বড়লেখায় আইনজীবি আবিদা সুলতানার হত্যায় দ্বায় স্বীকারের ইমাম তানভীরের

সাইফুল ইসলাম

মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার মাধবগুল গ্রামের আইনজীবী আবিদা সুলতানা হত্যার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ।
রিমান্ডে থাকা মসজিদের ইমাম তানভীর আলম হত্যাকান্ডের দ্বায় স্বীকার করেছে। ওই আনজীবীর বাড়িতে ভাড়া থাকতেন ইমাম তানভীর আলম ও তার পরিবার। তার কর্মকান্ডে অতিষ্ট হয়ে দীর্ঘদিন ধরে আবিদা ইমামকে বাড়ি ছাড়ার নির্দেশ দিচ্ছিলেন। কিন্তু তানভীর কিছুতেই বাড়ি ছাড়ছিলেন না। এনিয়ে দ্বন্ধ তৈরী হয়। ঘটনার দিন তানভীরের সাথে আইনজীবীর কথাকাটাকাটি হয়। পরে তানভীর ক্ষোভে আইজীবীকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে। এক পর্যায়ে পানির ফিল্টারের পাথরের ঢাকানা দিয়ে আঘাত করে আবিদা সুলতানা হত্যা করে।
শুক্রবার ৩১মে সন্ধ্যায় পুলিশ বড়লেখার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে সোপর্দ করলে বিজ্ঞ হাকিম হরিদাস কুমারের খাস কামরায় তানভীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। পরে আদালত তাকে মৌলভীবাজার জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
শনিবার বিকেলে মৌলভীবাজার মডেল থানায় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত সাংবাদিকের মধ্যে বিষয়টি নিশ্চিত করেন মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রাশেদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ৩১ শে মে বড়লেখার জ্যেষ্ঠ বিচারিক আদালতে তানভীর আলম হত্যারকান্ডের বিষয়টি নিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। এই হত্যার সাথে শুধু তানভীরই জড়িত। ঘটনার দিন ২৬ মে তানভীর বাড়িতে একা ছিল। তার মা ও স্ত্রী বাহিরে ছিলেন। আর ধর্ষণের কোন আলামত পাওয়া যায়নি।’
তিনি বলেন, কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে আবিদা তানভীরকে বলেছিল তার লুঙ্গি খুলে ফেলবেন। এই কথার ক্ষোভ থেকেই তানভীর আবিদা সুলতানাকে আঘাত করার পর শরীর থেকে কাপড় খুলে ফেলে। তবে ধর্ষণের কোন আলামত তদন্ত ও মেডিকেল রিপোর্টে তানভির আলমের স্বীকারোক্তিতে পাওয়া যায়নি। এঘটনার সাথে পরিবারের অন্য কেউ জড়িত নয়। ঘটনার দিন সকাল ১১টা থেকে ১২টার মধ্যে আবিদাকে হত্যা করা হয়েছে ।
আদালতে দেয়া ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে মসজিদের ইমাম তানভীর আলম জানিয়েছে, ঘটনার দিন মহিলা আইনজীবি আবিদা সুলতানার সাথে বাসা ভাড়া ও পৈতৃক বাড়ির গাছ বিক্রি নিয়ে তার সাথে তুমুল ঝগড়া ঝাটি হয়েছে। এক পর্যায়ে আবিদা সুলতানা খারাপ ভাষায় গালি দিয়ে দাঁড়ি ও লুঙ্গি ধরে টান দেয়ায় তার রক্ত মাথায় উঠে যায়। রাগের মাথায় সে পাথরের তৈরী পানির ফিল্টারের ঢাকনা দিয়ে আবিদার মাথায় আঘাত করে। রক্তাক্ত অবস্থায় ঘরের মধ্যে অনেকক্ষণ দু’জনের ধস্তাধস্তি হয়। চরম উত্তেজনায় গলায় ও মাথায় কাপড় পেছিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দেই। আবিদা মারা যাওয়ায় সে বাসায় তালা দিয়ে পালিয়ে যায়।
বড়লেখা উপজেলার দক্ষিণভাগ উত্তর ইউপির মাধবগুল গ্রামের প্রয়াত আব্দুল কাইয়ুমের তিন মেয়ে। স্ত্রী দ্বিতীয় মেয়ের বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজারে থাকেন। মেয়েদের মধ্যে আবিদা সুলতানা (৩৫) সবার বড়। তিনি মৌলভীবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের আইনজীবী। আবিদার স্বামী মো. শরিফুল ইসলাম একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেন। তিনি স্বামীর সঙ্গে মৌলভীবাজার শহরে বসবাস করতেন। ছুটির দিনে প্রায়ই পৈতৃক বাড়ি দেখাশোনা করতে বাড়িতে যেতেন আবিদা সুলতানা। পৈতৃক বাড়িতে চার কক্ষবিশিষ্ট ঘরের দুই কক্ষে আবিদা সুলতানা ও তার বোনেরা বাড়িতে বেড়াতে আসলে তারা থাকেন। বাকি দুটোতে ভাড়া থাকতেন তানভীর আলমের পরিবার। তিনি তাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয় ও স্থানীয় মাধবগুল জামে মসজিদের ইমামমতি করতেন।
ঘটনার প্রায় চার মাস আগে তানভীরকে বাসা ভাড়া দেন আবিদা।
২৬মে সকালে আবিদা সুলতানা বিয়ানীবাজার থেকে ঘটনাস্থলের বাসায় পৌঁছান। সকাল অনুমান সাড়ে এগারোটার দিকে ফোন দিয়ে তার স্বামীর সঙ্গে কথা বলেন ইফতারের আগে মৌলভীবাজার শহরে পৌঁছাবেন বলেও জানান। এরপর বিকেল অনুমান ৫টার সময় তার স্বামীর মুঠোফোন হতে ফোন দিলে তার মুঠোফোনে বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর আবিদা সুলতানার স্বামী ও বোনরা তাকে খোঁজতে বাবার বাড়ি মাধবগুল গ্রামে আসেন। বাড়িতে এসে তারা ঘরের কক্ষ বন্ধ দেখতে পান। এ সময় বাসার ভাড়াটিয়া তানভীর আলমের পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি। ঘটনাস্থলের পাশেই তাদের এক আত্মীয় বাড়িতে তানভীরের মা ও স্ত্রী ছিলেন। পরে তাদের কাছ থেকে চাবি এনে ওই দিন (২৬মে) রাতে দিকে পুলিশ ঘরের দরজা খুলে দেখে আবিদা সুলতানার মৃতদেহ রক্তাক্ত অবস্থায় ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে। পুলিশ ওই দিন রাতেই তানভীর আলমের স্ত্রী ও মাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করে।

পরদিন ২৭মে দুপুর দেড়টায় শ্রীমঙ্গলের বরুণা এলাকা বরুণা মাদ্রাসার আশ-পাশ থেকে শ্রীমঙ্গল থানা পুলিশ ইমাম তানভীর আলমকে আটক করা হয়। ওইদিনই বড়লেখা থানায় ৪ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন আবিদা সুলতানার স্বামী মো. শরিফুল ইসলাম। এরপর তানভীর আলমের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই আইনজীবীর ব্যবহৃত দু’টি মুঠোফোন শ্রীমঙ্গল থেকে উদ্ধার কওে শ্রীমঙ্গল থানা পুলিশ।
মামলার আসামিরা হচ্ছেন, আবিদা সুলতানার বাবার বাসার ভাড়াটিয়া তানভির আলম (৩৪), তানভিরের ছোট ভাই আফছার আলম (২২), স্ত্রী হালিমা সাদিয়া (২৮) এবং মা নেহার বেগম (৫৫)।
তাদের স্থায়ী ঠিকানা সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার ছিলারকান্দি। মামলার পরই তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে মঙ্গলবার (২৮মে) দুপুরে বড়লেখার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম হরিদাস কুমারের আদালতে হাজির করে ১০দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করে পুলিশ। শুনানি শেষে আদালত তানভীর আলমের ১০ দিন এবং তার স্ত্রী সাদিয়া ও মা নেহার বেগমের আটদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ঘটনার পর থেকে তানভীরের ছোট ভাই আফছার আলম পলাতক রয়েছেন।

 

 

শেয়ার করুন