ইবাদুর রহমান জাকির, বড়লেখা, মৌলভীবাজারঃ
“নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। তাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে লালন ও ধারণ করে নিজেকে দেশপ্রেমিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের লাখো শহীদের আত্মত্যাগের কাহিনী জানা দরকার শিক্ষার্থীদের। দেশকে ভালোবাসতে হবে। বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শে নতুন প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ হতে হবে।” -‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধকে জানি’ শীর্ষক মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানে উপরোক্ত কথাগুলো বলেন একাধারে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সংসদ সদস্য প্রবীণ রাজনীতিবিদ সিরাজুল ইসলাম। ৭ অক্টোবর (সোমবার) সকালে মৌলভীবাজারের বড়লেখার রোকেয়া খাতুন লাইসিয়াম স্কুল এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সংসদ সদস্য সিরাজুল ইসলাম একাত্তরের অগ্নিঝরা রণাঙ্গনের বিভিন্ন গল্প যখন শোনাচ্ছিলেন, তখন রোকেয়া খাতুন লাইসিয়াম স্কুলের শ্রেণীকক্ষগুলোতে ছিলো পিনপতন নীরবতা। তাঁর মুখে রণাঙ্গনের নানা কাহিনী বিভোর হয়ে শুনছিলো শিক্ষার্থীরা। লড়াই-সংগ্রামের গল্প শুনে কখনও শিহরিত হচ্ছিলো, কখনও আবার মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী নিরীহ বাঙালির ওপর পাক সেনাদের নির্মম অত্যাচার-নির্যাতনের কাহিনী শুনে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছিলো তারা। অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের গল্প বলতে গিয়ে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ছাত্রলীগের রাজনীতি করতাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা মুজিব ভাই বলেই ডাকতাম। ৭০ এর নির্বাচনের আগে তিনি একবার বড়লেখা এসেছিলেন। প্রার্থীদের জনগণের কাছে পরিচয় করিয়ে দিতে। ৭ মার্চ যখন বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেবেন তখন বড়লেখার লোকজন আগ্রহভরে রেডিও নিয়ে বসেছিলেন। ভাষণ শোনবেন। কিন্তু তখনকার পাক সরকার রেডিওতে ভাষণ প্রচার করতে দেয়নি। ভাষণের বদলে তখন গান-বাজনা প্রচার করা হচ্ছিলো। আমরা ৮ মার্চ ভাষণ শুনি। এরপর আমরা সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলি। আমাকে বড়লেখায় সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। লাঠি হাতে আমরা প্রথমে প্রশিক্ষণ শুরু করি। মেজর সি.আর দত্ত, কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করি। রব ভাই বড়লেখায় আসেন। এরপর ভারতীয় সৈন্যরা আমাদের প্রশিক্ষণে সহযোগিতা করে। ভারতে লোকজন পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করাই। আমরা ৪ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করি। পাকিস্তানি সৈন্যরা সিলেট বিমানবন্দরে অবস্থান করছিলো। সেখানে হামলার জন্য প্রস্তুতি নিই সবার সাথে। উদ্দেশ্য ছিলো সিলেট ফ্রি করতে পারলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। কিন্তু ৩০ এপ্রিল এমসি কলেজ এলাকা দিয়ে গিয়ে পথ ভুলে দু’জন সৈন্য ধরা পড়ে যায়। তাৎক্ষণিক পাকিস্তানিরা ঢাকায় খবর পাঠায়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বৃষ্টির মতো বিমান পৌঁছে যায়। বিমান হামলা শুরু করে তারা। কোনোমতে আমরা সবাই বেঁচে যাই। এরকম নানা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হই। দিনগুলো কষ্টের ছিলো। ৬ ডিসেম্বর বড়লেখা সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়। ডা. আব্দুস শুক্কুর তখন জাতীয় সংগীত শুরু করেন।‘ সিরাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এ দেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে গর্ববোধ করি। যতোদিন বেঁচে থাকবো বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন সৈনিক হিসেবে যেনো কাজ করতে পারি। জননেত্রী শেখ হাসিনা’র নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকবে। উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ গড়তে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
পরে মুক্তিযুদ্ধের নানা বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের উত্তর দেন মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক সাংসদ সিরাজুল ইসলাম এবং উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ উদ্দিন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও পৌরসভার মেয়র আবুল ইমাম মো. কামরান চৌধুরী। পুরো অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইকবাল আহমদ। প্রশ্ন-উত্তর শেষে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দু’জন মুক্তিযোদ্ধাকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়।