান্ড প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশি চিকিৎসকের উদ্দেশে বলেন, ‘এখন আমার সব ধ্যান তাদের ঘিরে যারা এই ঘটনায় অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মধ্যে রয়েছেন। সমগ্র নিউজিল্যান্ডবাসীর মতো আমিও আমার হৃদয়ের সব ভালোবাসা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের পাশে রয়েছি। এবং আমি এও বলছি, আমি তাদের পাশে আছি।’
‘আমার সব চিন্তা ভালোবাসা তাদের ঘিরেই যারা এ ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং তাদের প্রতি আমার এ ভালোবাসা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা থাকবে আজীবন।’
‘নিউজিল্যান্ডের জন্য এটা এখন বিষাদময় সময়। এমন পরিস্থিতির সম্মুখে আমরা কখনও মুখোমুখি হয়নি, কিন্তু এমন মুহূর্তে দেশ ও দেশের বাইরে সবার সহমর্মিতা ভালোবাসা পেয়ে আমার মনে হচ্ছে আমরা সবাই এক। সব শক্তি নিয়ে আমাদের সবাইকে এগিয়ে যেতে হবে। আপনাকে আবারও ধন্যবাদ পাশে থাকার জন্য।’
কাউকে মেইল করলে বা হ্যালো বললে ন্যূনতম ভদ্রতা হলো, ‘ধন্যবাদ’ বলে উত্তর দেয়া সে যেই হোন। এ সৌজন্যতা বোধটুকু খুব কম মানুষের মধ্যে দেখা যায়। বেশ ক’জন বিখ্যাত লোকদের সামাজিক ভালো কাজের প্রশংসা করে মাঝেমধ্যে মেইল দিলে দেখি তারা বেশ রেসপন্স করেন। আমি তেমন কেউ নই যে আমার মতামত বা প্রশংসা আদৌও এমন কোনো গুরুত্ববহন করে যে উনারা সময় নষ্ট করে এর উত্তর দেবেন। কিন্তু না, তারা বেশ উত্তর দেন।
গত শুক্রবারে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে মসজিদের এক শ্বেতাঙ্গ জঙ্গির হামলার প্রায় ৫০ জন ধার্মিক মুসল্লি শহীদ হন। বাংলাদেশে ওই সময় সকালবেলা আমি তখন চেম্বারের পথে। ফেসবুকে দেখলাম একজন স্ট্যাটাস দিল, ‘আমাদের সোনার ছেলেদের খেলার দরকার নেই, নিউজিল্যান্ড থেকে ওদের ফিরিয়ে আনুন…, ব্লা ব্লা ব্লা…’। প্রথমে বুঝিনি, সময় যত গড়াতে লাগল দেখলাম বাকি সব ইতিহাস।
বিকালে ফিরতি, আবার আরেক বন্ধু দেখলাম তার ওয়ালে অস্ট্রেলিয়ান এক সিনেটরের বক্তব্য হুবহু শেয়ার করল। স্বাভাবিকভাবে ধরে নিয়েছিলাম এটা হয়তো, ‘আহা… উহু..’ ‘ইস… হায়… হায়…’, এ জাতীয় কিছু থাকবে। তারপরও ধৈর্য নিয়ে পড়লাম। পড়ে প্রথমে মনে হলো এটা আসলে গুজব বা ফটোশপের কাজ। একজন সিনেটর বিবৃতি এটা নয়। দায়িত্বশীল পদে থেকে এ রকম ‘আবালের’ মতো বিবৃতি দিতে পারেন না। ‘মুসলমানেরা জঙ্গি এটা তাদের অতীত কর্মের ফল’।
মনে মনে ভাবলাম এ আর নতুন কি। এ রকম-ই তো হয়ে আসছে গত কয়েক যুগ। না, এবার একটু ভিন্ন স্রোত দেখলাম নিউজিল্যান্ডের নেতা নেতৃত্বের। বোধহয় দেশটি নিউজিল্যান্ড তাই।
আবার রাতের বেলা বাসায় এসে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর হত্যার শিকার ও ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি একের পর ভূমিকা দেখে আবেগাপ্লুত হলাম। না হওয়ার কারণ ছিল না। এ রকম অতীতে দেখা যায়নি। সবাই এক বাক্যে, ‘ওরা সব জঙ্গি’ বলেই উড়িয়ে দিত।
কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। তাহলে এখনো পৃথিবী থেকে বিবেক বিবেচনা, মানবতাবোধ হারিয়ে যায়নি। এখনো অনেক মানুষ রয়েছেন যারা পারেন দলমত ধর্মের ঊর্ধ্বে ওঠে নিজের সত্য সাহসী মতপ্রকাশে কুণ্ঠাবোধ করেন না। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে, সমস্যার গভীরে না গিয়ে বরং নিজের ফায়দা লুটতে বানরের পিঠা ভাগের মতো উল্লাসে মেতে ওঠেন না।
সত্যিকার অর্থেই নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে, ষড়যন্ত্রে গা না ভাসিয়ে বিশ্বে মহানুভবতার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।
মুসলিমরা আসলেই ষড়যন্ত্রের শিকার। ইসলাম ধর্মকে জঙ্গিবাদ হিসেবে ট্যাগ দেয়ার এক গভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে সেই আশির দশক থেকে। আগে এতে কিছুটা রাখঢাক ছিল। এখন তা প্রকাশ্যেই হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে কিছু কিছু মোনাফেক মুসলিম ও এদের সঙ্গে জোট বেঁধেছে। এসব মোনাফেক রাসূলের সময় ছিল, এখনও আছে; ভবিষ্যতেও থাকবে।
তবে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্নের সত্য সাহসী উল্টো স্রোতের ভূমিকা, এসবের ভিডিও ক্লিপ, বক্তব্য, বিবৃতি সারা বিশ্বে জঙ্গিবাদের স্বরূপ উদঘাটন করে দিয়েছে। বিশেষ করে তিনি যখন বললেন, ‘এর নাম আমি মুখে নেব না…, কারণ সে সন্ত্রাসী, সে মার্ডারার…’।
ইসলামে জঙ্গিবাদের কোনো স্থান নেই। ইসলাম শান্তির ধর্ম। অন্যায়ভাবে একটা প্রাণীকে কষ্ট দেয়া বা হত্যা করা হারাম। কোনো ধর্ম প্রতিষ্ঠানে প্রার্থনারত কাউকে আঘাত করা হারাম এমনকি যুদ্ধের ময়দানে দৈবাৎ ধর্ম প্রতিষ্ঠানে যদি কেউ আশ্রয় নিয়ে থাকে, তাকেও আঘাত করা হারাম। হোক না সেটা মন্দির, মসজিদ, চার্চ বা প্যাগোডা। এ জন্যই ইসলামকে বলা হয় শান্তির ধর্ম। হজরত মুহাম্মদ (সা.) শান্তির জন্য অনেক সময় নিজের ক্ষতি মেনে নিয়েও সন্ধি চুক্তি করে নিতেন, যদি কোনোমতে শান্তি বজায় রাখা যায়।
প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন এর ভূমিকা ও কিছু বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাকে ওই সময় আধাপাতার একটা মেইল করে ছিলাম। মূল বিষয় ছিল তার কাজগুলোকে সমর্থন, আর সত্য প্রকাশে সাহসী ভূমিকা প্রকাশে।
তার অফিস থেকে প্রথমে রিপ্লাই আসে, ধন্যবাদ মেইলের জন্য। আমরা দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর কাছে তোমার বার্তা পৌঁছে দেব, ইত্যাদি, ইত্যাদি…। অটো রিপ্লাই এ যা লিখা থাকে। লং লিভ জাসিন্ডা আরডার্ন…।
উল্লেখ্য, গত ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের আল নুর ও লিনউড মসজিদে বন্দুকধারীর হামলায় নিহত হন ৫০ জন। কট্টর শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদী ২৮ বছরের ব্রেনটন ট্যারেন্ট এ হত্যাযজ্ঞ চালায়। নিহতদের মধ্যে ৫ জন বাংলাদেশি ও ৯ জন পাকিস্তানের নাগরিক রয়েছেন।