সন্তানের মুখ দেখে মায়েরা ভুলে যান সব ব্যাথা

২০০৭ সালের মে মাস।
দেশে সেনা শাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে।
একজন বন খেকো, বনের রাজা ওসমান গনির বাসায় বালিশের ভেতর, চাউলের ড্রামে, ওয়ারড্রবে খুঁজে পান কোটি কোটি টাকা।
সেই কোটি কোটি টাকায় আয়েশি জীবন ছিলো ওসমান গনির।
কিন্ত ওসমান গনির মা ভিক্ষা করতেন।
ছেঁড়া কাপড় ছিলো পরনে।
দু’ মুঠো ভাত খাওয়ার জন্য তিনি মানুষের দ্বারে দ্বারে
হাত পাততেন।

ওসমান গনি কি সুখী হতে পেরেছিলেন??
১২ বছর এর সাজা হয় উনার।
সকল সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়
স্ত্রী সন্তানরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
আজ ওসমান গনি একা।।
যেই মা তাকে পেটে ধারণ করলো, জন্ম দিলো, পেলে পুষে বড় করলো, সেই মা এর খবর না রেখে কতটুকু সুখী হলেন ওসমান গনি।।
অথচ মা কে আগলে রেখে সুন্দর একটা দূর্নীতি মুক্ত পারিবারিক জীবন হতে পারতো।।
যখন বন খেয়ে কোটি কোটি টাকা ইনকাম করছিলেন, তখন কি ভেবেছিলেন একদিন এই পরিনতি হবে??
মা কে কষ্ট দিলে তার কপালে সম্মান ও সুখ কিছুই জুটে না এটা একটা প্রমাণ।।

আমার স্ত্রী ডাঃ নাবিলা এখন প্রেগন্যান্ট।
আমি তাকে অব্জার্ভ করি প্রতি মূহুর্ত।
আমাদের রাজকন্যার জন্য তার দুঃশ্চিন্তা, অশান্তি, অস্থিরতা আমাকে আমার মা এর কথা মনে করিয়ে দেয়।।
আমাদের বাচ্চার একটু মুভমেন্ট কম হলেই সে অস্থির হয়ে যায়।।
বাচ্চারা যখন মায়ের পেটের ভেতর কিক মারে, তখন মা রা অনেক ব্যাথা পান।
কিন্ত সুখ পান হৃদয়ে।।
নাবিলা যখন বলে তোমার মেয়ে এই মাত্র লাথি দিলো, বাচ্চার লাথি খেতেও এত সুখ তখন আমি হাসি দেই।।
একেই তো মা বলে।।
আমার স্ত্রী খুব শপিং পাগল নারী ছিলো।।
কিন্ত যেই সে মা হতে চললো, তার সব চিন্তা তার সন্তান কে ঘিরে।।
আগে সে জামা কাপড় এর বিভিন্ম পেইজে লাইক দিতো,ফলো করতো।
এখন সব বাচ্চাদের পেইজে তার লাইক।।
একটা সন্তান কিভাবে একজন মা এর জগত চেঞ্জ করে দেয় তা ভেবে শিহরিত হই আমি প্রতিদিন।।
আমাদের কাছে যখন মায়েরা উনাদের বাচ্চা নিয়ে আসেন তখন আমি তাদের আবেগ ও অস্থিরতা দেখি।।
সেদিন একদিনের একটা বাচ্চার ক্যানুলা করতে গেলাম।
বাবা বসে আছেন।কিন্ত মা কেঁদে অস্থির।
বাচ্চার একটু কান্নায় মা না কেঁদে পারলেন না।
উনার গাল গড়িয়ে অশ্রু পড়ছে।।
আমি সেই পবিত্র অশ্রুর দিকে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষণ।।
বাচ্চার একটু কষ্ট যিনি সইতে পারেন না তিনি ই মা।

মাঝে মাঝে যখন ভর্তি রোগী থাকে, আমি রাতে ফলোয়াপে গিয়ে দেখি সবাই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে কিন্ত জেগে আছেন মা।
তাকিয়ে আছেন স্যালাইন টা ঠিকমত পড়ছে কিনা, একটা পোকা বা মশা যেন বাচ্চাকে না কামড় দেয়।।
অনেক মা কে দেখি নিবিষ্ট চোখে বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।।
সন্তানের জন্য মায়ের এই ভালবাসার স্বর্গীয় প্রকাশ আমি খুব নিয়ে দেখি আর আমার মাকে মিস করি।।

আমার স্পষ্ট মনে আছে আমার হাতে প্রথম ডেলিভারি করানোর কথা।
২০১০ এর জানুয়ারি মাস।
বিকেল বেলা আমি লেবার রুমে ডিউটিতে।
মা টার বয়স ১৭ বছর।
হ্যাংলা পাতলা একজন মেয়ে।
ব্যাথায় চিতকারে আমারই কান্না চলে আসছিল।
বাচ্চাটার জন্মানোর সময় সেই মাকে ইপিসিওটমি করা লাগলো।।
যখন বাচ্চাটাকে লেবার রুমের মাসী সেই মায়ের মুখের সামনে ধরলো,মা টা একটা লাজুক হাসি দিলো যা আজো আমি ভুলতে পারিনি।
চোখ গড়িয়ে অশ্রু নামলো কয়েক ফোঁটা।
বুঝলাম সুখের অশ্রু।।
উনার ইপিসিওটমি রিপেয়ার করলাম লোকাল এনেস্থিসিয়া না দিয়েই।
বাচ্চাকে দেখার পর একটি বারো উঁহু শব্দ করলোনা সেই মা।।
সন্তান এমন ই।
সন্তানের মুখ দেখে মায়েরা ভুলে যান সব ব্যাথা।।

অনেক মায়েরা আমাদের কাছে এসে শুধু অভিযোগ করেন উনাদের বাচ্চারা খায়না।
অন্য বাচ্চা এত খায় আমারটা খায়না কেন?
খাবারের রুচির মেডিসিন দিতে জোরাজুরি করেন।
অবাক করা ব্যাপার সেদিন এক মা উনার এক মাস বয়সী বাচ্চাকে নিয়ে আসলেন, উনিও আবদার করছেন উনার বাচ্চার রুচি কম, মেডিসিন দিতে।।
আমরা যখন দেখি বাচ্চার বয়সের তুলনার ওজন ঠিক আছে বা বাচ্চাটা নাদুসনুদুস তখন মুচকি হাসি দিয়ে বুঝাই সেই মাকে।।
সন্তান হয়তবা ছোটখাটো হাতি হয়ে আছে তারপরও মা এর সন্তানের খাবার নিয়ে এমন আকুলতা আমাকে মুগ্ধ করে।।।

একবার ৩০ বছর এর এক যুবক আসলো একিউট প্যানক্রিয়াটাইটিস এর ব্যাথা নিয়ে।
তীব্র ব্যাথায় ছেলেটি যখন কষ্ট পাচ্ছিলো তখন মা কে বলতে শুনলাম, হে আল্লাহ আমাকে দুনিয়া থেকে নিয়ে যাও, বিনিময়ে আমার ছেলেকে সুস্থ করে দাও।।
শুধুরা মায়েরাই এমন ভাবতে পারেন।
২০০০ সালে আমাদের ঘরের সবার চিকেন পক্স হলো।
আমার বাবার আর বড় বোনের বেশি হলো
বাবার চেহারাই চেনা যাচ্ছিলো না।
ব্যাথা, জ্বর ও উনি বেহুঁশ হবার উপক্রম।
গভীর রাতে আমার দাদী চিৎকার করে কান্না করতে করতে আমাদের ঘরে আসলেন।।
দাদাভাই কে ধরে কান্না করছিলেন৷
বলতেছিলেন আমার পুত মরে যাবে। আপনি কিছু করেন।
তখন দাদী আব্বার সুস্থতার জন্য একটা খাসি মানত করলেন আল্লাহ এর কাছে।।
মা এমন ই।।

সেই মা কে আমরা ভালো রাখছি কিনা একটা আত্ম জিজ্ঞাসা দরকার।
আজ যখন আমরা আমাদের বাচ্চাদের নিয়ে এত কনসার্ন সেদিন এমন ই উদ্বিগ্ন থেকে সেই দিনগুলো
পার করেছেন আমাদের মায়েরা।।

উনারা এখন বৃদ্ধ। বয়স হয়েছে উনাদের।
সংসারের কর্তৃত্ব আর নাই।
অনেক মা স্বামীকে হারিয়ে অসহায়।
নিজের কথা বলার কেউ নেই উনার।
কে শুনবে?
সবাই তো ব্যস্ত নিজ জগতে।
মা পড়ে থাকেন একা শুন্য ঘরে।।

অনেক সন্তান আছেন যারা মা কে বুঝেন।
মা কে পরম মমতায় আগলে রাখেন।

কিন্ত আজকাল মানুষরুপী অমানুষও দেখি প্রায়ই।।
মা শুয়ে আছেন ভাঙ্গা খাটে,পরনের কাপড়টা মলিন, একটু ফল খেতে ইচ্ছে করে কিন্ত খেতে পাননা।
অথচ সন্তানরা ফুটানি করে বেড়াচ্ছে।।
দামী জামাকাপড় পড়ে দামী রেস্টুরেন্ট এ খাচ্ছে গার্লফ্রেন্ড বা স্ত্রী কে নিয়ে।
কিন্ত মা এর মেডিসিন কেনার টাকা নেই।
মা অভুক্ত।
এমন অমানুষ আমার নিজ চোখে দেখা।।।

আমার মা জীবনে কাপড়ের অনেক কষ্ট করেছেন।
এখন আলহামদুলিল্লাহ উনার অনেক কাপড়।
প্রতিবারই আমি বাসায় গেলে আড়ং এ যাই আম্মার জন্য কাপড় কিনতে।
কাপড় কিনে নেওয়ার পর উনি চিল্লাফাল্লা করেন।
আব্বার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলেন, দেখেন পাগল ছেলে কতগুলো টাকা অপচয় করে আসলো।
উনাকে নিয়ে কিছু কিনতে গেলে উনি সস্তা জিনিস খুঁজেন তাই উনাকে নেইনা আমি।
একবার আমি সিলেট থেকে দুইটা শাড়ি নিয়ে গেলাম।
উনি খুব রাগ করলেন।
বিকেলে বাসার সবাই ঘুমাচ্ছে।
আমার ঘুম ভেঙে গেলো। উঠে দেখি উনি সেই দুইটা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে আয়না দেখছেন উনাকে কেমন লাগছে।।
আমার মায়ের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক।।
সেই সুখের অপার্থিব দৃশ্য আজো আমার হৃদয়ে প্রশান্তি জোগায়।

হে মানব সন্তান মা কে ভালবাসো।
মা কে আগলে রাখো।
মা ই তোমার জান্নাত।।

সহীহ মুসলিমের ৬৬৭৫ নাম্বার হাদিসে এসেছে, একবার হয়রত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলে উঠলেন সেই ব্যক্তি দুর্ভাগা।
সেই বাক্তি দুর্ভাগা। সেই ব্যক্তি দুর্ভাগা।
তিনবার বললেন নবীজী এই কথাটা। তখন উপস্থিত সাহাবীগন জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল,কোন ব্যক্তি দুর্ভাগা।
তখন নবীজী বললেন, সেই ব্যক্তি যে বাবা মা দুজন কে বা একজন যে বৃদ্ধ অবস্থায় পেয়েও তাদের সেবা করে জান্নাত নিশ্চিত করতে পারলো না।।
সেই ব্যক্তিই দুর্ভাগা।।
আপনি যদি বেহেশতে যেতে চান, তবে মা বাবার সেবা করুন।। তাদের পরম মমতায় আগলে রাখুন।।
মা বাবা কে আপনি সম্মান করলে দুনিয়া আপনাকে সম্মান দেখাবে।।
মা বাবার অসম্মান অযত্ন ও অবহেলা করে কেউ সম্মানিত হয়না, কেউ সুখী হয়না, হতে পারেনা।

লেখক ডাঃ জোবায়ের আহমেদ এর ফেইসবুক থেকে

 

শেয়ার করুন