খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে বিদেশিদের জানাবে বিএনপি, যেতে পারে আন্দোলনে

সালমান তারেক শাকিল.
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করছে বিএনপি। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দলীয় প্রধানের শারীরিক অসুস্থতার কারণে তার চিকিৎসার নিশ্চয়তা তৈরি করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে একাধিক। প্রথম দফায় ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিদের ডেকে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের বিষয়টি অবহিত করবে বিএনপি। একইসঙ্গে পছন্দমতো চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ দিতে সরকারকে চাপ দেওয়ার অনুরোধও জানাবে দলটি।
বিএনপির নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার বর্তমান শারীরিক অবস্থা শোচনীয়। তিনি নিজে বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণে অপারগ। এক্ষেত্রে তার পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতাল। স্থায়ী কমিটির দু’জন সদস্য গত শুক্রবার (১৫ মার্চ) কারাগারে খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে তার মনোভাব বোঝার চেষ্টা করেন। তখন তাকে বিএসএমএমইউতেই ভর্তি হওয়ার অনুরোধও করেন তারা। যদিও শনিবার (৩০ মার্চ) রাতে স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান, খালেদা জিয়া এখনও তার সিদ্ধান্তে অনড় আছেন।’
ইতোমধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর খালেদা জিয়ার জীবনাশের আশঙ্কা করেছেন।
বিএনপি নেতারা জানান, দলের নীতিনির্ধারকরা ইতোমধ্যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা ও মুক্তির বিষয়টিকেই তারা রাজনৈতিকভাবে প্রাধান্য দেবেন। এ বিষয়ে প্রথম হচ্ছে, দলীয় প্রধানের পছন্দানুযায়ী তার চিকিৎসা নিশ্চিত করা। এ কারণে বিদেশিদের দিয়ে সরকারকে অনুরোধ করানোর বিষয়টি সবার আগে গুরুত্ব পাচ্ছে।
শনিবার বিকালে রাজধানীর গুলশানের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বিএনপির ফরেন উইংয়ের একটি জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও উইংয়ের টিম লিডার আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী না থাকলেও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে। বৈঠকে অংশ নেওয়া এফএসি’র অন্তত ৫ জন সদস্য জানিয়েছেন, আগামী ৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকদের ডেকে এনে ব্রিফ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। সেদিন ব্রিফে কেবলমাত্র খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার বিষয়টিই থাকবে।
ফরেন উইংয়ের একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, ব্রিফিংয়ে বিদেশিদেরকে কাছে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা হবে। তাদের জানানো হবে যে, ‘‘চেয়ারপারসনের শারীরিক অবস্থার অনেক অবনতি হয়েছে। খালেদা জিয়া ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে রিউমাটোয়েড আর্থাইট্রিস, ২০ বছরের বেশি সময় ধরে ডায়বেটিস মেলিটাস এবং গত পাঁচ ধরে হাইপারটেনশন ও আয়রন স্বল্পতা ও অ্যানেমিয়াতে ভুগছিলেন। (৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮) কারা জীবন শুরুর পর তিনি কিডনির রোগ ও লিভার অ্যাইলমেন্টে আক্রান্ত হয়েছেন। বারবার অনুরোধের পর অধ্যাপক আব্দুল জলিল চৌধুরী, ডা. শামীম আহমেদ, ডা. ফাতেমা পারভীন, ডা. চৌধুরী ইকবাল মাহমুদ ও ডা. বদিউজ্জামানের সমন্বয়ে গঠিত মেডিক্যাল বোর্ড গত ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ তারিখে তাকে দেখতে যান। এই মেডিক্যাল বোর্ডের সঙ্গে গিয়েছিলেন ডা. কে জামান ও ডা. মাহমুদুল হাসান। বোর্ডের সদস্যরা তার মেরুদণ্ডের দৃশ্যমান ক্ষয় ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গের দুর্বলতা দেখেছেন। তারা দ্রুত তার মেরুদণ্ডের এমআরআই ও কয়েকটি পরীক্ষা এবং হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেন। ১২ মার্চ পরীক্ষা করা হয়। এসব পরীক্ষায় দেখা গেছে তার সুগার বাড়ছে, কোলেস্টরেলও বাড়ছে। সবচেয়ে বিপদজনক হলো কিডনির কার্যকারিতা পরীক্ষায় ৩ ধরনের রোগ ধরা পড়েছে।’’
আন্তর্জাতিক উইংয়ের একাধিক সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, খালেদা জিয়ার পছন্দমতো চিকিৎসা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনও উদ্যোগ না নিলে আন্দোলনে নামবে বিএনপি। ইতোমধ্যে দলের সর্বস্তরে পরিষ্কার, খালেদা জিয়াকে আন্দোলন ছাড়া মুক্ত করা যাবে না। আর এ বিষয়টিই বিদেশিদের জানাবে বিএনপি। তাদের অনুরোধ করবে, সরকারকে বোঝাতে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু  বলেন, ‘সরকারের যদি চিকিৎসার ইচ্ছা থাকে তাহলে শেখ হাসিনার পথ অনুসরণ করতে পারেন। শেখ হাসিনা কেয়ারটেকার সরকারের সময় স্কয়্যার হাসপাতালে গেছেন, প্যারোলে বিদেশে গেছেন। যিনি রোগী, তাকে ওই সরকার গুরুত্ব দিয়েছে। বিষয়টাকে গুরুত্ব দিয়ে যদি তারা দেখে, তাহলে তো মীমাংসা হয়ে যায়।
তারা তাদের মতো চিকিৎসা করতে চায়, রোগী যদি সেই চিকিৎসাকে গুরুত্বহীন মনে করে, নিতে না চায়, তাহলে তো আর পথ থাকে না। সেজন্য আমি মনে করি, রোগীর ইচ্ছাকে যদি সরকার প্রাধান্য দেয়, তাহলে মীমাংসা হয়ে যায়।’
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হাসান জীবন বলেন, ‘আমরা ম্যাডামের মুক্তির বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিচ্ছি। সরকার অন্যায্যভাবে তাকে আটক করে রেখেছে।’
ফরেন উইং সূত্র জানায়, বিদেশিদের কাছে বিএসএমএমইউ’তে রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টি তুলে ধরা হবে। একইসঙ্গে ইউনাইটেড হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরবে বিএনপি।
বিএসএমএমইউ’র কয়েকটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, খালেদা জিয়ার মেডিক্যাল টিম পুনর্গঠন হতে পারে। তবে বিষয়টি নিশ্চিত নয়। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির ডাইরেক্টর জেনারেল পদে পরিবর্তন এবং মেডিকেল টিমের প্রধান অবসরে যাওয়ায় এ পরিবর্তন আসতে পারে।
বিএসএমএমইউ’র মেডিকেল টিমের প্রধান অধ্যাপক আবদুল জলিল চৌধুরী জানান, ‘তিনি সম্প্রতি অবসরে চলে গেছেন। এখন তাকে খালেদা জিয়ার মেডিক্যাল টিমে রাখা হবে কিনা, তা নিশ্চিত নন। তার ভাষ্য, ‘আমাকে রাখবে কিনা, আমি তো জানি না। তবে আমি কিছুদিন হলো অবসরে, এর মধ্যে বিএনপির চেয়ারপারসনের স্বাস্থ্যের কোনও পরীক্ষা হয়েছে কিনা, জানি না।’
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল টিম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যপরীক্ষা করে। এরপর ১২ মার্চ পরীক্ষা করা হয়।
বিএসএমএমইউ’র নতুন ডাইরেক্টর জেনারেল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাহবুব  বলেন, ‘এ বিষয়ে আমাকে জানতে হবে। আমিও পরিষ্কারভাবে বিষয়টা জানি না। একটা মেডিক্যাল টিম আছে। তবে আমি আসার পর কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।’
বিএনপির নেতারা জানান, খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টিকে জোর দিয়ে দলীয় রাজনৈতিক কর্মসূচি পরিচালিত করবে বিএনপি। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকেও ভূমিকা জোরালো করার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
বিএনপির একজন দায়িত্বশীল বলেন, ‘খালেদা জিয়া দুই কারণে সুচকিৎসা পান। প্রথমত, তিনি দেশের রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু। তার রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনা করে, রাজনৈতিক যে অবদান, এরশাদবিরোধী আন্দোলনে কিংবা দ্বাদশ সংশোধনী করেছেন সবার সম্মতিতে, বিরোধী দলের দাবি গ্রহণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি চালু করেছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি তো বিশিষ্ট নাগরিক, তার সুচিকিৎসার বিষয়ে সরকার উপেক্ষা করলে তার পরিণাম অনুনমেয়।’
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট রবিবার (৩১ মার্চ) বিকালে স্বাধীনতা দিবসের আলোচনা সভার ব্যনারে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টিকে রাখছে। আগে ফ্রন্টের কর্মসূচিগুলোয় নেতারা বক্তব্যে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টি আনলেও ব্যানারে বিষয়টির অনুপস্থিত ছিলো।
ঐক্যফ্রন্টের প্রধান সমন্বয়ক, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোস্তফা মহসীন মন্টু  বলেন, ‘আমরা নতুন করে খালেদা জিয়ার বিষয়ে বলছি না, শুরু থেকেই, সভা-সেমিনারে, সমাবেশে তার মুক্তির বিষয়টি এবং সাত দফা দাবিতেও তার মুক্তির বিষয়টি প্রথম। এটাও একটা সংযোজন, যে ব্যানারে মুক্তির বিষয়টি থাকবে। এটা নতুন কিছু না, তার মুক্তির বিষয়ে আমরা সোচ্চার আছি।’
বিএনপির চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বেগম জিয়ার যে অবদান এবং তার স্বাস্থ্যের বর্তমান যে অবনতি- তাতে তার সুচিকিৎসার বিষয়টি সবার আগে বিবেচ্য বিষয়। তার দ্রুত সুচিকিৎসা দাবি করছি।’
শেয়ার করুন