মৌলভীবাজার প্রতিনিধি.
নেই বালুর ইজারা, শ্রীমঙ্গল উপজেলা-জুড়ে চলছে বালু উত্তোলনের মহোৎসব। বালু উত্তোলনের কারনে একদিকে যেমন পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে, এলাকার রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ ধ্বংস হচ্ছে।
অন্যদিকে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার। কৃষি জমি নষ্ট করে বালু অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে বিক্রি করে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা বালু বিক্রি করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। বালু উত্তোলনের তথ্য জানলেও বালু বিক্রির তথ্য জানলেও রাজনৈতিক কারণে নিরব রয়েছেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম।
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী বালুমহাল ছাড়া পাম্প, ড্রেজিং বা অন্য কোন মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ বালু বা মাটি উত্তোলন করা যাবে না।
কিন্তু এই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গলি দেখিয়ে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ফসলি জমি থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে আশপাশের ফসলি জমি ও সড়ক ধসে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া কাছাকাছি থাকা কয়েকটি বসতঘরও হুমকির মধ্যে রয়েছে। স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যানরা।
জানা গেছে, শ্রীমঙ্গল উপজেলায় একটি সাধারণ বালু ও ২৮টি সিলিকা বালুসহ মোট ২৯টি বালুর মহাল রয়েছে। এর মধ্যে বড়ছড়া,ঝলমছড়া,ভুরভুরিয়া ছড়া, জৈনকাছড়া, খাইছড়া, শাওনছড়া, নুলুয়াছড়া, পুটিয়াছড়া, হুগলিছড়া, গান্ধিছড়া ও আমরাইলছড়াসহ ৫/৬ বছরের বেশি সময় ধরে শ্রীমঙ্গলে বালু উত্তোলনে ইজারা বন্দোবস্ত নেই।
অথচ উপজেলা জুড়ে পাহাড়ি ছড়া, ছোট নদী ও ফসলি জমি থেকে চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন। উচ্চ আদালতে পরিবশেবাদী সংগঠন বেলা মহামান্য হাইকোর্টে একটি রিট করেন। যার ফলে শ্রীমঙ্গলে বালু মহালের ইজারা বন্দোবস্ত বন্ধ রয়েছে। কিন্তু ইজারা বন্দোবস্ত না থাকলেও বালু উত্তোলন থেমে নেই। এতে গত ৫/৬ বছরে সরকার এই খাত থেকে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছেন।
ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ও বালু দস্যুরা প্রশাসনিক নিষেধাজ্ঞা তোয়াক্কা না করে অবাধে বালু উত্তোলন করায় রাস্তা-ঘাট,ব্রীজ কালভার্ট,ছড়া ভাঙ্গন, ফসলি জমি হুমকির মুখে পড়েছে। তেল-গ্যাস পাইপের জাতীয় গ্রীড লাইন পড়েছে হুমকির মুখে। একই সঙ্গে পরিবেশের ওপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শুধু ছড়ার বালু নয়। বালু দস্যুদের থাবা পড়েছে এবার কৃষি ও সরকারী খাস জমিতে। বলু দস্যুরা এস্কেভেটর ও ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে মাটি কেটে সমতল ও কৃষি ভূমি উজার করছে।
মাটির ৩০-৪০ ফুট গভীরে গর্ত করে মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করছে। ফলে এলাকার ফসলি জমি উজার হয়ে যাচ্ছে। উপজেলার ভূনবীর ইউপির জৈতা ছড়ার দু’পাশ ঘেঁষে শাসন, ইসলামপাড়া ও ইছামতি গ্রাম এলাকায় সরেজমিন ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।
ইসলামপাড়া এলাকার দয়াল মিয়ার ছেলে তারেক মিয়া, ইদ্রিস মিয়ার ছেলে কবির মিয়া অভিযোগ করে বলেন, ‘বালু উত্তোলনের ফলে রাস্তাঘাটের ক্ষয়ক্ষতি ও কৃষি জমি ধ্বংস হওয়ায় বার বার অভিযোগ করা হলেও প্রশাসনের পক্ষে জোরালো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। এসব বালু মহাল থেকে স্থানীয় সরকারী দলের নেতারা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে লাখ লাখ টাকার বালু দীর্ঘদিন ধরে বিক্রি করে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছেন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, জৈতা ছড়ার দু-পাশে নোম্যান্সল্যান্ড ও ব্যক্তি মালিকানা জমিতে পুকুর সমান গর্ত করে মেশিন লাগিয়ে বালু মাটি উত্তোলন করছেন স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও ভূনবী ইউনিয়নের পরিষদের চেয়ারম্যান মো. চেরাগ আলী। এই বালু মাটির বেচা কেনার মূল হোতা তিনি ও তার ছেলে কাউছার আলী। নো নোম্যান্সল্যান্ড ও স্থানীয় দরিদ্র কৃষকদের মালিকানা জমি থেকে অল্প দামে এসব বালু মাটি ক্রয় করছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, আওয়ামীলীগ নেতা ইউছুফ আলী ও ইউপি চেয়ারম্যান চেরাগ আলী ছাড়াও সাতগাঁও এলাকার কবির মোল্লা, কদর আলী, আসলম মিয়া, ঠান্ডা মিয়া, মতলিব, আবু নাঈম, সিদাম, সামছু, জমির আলী, ইমান আলী, মুসাহিদ মিয়া, উজ্জল মিয়া, সাদ্দাম, মুকাইদ, ইয়াবর মিয়া, জামাল মিয়া, দুদু মিয়া, ইব্রাহিম আলীসহ রাজনৈতিক নেতারা এই অবৈধ বালু ব্যবসার সঙ্গে জড়িত রয়েছেন।’
এবিষয়ে ইউপি চেয়ারম্যানের চেরাগ আলী বলেন, ‘আমি ছড়া থেকে বালু উঠাই না । জমির মালিকদের কাছ থেকে বালু মাটি কিনে অন্য জায়গায় বিক্রি করি।’
একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে পরিবেশ প্রকৃতির ক্ষতি করে কিভাবে অবৈধ বালু ব্যবসা করেন-এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান চেরাগ আলী বলেন ‘হ্যাঁ এতে ক্ষতি হচ্ছে, তবে এখানে বালুর সঙ্গে বড় বড় লোকজন জড়িত আছেন।’
বড় বড় লোকজন কারা জড়িত- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা তো সবই জানেন। আমাকে জিজ্ঞেস করেন কেন?’
বালু ব্যবসায়ী মোছাব্বির মিয়া বলেন, ‘শুধু আমি নয় এই বালু উত্তোলনের সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও জড়িত আছেন।’
তিনি বলেন, ‘উপজেলা যুবলীগের নেতা শিপলু ভাই সিন্ডিকেট লিয়াঁজো করে আমাদের বালু উত্তোলনের করে দিচ্ছেন। ‘এ সিন্ডিকেটে আমি প্রতি মাসে ১০/১৫ হাজার টাকা দেই’ বলে জানান মোছাব্বির মিয়া।
এদিকে শ্রীমঙ্গলে এই অবৈধ বালু ব্যাবসাকে কেন্দ্র করে প্রভাবশালীদের নিয়ে গড়ে ওঠা এক শক্তিশালী সিন্ডিকেটের খোঁজ পাওয়া গেছে। ওই সিন্ডিকেটে জড়িয়ে পড়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা। ক্ষমতাসীন দলীয় লোক হওয়ায় কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছে না।
এব্যাপারে উপজেলা যুবলীগের সদস্য বদরুল আলম শিপলু বলেন,‘আমি বালু ব্যবসার সাথে জড়িত না। আমার নাম উদ্দেশ্যমূলকভাবে যুক্ত করে রাখে তাহলে আমার কিছু করার নেই।’
শ্রীমঙ্গল উপজেলা ভূমি অফিসের সহাকারী ভূমি মো. শাহিদুল আলম জানান, ‘ইউএনও সাহেবের নির্দেশে হাইওয়ে ও থানা পুলিশের সহায়তা নিয়ে ইতোমধ্যে অভিযান চালিয়ে ৫টি ট্রাক ৩টি বালু তোলার কাজে নিয়োজিত ইঞ্জিনচালিত মেশিন জব্দ ও বেশ কিছু পাইপ ধ্বংস করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অভিযান চলমান থাকবে এবং বালু দুস্যদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে’।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার নজরুল ইসলাম বলেন ‘এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি, নিয়মিত ধরছি ও জেল জরিমানাও হচ্ছে।’
পরিবেশবাদী সংগঠন বেলার সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়কারী অ্যাড. সাহেদা বেগম বলেন, ‘হাইকোর্টেও নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বে যারা বালু উত্তোলন ও আইন প্রয়োগে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন তারা সবাই আদালত অবমাননা করছেন’।