সৈকত রুশদী, টরন্টো (৩০ জুলাই ২০১৯) ।।
মানসিক বিকার, অনলাইন গেম আসক্তি, জীবনের প্রতি হতাশা, ধর্ম বিশ্বাস ও স্রষ্টার প্রতি অনাস্থা, ব্যর্থতা ও মিথ্যাচারের লজ্জা, নাকি অভিবাসনে সংস্কৃতির সংঘাত, কী ছিল তার মা, বাবা, বোন ও নানীকে হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ, তা’ অনুসন্ধান করে দেখা প্রয়োজন।
অজ্ঞাতনামা সূত্র থেকে খবর পেয়ে ইয়র্ক পুলিশ রোববার (২৮ জুলাই) বিকেলে টরন্টো মহানগরীর উত্তর-পূর্ব দিকের মারখাম শহরের একটি বাড়িতে গিয়ে চার ব্যক্তির মৃতদেহ উদ্ধার করেছে। নিহতদের মধ্যে তিনজন নারী ও একজন পুরুষ।
ঐ বাড়ি থেকে ২৩ বছর বয়সী এক তরুণকে গ্রেফতার করা হয় এবং সন্দেহভাজন হিসেবে সোমবার তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়। তাঁকে হত্যাকাণ্ডের চারটি সুনির্দিষ্ট (ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার) অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। ইয়র্ক পুলিশ ঘটনাটি তদন্ত করছে।
পুলিশ আদালতের রেকর্ডে তরুণের নাম মিনহাজ জামান বলে জানালেও নিহতদের পরিচয় প্রকাশ করেনি।
টরন্টোর বাংলা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে জানা গেছে, নিহত বাংলাদেশী-কানাডিয়ান এই পরিবারের সদস্যরা হচ্ছেন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, তাঁর স্ত্রী মুক্তা জামান, তাঁদের কন্যা ও মুক্তা জামানের মা। সন্দেহভাজন মিনহাজ জামান নিহত মনিরুজ্জামান ও মুক্তা জামানের পুত্র।
এই দম্পতি অল্পদিন আগে তাঁদের বিয়ের ২৫ তম বার্ষিকী পালনকালে আয়োজিত সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশনকারী এক শিল্পীর উদ্ধৃতি দিয়ে অনলাইন বার্তা প্রতিষ্ঠান সিবিএন২৪ এই পরিচয় জানিয়েছে ।
কানাডার শীর্ষস্থানীয় টেলিভিশন ও রেডিও স্টেশন এবং পত্র-পত্রিকায় এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত সংবাদ প্রকাশ করছে।
গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অনলাইন গেম খেলায় অংশগ্রহণকারীদের বার্তা বিনিময়ের অন্যতম মাধ্যম ‘ডিসকর্ড’-এ মিনহাজ একাধিক বার্তায় এই হত্যাকান্ড সংঘটনের কথা প্রকাশ করেন। তিনি এজন্য শাস্তির যোগ্য বলেও প্রকাশ করেন।
‘পারফেক্ট ওয়ার্ল্ড ভয়েড’ নামের এক অনলাইন গেম খেলার সহযোগীদের দুইজন মিনহাজকে মিনহাজ জামান বলে শনাক্ত করলেও এই হত্যাকাণ্ডের সন্দেহভাজন মিনহাজ একই ব্যক্তি কিনা তা’ নিশ্চিত করতে পারেননি।
তবে অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, গেম খেলায় মিনহাজের সহযোগীদের একজন বার্তাগুলো দেখার পর মিনহাজের বাড়ির অবস্থান জেনে নিয়ে পুলিশকে খবরটি জানান।
ঐসব বার্তায় মিনহাজ তাঁর হতাশা, ধর্ম বিশ্বাস ও স্রষ্টার প্রতি অনাস্থা, এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স থেকে ঝরে পড়ার পরও তিন বছর ধরে পরিবারকে পড়াশোনা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে মিথ্যাচার করার কথা স্বীকার করেছেন বলে কানাডার সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ‘দ্য টরন্টো স্টার’ জানিয়েছে।
এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ঐ বাড়িতে আগে ভাড়াটে হিসেবে বসবাসকারী এক নারী জানিয়েছেন, মিনহাজের মতো শান্ত স্বভাবের ভদ্র ছেলে এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে তিনি বিশ্বাস করতে পারছেননা।
নিহত মনিরুজ্জামান ঐ বাড়িতে ২০০৪ সাল থেকে বসবাস করছিলেন বলে জানিয়েছে টরন্টো স্টার।
গত দুই বছরে টরন্টো মহানগরীতে বাংলাদেশী-কানাডিয়ান পরিবারের কয়েকজন তরুণের আত্মহত্যার ঘটনার পর হতাশাগ্রস্ত এক তরুণের হাতে পরিবারের বাকি সব সদস্য খুন হওয়ার ঘটনাটি কানাডার বাঙালিদের গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে।
এই বাঙালি তরুণদের মধ্যে কেউ মানসিক রোগে ভুগছিল, কেউ শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিবারের অত্যধিক প্রত্যাশার চাপে পর্যদুস্ত হয়ে পড়েছিল এবং কেউ ধর্ম পালনে পরিবারের চাপের মুখে অভিবাসী হিসেবে সংস্কৃতির সংঘাতের শিকার হয়েছিল।
মারখামের এই হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত মিনহাজই মা-বাবা, বোন ও নানীকে হত্যাকারী হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় কানাডায় অভিবাসী বাঙালি পরিবারগুলো এক প্রবল আত্মজিজ্ঞাসার সম্মুখীন হয়েছে, সন্দেহ নেই।