জলাতঙ্ক; সত্যিই জীবনের হুমকি

ডাঃ মুফতি মোহাম্মদ শামছ

এমবিবিএস, এফএমডি, এফসিজিপি o সিসিডি, ইডিসি, (বারডেম, ঢাকা) ০১৭১১-৯৬৭৪৪৪

বোন হালিমা বাড়িতে নেই খোঁজ করেও তাকে ফিরিয়ে আনা যাবে না। আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগে সবাইকে অনেক কষ্ট দিয়ে, যন্ত্রনা দিয়ে, এক জনের পক্ষে যত ধরনের যন্ত্রনা কষ্ট বেদনা দেয়া সম্ভব তা তার পরিবারের সকল সদস্যকে দিয়ে, সে সবাইকে স্বস্তি দিয়ে এ সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। যাওয়ার সময় কাউকে দায়ীও করে যায় নি। নীরবে চলে গেছে। শুধু আমাদের জানিয়ে গেছে কবিরাজ-ঝাঁরফুঁক-তাবিজটুনা আর গ্রাম্য মুরব্বীর পরামর্শ না নিয়ে অন্তত একজন এমবিবিএস ডাক্তারের পরামর্শ নিলে আজ এ করুন মৃত্যু তাকে মেনে নিতে হতো না। আর নাড়ীছেড়া প্রানের ধন অবুঝ শিশুদের ও এতিম করে নিষ্টূর ভাবে চলে যেতে হতো না।

২০০১ সালের ঘটনা, বরমচালের এক  ২৫-২৬ বছর বয়সী গৃহিনী গৃহস্থলীর কাজের প্রয়োজনে ঘরের বাইরে সন্ধার দিকে বের হয়েছিল। পথে একটি পাগল কুকুর তাকে কামড় দেয়। কামড়ের ক্ষত চিহ্নও তার শরীরে ছিল, ঝড়েছিল তাঁজা রক্ত। পরিবারের সদস্যরা তাকে কিন্ত ভূল করেও এমবিবিএস ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় নি। সপ্তাহ দুয়েক পর যখন হালিমার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে থাকল তখন পরিবাররের লোকজন তাকে এমবিবিএস ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসল। ডাক্তার তার মুখের লালাঝড়া, প্রচন্ড পানিপানের ইচ্ছা,আর অন্যকে কামর দেয়ার প্রবণতা পর্যালোচনা করে জানিয়ে দিলেন জলাতঙ্ক রোগ হয়েছে  তারাতারি সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে।

পরিবারের সদস্যরা ১৫ দিন আগে যে কাজ করার কথা ছিল ১৫ দিন পর তা করল, তাকে নিয়ে আসা হল এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সী বিভাগে। অবাক সেদিন ডাক্তারদের ঢল নেমেছিল এক নজর হালিমাকে দেখার জন্য। ডাক্তার -নার্স প্রস্তুত,প্রস্তুত ঔষধ ও কিন্তু হালিমা সবাইকে ফাকি দিয়ে ও পারে চলেগেল কয়েকদিন চিকিৎসা নেয়ার পর। কতটা করুন মৃত্যু ছিল তা বোঝানোর কোন ভাষা কারও নেই, প্রচন্ড পিপাসার্থ অবস্থায় পানি মুখে নিয়ে পান করা তার ভাগ্যে জুটেনি। গ্রামের কবিরাজ মুরব্বি-তান্ত্রিক নামক প্রতারকরা সেদিনও তার দায়িত্ব নেয় নি, আজও তারা সমাজে প্রতারনার মায়াজ্বালে মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে বহাল আছে। হালিমার জন্য তাদের কোন অনুভূতিই নেই।

প্রিয় পাঠক অনুরুধ রইলো শরীরে কোন অসুখ হলে বা কোন ধরনের অসুবিধা হলে হালিমার পরিবারের সহজ সরল সদস্যদের মত প্রতারকদের সরনাপন্ন না হয়ে অন্তত একজন এমবিবিএস ডাক্তারের সরনাপন্ন হবেন। সমাজের অসংখ্য হালিমারা যেন পরিবারের সবাইকে ছেড়ে সন্তানদের একলা করে অকালে চিরবিদায় আর না নেয়। জলাতঙ্ক এমনই অসুখ যার কারনে মৃত্যু সম্ভাবনা প্রায় ১০০ ভাগ। পাঠকবৃন্ধ ঘটনাটা প্রবীণ ডাঃ সুব্রত ভৌমিক (মেডিকেল অফিসার, পার্কভিউ মেডিকেল কলেজ,বহিঃবিভাগ) থেকে শোনা। আজও হালিমার করুন মৃত্যুরোগের জন্য নিরবে তার মন কাঁদে। তিনি  কোন উপকারই করতে পারেন নি হালিমার, কিছুই করার ছিল না তার,শুধু প্রাথমিক ভাবে রোগনির্নয় করেছিলেন হালিমা জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত। এবার জেনে নেই জলাতঙ্ক রোগটি সম্মন্ধে –

Rabies বা জলাতঙ্ক

রেবঢো ভাইরাস নামক জীবানুর দ্বারা রেবিস বা জলাতঙ্ক রোগ হয়। এটি স্থন্যপায়ী প্রাণীদের সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম বা কেন্দ্রিয় অনুভূতির নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা পদ্ধতি এবং সেলাইভারী গ্লান্ড বা লালা গ্রন্থিকে আক্রমন করে জীবানুর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ করে।জীবানু প্রচুর পরিমানে আক্রান্ত প্রানীর লালাগ্রন্থিতে থাকে এবং তা আক্রান্ত প্রানীর কামড় বা আচার দেয়া স্থানে লালার সংস্পর্শে এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে ছড়ায়। এর সুপ্তকাল বা ঘুমন্ত অবস্থা (ইনকিউবেশন প্রিয়ড) নূন্যতম ৯ দিন থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত। তবে সাধারনত ৪-৮ সাপ্তাহের মধ্যেই লক্ষন গুলোর প্রকাশ ঘটে। তবে রেবিস আক্রান্ত প্রাণীর আক্রান্ত ক্ষতস্থান যদি মাথা বা ঘাড় হয় তবে সূপ্তকাল বা ঘুমন্ত অবস্থার সময়কাল আরও কম সময়ও হতে পারে।

লক্ষন কি?

জ্বর, আক্রান্ত ক্ষতস্থানে ব্যাথা করা, চুলকানীর অনুভূতি বেড়ে যাওয়া বা অবস অবস অনুভব করা, দুশ্চিন্তায় (anxious) এ ভূগতে থাকা, পানির প্রতি ভয় জন্মানো, প্রচূর পিপাসা থাকা স্বত্তেও আক্রান্ত ব্যক্তি যখনই পানি পান করতে চায় তখনই মধ্যচ্ছাদা বা ডায়ফ্রমে এবং নিঃস্বাশ ছাডার জন্য অন্যসকল মাংশপেশীর গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে, তাদের খুব জোড়ালো সংকোচন হয় (violent contraction), Delusion বা বিভ্রম, hallucination বা অলিক কল্পনা, বিভ্রম ও অলিক কল্পনার সাথে বার বার থুথু ফেলা, সুজোগ পেলেই যাকে তাকে কামড় দেয়ার প্রবনতা বেড়ে যাওয়া, অনেক সময় রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে আবার জ্ঞান ফিরে পায় (লুডিস ইনটারভ্যাল)। এ লক্ষন প্রকাশ পাওয়ার ৭-১০ দিনের মধ্যেই রোগীর মৃত্যু ঘটে।

কিভাবে রোগ নির্নয় করবেন

এ রোগ স্বাধারনত লক্ষন দেখেই নির্নয় করা যায়। কিন্তু Skin biopsy এবং immuno fluorescent technique দ্বারা ও রোগ নির্নয় করা যায়। ইমিউনো ফ্লরেসেন্ট পদ্ধতিতে কর্নিয়ার ইমপ্রেশন স্মেয়ার এ এন্টিজেনের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।

কিভাবে চিকিৎসা করা যায়

খুব কম রোগীই জীবন ফিরে পায়।মানে রেবিস দ্বারা আক্রান্ত রোগীর রোগমুক্তির সম্ভাবনা খুবই কম। প্রায় “০” শূন্যের কোঠায়। তাই সতর্ক ও সাবধান থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। চিকিৎসা পদ্ধতিকে বুঝার সুবিধারর্থে ২ ভাগে ভাগ করে আলচনা করা হল-

ক) কামড় দেয়ার বা আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে (exposure pre-prophylaxis) যাদের যা করা দরকার ১। যারা রেবিস আক্রান্ত জীবানুর পরিচর্যাকে নিজের পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছেন ২। যে সকল পরীক্ষাগারে রেবিস ভ্যাকশিন তৈরি করা হয় সেখানে কাজে নিয়োজিত ব্যাকতি ৩। যারা রেবিস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা যে এলাকায় বেশি সেখানে বসবাস করেন।

প্রতিরোধন নেয়া যায় ২ ভাবে ১) চামড়ার নিচে ২ বার ০.১ মিলিমিটার হিউম্যান ডিপ্লয়েড সেল স্ট্রেইন ভ্যকশিন দেয়ার পর প্রতিবছর বোঁস্টার ডোজ নেয়া ২) মাংশের মাঝখানে ৪ সাপ্তাহ পর পর ২ বার ১ মিলিমিটার হিউমেন ডিপ্লয়েড সেল স্ট্রইন ভ্যাক্সিন দেয়ার পর প্রতিবছর রোস্টার ডোজ নেয়া।

খ) কামড় বা আক্রান্ত হওয়ার পর ১। ক্ষত স্থান দ্রুত পরিস্কার প্রবাহমান পানি দিয়ে ভাল ভাবে পরিস্কার করতে হবে ২। সাবান বা ডিটারজেন্ট দিয়ে ভাল্ভাবে ধুয়ে নিতে হবে ৩। আক্রান্ত ক্ষতস্থানের টিসুগুলো কেটে ফেলে দিতে হবে ৪। ক্ষত স্থানে সেলাই দেয়া যাবে না।

রেবিস দ্বারা আক্রান্ত প্রানীর কামড় বা আচর লাগার ২৪ -৪৮ঘন্টা বা ১-২ দিনের মধ্যেই চিকিৎসা শুরু করা উচিত। তা হলে ভাল ফলাফল পাওয়া যায়। চিকিৎসা দেরিতে নিলে ও হয় কিন্তু দেরী না করাই ভাল। সর্বোচ্চ প্রতিরোধ গড়তে গেলে হাইপার ইমিউনো সিরাম এবং ভ্যাক্সিন এদুয়ের সমন্বেয়ে চিকিৎসা নেয়া হয়। সবচেয়ে কার্যকারী ও নিরাপদ এন্টিরেবিস, এন্টিসিরামটি হল হিউম্যেন রেবিস ইমিউনো গ্লবুলিন। যার অর্ধেকটা দিতে হয় আক্রান্ত ক্ষত স্থানের চারপাশে এবং বাকি অর্ধেকটা দিতে হয় শরীরের অন্য জায়গায় দুটি মাংশের স্থরের মাঝখানে। হাইপার ইমিউনো এনিমেল সিরাম এর ডোজটি হল ৪০ ইউনিট প্রতিকেজিতে। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসাবে প্রায়ই পাওয়া যায় সুইপার সেন্সিটিভটি রিক্রশন এবং অনেক সময় এনাকাইলেকটিক শক। এজন্য এটি এখন খুব একটা ব্যবহার হয় না।

সবচেয়ে নিরাপদ কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই যা সেফেষ্ট ভ্যাক্সিন নামে পরিচিত তা হল হিউম্যান ডিপ্লয়েড সেল স্টেইন ভ্যাক্সিন যা ০-৩-৭-১৪-৩০-৯০ তম দিনে দিতে হবে। যে সকল স্থানে হিউম্যান রেবিস ইমিউগ্লবুলিন পাওয়া যায় না যা সকল ক্ষত্রে ০.১ মিলিমিটার ভ্যাক্সিন ১ দিনে চামডার নিচে মোট ৮ টি ভিন্ন ভিন্ন স্থানে দিতে হবে এবং এর ৭ দিন পর ও ২৮ দিন পর ১ টি করে মোট দুটি বোস্টারা ডোজ দিতে হবে।

সে সকল স্থানে রেবিস হওয়ার সম্ভাবনা কম এবং ভ্যাকসিনও সহজে পাওয়া যায় না সে সকল স্থানে চিকিৎসা শুরু করতে ৫ দিন পর্যন্ত দেরি করা যায়। আর এই ৫ দিনের মধ্যে ভ্যাক্সিন জোগার‍ করা এবং যে প্রাণীটি কামড় দিয়েছে তার গতিবিধী পর্যবেক্ষন করা, প্রাণীর জিহ্বা দিয়ে লালা ঝরছে কিনা, কামড় দিতে খুব অব্যস্থ কিনা, প্রানীটি দুর্বল হয়ে পড়েছে কিনা তা পর্যবেক্ষন করা। যদি তাই হয় তবে আক্রান্ত প্রানীটিকে মেরে ফেলা উত্তম এবং এর মস্থিস্ক বিশেষজ্ঞ প্রানী গবেশক দ্বারা পরিক্ষা করে নেয়া তবে তা আমাদের দেশে এখনও চালু হয় নি।

সবশেষে মনে রাখতে হবে জলাতঙ্ক একটি বিরল অসুখ এ জন্য যে সকল এলাকায় জলাতঙ্ক প্রকোপ বেশী সে সকল এলাকায় ও কম হয়। যদিও এ বিরোল অসুখ তার পর ও এর দ্বারা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রায় ১০০ ভাগ। তাই যখনই কোন রোগী প্রানীর কামড় বা আচর নিয়ে আসে সাথে সাথে কিছু বোঝার আগেই এন্টি-রেবিস ভ্যাক্সিন দিয়ে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ঝুঁকি নেয়ার কোন কারন নেই কারন রেবিস দ্বারা আক্রান্ত প্রানীর কামড় বা আচড় দেয়ার দিন থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত যা কোন সময় এর লক্ষন দেখা দিতে পারে। তাই সতর্কতা মুলক ভ্যাক্সিন দিয়ে দেয়া ভাল। অন্তত জীবন রক্ষা হবে।লক্ষন প্রকাশ পাওয়ার পূর্বেই চিকিৎসা মানে ভ্যাক্সিন দিয়ে দিতে হবে। আর লক্ষন প্রকাশ পেয়ে গেলে যে সকল জায়গায় আইসিইউ এর সুবিধা আছে সে স্থানে রেখে চিকিৎসা করাতে হবে যাতে যে কোন সময় কার্জিনাক বা রেস্পিরেতরি বা এ দুটিই ফেইলর হয় তখন সাপুট দেয়ার ব্যবস্থা করা যায়। পেলিয়েটিভ চিকিৎসা যা রোগীর ভূগান্তি কমাবে কিন্তু রোগী সুস্থ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কি করতে হবে তাহলে? রোগীকে গভীর ভাবে ঘুমপাড়িয়ে রাখাতে হবে তার জন্য ১০ মিলিগ্রাম ডায়াজেপাম ৪-৬ ঘন্টা পর পর ইনজেক্সন দিয়ে দিতে হবে যদি প্রয়োজন হয় তবে ক্লোর প্রমাজিন ৫০-১০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত দেয়া যেতে পারে। প্রতিদিন পুষ্টিকর খাদ্য, পানির জোগান শিরাপথ দিয়ে সর্বপরি একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মতে পাকস্থলীতে ছিদ্রকরে ও খাবার ব্যবস্থা চালু রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে।

রেফারেন্সঃ ডেভিসন প্রিনসিপালস এন্ড প্রাকটিস অব মেডিসিন

শেয়ার করুন