শ্রীমঙ্গল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স: শয্যা বেড়েছে, জনবল জোটেনি

এম ইদ্রিস আলী, শ্রীমঙ্গল :: মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি সাতবছর আগে  ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত অতিরিক্তি লোকবলের অনুমোদন মেলেনি। বরং ৩১ শয্যার হাসপাতাল অনুযায়ী প্রয়োজনীয় লোকবলও এই হাসপাতালে নেই। ফলে সরকারী এই হাসপাতালটিতে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে রোগীরা।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, প্রায় সাড়ে তিন লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ উপজেলায় মাত্র ৫ ডাক্তার দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে চলছে  চিকিৎসা সেবা।  অন্যদিকে সরকারী স্বাস্থ্যসেবা বঞ্চিত হয়ে ডেলিভারী রোগীরা স্থানীয় ক্লিনিকে যাচ্ছে। এ সুযোগে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে পকেটভারী করছে সংশ্লিষ্টরা। স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সটির জুনিয়র কনসালট্যান্ট সার্জারী পদটি শুন্য। ওই পদে ছিলেন মেডিকেল অফিসার ডাঃ শামীমা জাহান। ৭/৮ মাস আগে তিনি জেলাসদর হাসনপাতালে বদলী হন। বছর খানেক ধরে আবাসিক মেডিকেল অফিসার পদটিও শুন্য আছে। মেডিকেল অফিসার ডাঃ মিনাক্ষী দেব নাথ দীর্ঘদিন অন্যত্র প্রেষণে থাকার পর সপ্তাহখানেক আগে জেলা সিভিল সার্জন অফিসে পুরোপুরি পদায়ন করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে এ পদটিও শুন্য রয়েছে। ডেন্টাল সার্জন ডাঃ মো: শামীম হোসেন। তিনি সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রেষণে তিন মাস আগে চলে যান। অথচ বেতন তুলছেন শ্রীমঙ্গল স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স থেকে। আরেকজন মেডিকেল অফিসার (হোমিও) ডাঃ মঈন উদ্দিন আহমদ(মামুন)। তিনি দুই বছর ধরে ডেপুটেশনে চলে যান ঢাকা হোমিও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সপ্তাহের একদিন অর্থাৎ প্রত্যেক বৃহস্পতিবারে শ্রীমঙ্গলে স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে আসেন তিনি। ওই দিন একটু সময়দিয়ে আবার পরদিন তিনি ঢাকায় চলে যান। কিন্তু প্রতিমাসে বেতন নেন শ্রীমঙ্গল স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স থেকে।

এদিকে উপজেলার ৯ ইউনিয়নের নয়টি উপস্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের মধ্যে ৮টিতেই কোনো মেডিকেল অফিসার পোষ্টিং নেই। একমাত্র হুগলীয়া উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে মেডিকেল অফিসার ডাঃ শুভ্র তুষার সিং পদায়ন থাকলেও তিনি কর্তৃপক্ষের মৌখিক নির্দেশে শ্রীমঙ্গল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বহি:বিভাগে ও জরুরী বিভাগে প্রেষণে কর্মরত আছেন।

স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পরিসংখ্যানবিদ এটিএম আনোয়ার গাজী বলেন,‘ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে মেডিকেল অফিসার পদটি এক থেকে তিন বছর যাবত খালি রয়েছে। এসব কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসারগণ উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে ভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বদলী  হয়ে চলে গেছেন। বর্তমানে সাব অ্যাসিসটেন্ট (সেকমো) ডাক্তার দ্ধারা উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলো স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছে। ৫০ শয্যায় উন্নীত স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেটির ৫০ শয্যার কোনও জনবলের মঞ্জুরী আজঅবধি পাওয়া যায়নি। উপরন্তু ৩১ বেডের ১১টি পদের মধ্যে আরএমও,মেডিকেল অফিসার ও জুনিয়র কসসালটেন্ট (সার্জারী)সহ তিনটি পদ শুন্য রয়েছে। মেডিকেল অফিসার হোমিও ও ডেন্টাল সার্জন এই দুইজন অন্যত্র প্রেষণে রয়েছেন। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্য পরিদর্শকের তিনটি পদ শুন্য রয়েছে। ফলে মাঠ পর্যায়ে ইপিআই ও অন্যান্য কার্যক্রমের সুপারভিশন ও মনিটরিং ব্যাহত হচ্ছে।

জানা যায়,২০১২ সালের ১লা ডিসেম্বর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রীমঙ্গলের ৩১ বেডের এই হাসপাতালটিকে ৫০ বেডে উন্নীত করার ঘোষণা দেন। এর পর দীর্ঘ ৬ বছর পার হয়ে গেলেও ৫০ বেডের জনবল আজও মঞ্জুরী প্রদান করা হয়নি। উল্টোস্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটিতে ৩১ বেডের জনবলরেই সংকট রয়েছে। ফলে এই উপজেলার মানুষজন কাঙ্খিত স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছেন না। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনোমতে চলছে স্বাস্থ্যসেবা। স্বাস্থ্য কর্মকর্তা প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকায় বাকী ৫ ডাক্তার দিয়ে ওটি,বহি:বিভাগ,অন্ত:বিভাগ ও জরুরীবিভাগের কাজ কোনো মতে চলছে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বহি:বিভাগে ডাক্তার স্বল্পতার কারণে মেডিকেল অফিসারদের সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। আগে ৩১ বেডে থাকাকালীন অন্ত:বিভাগে পুরুষ ও মহিলা ওয়ার্ড ছিল। বর্তমানে ৫০ শয্যায় উন্নীত হওয়াতে এই দুটি ওয়ার্ডসহ শিশু ওয়ার্ড ও পোষ্ট অপারেটিভ ওয়ার্ড  নতুন করে চালু করা হয়।

হাসপাতালটিতে প্রতিমাসে বহি:বিভাগে প্রায় ৬ হাজার,অন্ত:বিভাগে ১ হাজার এবং জরুরী বিভাগে প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন রোগীর সেবা প্রদান করা হয়। ডাক্তার স্বল্পতার কারণে মাত্র তিনজন মেডিকেল অফিসার দ্বারা জরুরী বিভাগের ২৪ ঘন্টার চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এতে আগত রোগীদের সুষ্ঠু চিকিৎসা সেবা পাওয়ার অভিযোগ সব সময়ই লেগেই আছে। এই হাসপাতালে প্রতিমাসে ২৫ থেকে ৩০টি সিজারিয়ান অপারেশন সম্পাদিত হয়। নরমাল ডেলিভারী হয় প্রতিমাসে ১৫০ জনের। ওটি,ইনডোর ও ইর্মাজেন্সি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা বেশীরভাগ সময় ব্যস্ত থাকায় বহি:বিভাগের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। ফলে রোগীরা প্রতিনিয়ত:প্যারামেডিক্স ডিপ্লোমাধারী চিকিৎসকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন।

হাসপাতালটিতে আল্টাসনোগ্রাম মেশিন সরবরাহ থাকলেও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তারের অভাবে সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এই মূল্যবান মেশিনটি দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। একমাত্র এক্স রে মেশিনটি দীর্ঘ পাঁচবছর ধরে বিকল রয়েছে। টেকনেশিয়ান পদটিও অনেকদিন ধরে শুন্য।

হাপাতালটির প্যাথলজিস্ট দুইজন থাকলেও অভিজিৎ বণিক দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেষণে চলে গেছেন। কিন্তু প্রতি মাসের তিনি বেতন তুলছেন শ্রীমঙ্গল হাসপাতাল থেকে।

এই হাসপাতালটিতে ডেন্টাল সার্জন,মেডিকেল অফিসার(হোমিও) এবং মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) এই তিনটি পদে পদায়ন করা হলেও তারা প্রেষণে অন্যত্র কাজ করছেন কিন্তু নিয়মিত বেতন নিচ্ছেন শ্রীমঙ্গল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে। ফলে হাসপাতালের এই তিনটি পদ শুন্য দেখাতে না পারায় এসব পদে নতুন কাউকে পোস্টিং দেয়াও সম্ভবপর হচ্ছে না।

সুপেয় পানির অভাব: হাসপাতালে রোগীদের সুপেয় পানিয় জলের তীব্র সংকট রয়েছে। হাসপাতালটির গভীর নলকূপের পানি আয়রণ যুক্ত হওয়াতে রোগীরা এসব পানি পান করেন না। আয়রণযুক্ত পানির আবরণের প্রলেপ পড়ে বাথরুম ও বেসিনের অবস্থা লালচে দাগ পড়ে আছে।

জানতে চাইলে গত ৩১ জানুয়ারী শ্রীমঙ্গল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ইউএইচও হিসেবে সদ্য যোগদানকারী ডাঃ সাখাওয়াৎ হোসেন বলেন,‘শুধু জেলা বলব না,সিলেট বিভাগের মধ্যে একটি ভিজি উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স শ্রীমঙ্গল। প্রতিদিন আউটডোরে প্রায় ৩০০ মতো রোগী দেখা হয়। অন্ত:বিভাগে ৫০টি বেডের মধ্যে ৫০টিই রোগীতে পূর্ণ থাকে। আরএমও’র মতো গুরুত্বপূর্ণ পোষ্ট খালি রয়েছে। ডেন্টাল সার্জন,মেডিকেল অফিসার(হোমিও) এবং মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) এই তিনটিপদে পোস্টিং দেয়া হলেও তারা প্রেষণে অন্যত্র কাজ করছেন। অথচ তারা শ্রীমঙ্গল থেকে বেতন নিচ্ছেন। এসব পদে উনারা আঁকড়ে থাকায় নতুন করে কাউকে পোস্টিং নিয়ে আসাও সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি বলেন,‘হাসপাতালটিতে বর্তমানে ৩১ বেডেরই ম্যানপাওয়ার নেই,অথচ ৫০ বেডে রান করে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ডাক্তার ও অন্যান্য শুন্য পদ দ্রুত পূরণসহ ৫০ বেডের জনবল মঞ্জুরী পাওয়া গেলে রোগীদের সেবাপ্রদান আরো উন্নত করা যাবে’।

শেয়ার করুন