বিটিভি ও আমরা-

 

আমাদের বাড়িতে যখন প্রথম টিভি এলো তখন তুমুল উৎসব শুরু হয়ে গেলো। ঘরের মধ্যে টিভি রেখে একা একা দেখার উপায় ছিল না। সন্ধ্যা হলেই পাড়ার লোকজন চলে আসতো টিভি দেখতে। তাই টিভি রাখা করা হতো বারান্দায়। আর উঠোন জুড়ে সবাই বসতো।

এভাবে টিভির জন্য যে এত মানুষের ভিড়, তার জন্য মাকে কখনো বিরক্ত হতে দেখিনি। তখন ব্যাটারি চার্জ দেয়ার জন্য থানায় যেতে হতো। যারা টিভি দেখতে আসতো, তারাই অনেক সময় মনের আনন্দে এই কাজটা করতো। ব্যাটারি চার্জ করে আনতেও কয়েকদিন লেগে যেতো। সেই দিনগুলোতে প্রতিদিনই বাড়ির আশেপাশের লোকজন এসে ফিরে যেতো। তাদের অপেক্ষা যেন শেষ হতে চাইতো না।

আর ছিল ঝিরি ঝিরি। সেটা ঠিক করার জন্য এ্যান্টেনা ঘুরাাতেও কেউ কেউ ওস্তাদ হয়ে উঠেছিল। কোন কোন সময়, হঠাৎ করে সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যেতো। তখন লাল নীল পর্দার মতো দেখা যেতো। লেখা থাকতো-

‘যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে সম্প্রচারে বিঘ্ন ঘটনায়
আমরা দু:খিত। অনুগ্রহপূর্বক অপেক্ষা করুন।

সেই বিটিভিতেই ‘ঢাকায় থাকি’, ‘এইসব দিনরাত্রি’র মতো নাটক বা ম্যাকগাইভারের মতো অনুষ্ঠান দেখা আমাদের।

আমাদের গ্রামে প্রথম রঙীন টিভি এলো ছোট চাচার বাড়িতে। রঙীন টিভি মানে টিভির স্ক্রীনের সামনে একটা নীল রঙ এর প্লাস্টিকের মতো কাঁচ ঝুলিয়ে দেয়া। তখন রঙীন মানে শুধুই নীল।

অনেকদিন উঠোনে টিভি দেখার পর, ঘরের মধ্যে সেটা রাখা গেলো। স্থান হলো আমার বড় ভাই এর ঘরে। শুক্রবার এলে সাপ্তাহিক বাংলা সিনেমা দেখার জন্য কে আগে এসে সেই ঘরের মেঝেতে জায়গা দখল করবে তার প্রতিযোগিতা শুরু হতো।

আমরা এই সময়ে এসে কথায় কথায় বিটিভিকে নিয়ে সমালোচনা করি। বাম্পার ফলনের খবর নিয়ে ট্রল করি। কিন্তু বিটিভির অবস্থান কি কখনোই এর বাইরে ছিল? কখনোই কি বিটিভি কোন সরকারের কাজের সমালোচনা করেছিল? করেনি সম্ভবত:।

১৯৮৮ সালের বন্যার সময় একটা গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।

‘তোমাদের পাশে গিয়ে সব ব্যথা বুকে নিয়ে আমিও যে হবো ব্যথাগার …. আজকের চেষ্টা আমার’

ঐ গানের মডেল ছিল স্বয়ং এরশাদ। তখন তিনি রাষ্ট্রপতি।

পৃথিবীর সব দেশেই হয়তো এমনটাই হয়। আমি জানি না, কোন দেশে এমন কোন সরকারি বা স্বায়ত্বশাসিত চ্যানেল চ্যানেল আছে কি না যেখানে সরকারের কাজের সমালোচনা করা হয়।

তাহলে বিটিভি কেন আমাদের টার্গেট?

এখন দেশে কয়েক ডজন চ্যানেল। হাতে রিমোট। চাইলেই যে কোন চ্যানেলে পছন্দের অনুষ্ঠান দেখতে পারে দর্শক। মানুষ বিটিভির দিকে মনে হয় ঘুরেও তাকায় না।
যে চ্যানেলটা আমি দেখিই না, তার নিরপেক্ষতা যাচাই করাটা আসলে কাজ না থাকার সময় খই ভাজার মতোই মনে হয় আমার কাছে।

সেই সাদাকালো বিটিভিকে ভালোবাসি আমি। আমার শিশু বয়সের স্মৃতিতে সেটা রঙীন হয়েই থাকবে।

মনজুরুল করিম ,ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন.

শেয়ার করুন