সন্দেহপ্রবণ মন এক বোঝা স্বরূপ

সন্দেহ! মানুষের জীবনের একটি অংশ। আমি বা আমরা সন্দেহ করতে না চাইলেও এই ব্যাপারটি আমাদের সাথে ঘটেই থাকে। এটি মূলত আমাদের স্বভাবগত সমস্যা। মন খুব বেশি সন্দেহপ্রবণ হলে তা আমাদের জীবনে নানা রকমের সমস্যা তৈরি করে। আমরা সন্দেহ করি স্বামীকে, স্ত্রীকে, সন্তানকে, নিজের পরিবারের অন্য মানুষের পাশাপাশি পাশের বাড়ির প্রতিবেশী, অফিসের বস-সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধবসহ সকলকে। কে কী করছে আমাদের মনের অন্তরালে। এটা একধরণের স্বভাব, পাশাপাশি বড় ধরনের মানসিক রোগও। সন্দেহের কারণে অনেকসময় আমরা চরম সত্যকেও মিথ্যায় রুপান্তরিত করে ফেলি। আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধব ও সহকর্মীদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে ফেলি। সন্দেহের কারণে অন্যকে ভুল বা দোষী ভেবে নিজেই নিজের ক্ষতি করে বসে থাকি। অথচ বিনা কারণে কারো প্রতি সন্দেহবশত খারাপ ধারণা পোষণ করা। কারো ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে খারাপ ধারণা নিয়েই শুরু করা অনুচিত। কিংবা এমন লোকদের ব্যাপারে খারাপ ধারণা পোষণ করা যাদের বাহ্যিক চাল-চলন ও ব্যবহার সৎ মানুষের সাক্ষ্য বহন করে। কোন লোকের ব্যাপারে যদি ভাল-মন্দের দিকটি সমান সমান হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তবে তার সম্পর্কেও খারাপ ধারণা পোষণ নাজায়েয। সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কারো প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করার ব্যপারে ইসলামে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
ধারণা বলতে- কোন ব্যক্তি, বস্তু বা অন্য কিছু সম্পর্কে পূর্বানুমানকে বুঝায়। সেই অনুমানটি ভাল-মন্দ উভয়ই হতে পারে। ভাল ধারণার ব্যাপারে ইসলামে উৎসাহিত করা হয়েছে। তবে তীব্র আপত্তি আছে খারাপ ধারণার ব্যাপারে। পবিত্র কুরআনের সূরা আল-হুজুরাত এর ১২ নং আয়াতে আল্লাহপাক বলেন- “হে ঈমানদারগণ, বেশী ধারণা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাকো কারণ কোন কোন ধারণা ও অনুমান গোনাহ।”
শোনা কথার উপর ভিত্তি করে অনুমাননির্ভর আলোচনা কাক্ষিত ফল বয়ে আনতে পারে না। শোনা কথা বলে বেড়ানো পাপ। মানবতার মহান শিক্ষক রাসূল (সাঃ) বলেছেন- “কোন ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে সে যা শুনে তা বলে বেড়ায়।” কথাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা নিজস্ব পরিবেশে এই কাজটি অহরহ করে থাকি। কোন ব্যক্তি অনুপস্থিত কোন এক ব্যক্তি সম্পর্কে একটি প্রসঙ্গ উত্থানপন করলে আমরা সবাই তা মুখরোচক করে আলোচনায় মশগুল হয়ে পড়ি। অথচ তা একান্তই ধারণাপ্রসুত কথা। যার আলোচনা গীবত পর্যায়ে চলে যায়। যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন আছে। ভিত্তিহীন আলোচনায় গৃহীত সিদ্ধান্ত বড় বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। স্বয়ং রাসূলে করীমকেও (সাঃ) আল্লাহ্ এরূপ করতে নিষেধ করেছেন। সূরা আল হুজুরাতের ৬ নং আয়াতে আল্লাহ্ বলেন-“হে ঈমান গ্রহণকারীগণ, যদি কোন ফাসেক তোমাদের কাছে কোন খবর নিয়ে আসে তাহলে তা অনুসন্ধান করে দেখ। এমন যেন না হয় যে, না জেনে শুনেই তোমরা কোন গোষ্ঠীর ক্ষতি করে বসবে এবং পরে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে।” ভাল নিয়ত ও কল্যাণকর চিন্তা থেকে কাজটি করা হলেও তা গুনাহের পর্যায়ভুক্ত। অনেকটা হারাম পথে অর্জন করে মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করার মত! বিদ্বেষবশত কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করা বা অনুমান নির্ভর কথা ও সিদ্ধান্ত গ্রহনের মাধ্যমে কাউকে ছোট করা কোন মুসলমানের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। সর্বদা ইতিবাচক মানসিকতা নিয়েই চলতে হবে।
সন্দেহপ্রবণতা নিয়ে বিশ্ববিখ্যাত মনিষীদের কয়েকটি উক্তি উল্লেখ করছি। কার্ভেন্টিস বলেছেন- “দোষী লোকদের মধ্যে সন্দেহ সবসময় প্রখরভাবে বিরাজ করে।” এমিলি ডিকেনসন বলেছেন- “অতিরিক্ত সন্দেহ অমঙ্গল ডেকে আনে।” জন উইলসন বলেন- “যে যাকে সন্দেহ করে তার ভাল কাজকেও সে স্বীকৃতি দিতে পারে না।” অল্টার ম্যালোনা বলেন- “সৎ লোকেরা কখনো সন্দেহের নিকট নিজেকে সমর্পণ করে না।” হযরত লোকমান (আ:) বলেন- “সন্দেহপ্রবণতা ত্যাগ করতে না পারলে দুনিয়ায় তুমি কোনো বন্ধু খুঁজে পাবে না।” মনিষীদের আলোচ্য উক্তিগুলোতে অনুমান বা সন্দেপ্রবণতার কু-ফল উল্লেখ করা হয়েছে।
খুব বেশী সন্দেহপ্রবণ হলে আপনার জীবনের পাশাপাশি পরিবার, সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধবদেরও নানা রকম সমস্যা হতে পারে। তাই এই বিরক্তকর অভ্যাসটি থেকে কীভাবে আপনি রেহাই পাবেন জেনে নিন। কী করণীয়? তা আমাদের প্রত্যেকের জন্য জানা ও মানা প্রয়োজন! প্রথমেই আপনার মনের সন্দেহ কী শুধু সন্দেহ (স্বাভাবিক পর্যায়ের), নাকি তা সন্দেহ বাতিক (অসুস্থতা) তা বোঝার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে মনোচিকিৎসকের সাহায্য নিন। লক্ষ্যণীয় যে, কারো প্রতি সন্দেহের বিষয়টি নির্ভরযোগ্য কারোর সঙ্গে খুলে আলাপ করতে পারেন, এতে মন হালকা হবে। কিন্তু যাকে-তাকে বলে আপনার কিংবা আপনার সম্পর্কিত মানুষটার মান-সম্মান নষ্ট করবেন না এবং নিজেকেও হাসির পাত্র বানাবেন না। সুনির্দিষ্ট বাস্তব কোনো প্রমাণ না থাকলে অকারণে সন্দেহ করবেন না এবং সন্দেহমূলক প্রশ্ন করে সম্পর্কের জটিলতা বাড়াবেন না। কেননা যাকে সন্দেহ করছেন তিনি যদি সত্যিই সন্দেহের কিছু না করে থাকেন, তবে তার জন্য বিষয়টি একই সঙ্গে অপমানজনক, কষ্টকর এবং রাগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। যদি সুনির্দিষ্ট বাস্তব প্রমাণ থেকে থাকে, তারপরও আরেকটু সময় নিন। বিষয়টা ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করুন। এক-দুটি প্রমাণের ভিত্তিতেই গর্জে উঠবেন না। খুব ইতিবাচক পদ্ধতিতে সুন্দরভাবে সঙ্গী-সহকর্মীকে আপনার সন্দেহের বিষয়টি জিজ্ঞেস করুন। তিনি যেন এ রকম মনে না করেন যে তাঁর পেছনে গোয়েন্দা লেগেছে। যদি মনে হয় সঙ্গী-সহকর্মী আপনাকে ভুল বোঝাচ্ছেন, সব কিছু লুকাচ্ছেন, তবে দুজনের সম্মতিতে আলোচনায় বসুন। আপনি আপনার প্রমাণগুলো ইতিবাচক পদ্ধতিতে উপস্থাপন করুন। এরপরও যদি আপনি সদুত্তর না পেয়ে থাকেন, তবে তৃতীয় পক্ষের সাহায্য নিন (যাকে আপনার সঙ্গী-সহকর্মী মেনে নিতে রাজি হবেন), এই তৃতীয় পক্ষ হতে পারে কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তি, কোনো গুরুজন, আবার হতে পারেন কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তি অথবা থেরাপিস্ট; যার সাহায্যে কোনো একটা সমাধানের দিকে যাওয়া যাবে। অসুস্থ পর্যায়ের সন্দেহ হলে অবশ্যই অবশ্যই মনোঃচিকিৎসক দেখাতে হবে ও ওষুধ সেবন করতে হবে। সন্দেহ বাতিক নারী-পুরুষ উভয়েরই হতে পারে। ‘সন্দেহ’ একটি চিন্তার পদ্ধতিগত জটিলতা বা রোগ, এটি নারী-পুরুষ যারই হয়ে থাকুক না কেন, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করুন।
লেখক: সাধারণ সম্পাদক- গোলাপগঞ্জ সাংবাদিক কল্যাণ সমিতি
শেয়ার করুন