- মৌলভীবাজার : করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের প্রেক্ষিতে বেতন ও রেশন চালু রেখে দেশের সকল চা বাগান অবিলম্বে বন্ধ ঘোষণার দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন দেশের ৩১ নাগরিক।
- বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বিবৃতিদাতারা বলেন, সারা বিশ্বে কোভিড-১৯ ভাইরাসটি মহামারি আকার ধারণ করেছে। দেশে দেশে জনজীবন হয়ে পড়েছে ভয়াবহ। এমন পরিস্থিতি এর আগে বিশ্ববাসী দেখেছে বলে সন্দিহান। নয়া এই ভয়াবহ দুর্যোগময় পরিস্থিতি মোকাবিলা ও ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে দেশে দেশে প্রধানত সামাজিক দূরত্ব এবং লক ডাউনের মতন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছে। বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যে সকল জনগণের জন্য সমান সুযোগ, সুবিধা নিশ্চিত করে বিশেষ করে লক ডাউনের সময়ে জনগণের প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী প্রদান ও দীর্ঘমেয়াদী ভর্তুকি প্রদানের ঘোষণাও রয়েছে। এরমধ্যে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে দাবীদার আমাদের দেশও রয়েছে। করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি কমাতে গত ২৫ মার্চ থেকে সারা দেশে সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু অবাক করার বিষয় সরকারের পক্ষ থেকে চা বাগানে কোন প্রকার ছুটি দেওয়া হয়নি।
- বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, দেশের লাখ লাখ চা শ্রমিক আজ বড়ই অসহায় হয়ে পড়েছেন সরকারি বৈষম্য আচরণে, সরকারি প্রেস নোটে তাঁদের নাম যেনো আধুনিক শ্রমদাসে পরিণত করেছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও তাঁদের কাজ করাই যেন নিয়তি। এর জন্যে অবশ্য তারা আলাদা সুযোগ সুবিধাও পাবেন না। এক দেশে দুই আইন চলছে এ দেশে। শুধুমাত্র বাগান মালিকদের খুশী রাখাতেই এ ধরণের একতরফা বিধি নিষেধ সরকার চালু রেখেছে। তাতে করে আমরা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, এদেশে সরকার মালিকদের জন্য কাজ করছে, অপরদিকে শ্রমিকদের জন্য রাষ্ট্রের সকল সেক্টরে রয়ে গেছে কেবলই শুভঙ্করের ফাঁকি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ চা বোর্ড এবং শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে চা বাগানের শ্রমিকদের করোনার ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করা হলেও, তাদের ছুটি বিষয়ক কোন ঘোষণা তারা দেন নি। তবুও শ্রমিকরা নিজেদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে নিজেদের উদ্যোগে অনেক বাগানে কর্মবিরতি দিয়েছিলেন।
- বিবৃতিদাতারা বলেন, গত ৩০ মার্চ সিলেট জেলা প্রশাসকদের সাথে মতামত বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রী জানান, চা বাগানের শ্রমিকরা দূরত্ব মেনে কাজ করে, প্রকৃতির সাথে কাজ করে বলে তাদের করোনার ঝুঁকি নেই। তাই তিনি করোনার সময়ে চা বাগানে ছুটির দরকার নেই বলে ঘোষণা দেন। আমরা এসব কথা চা শ্রমিক ও দেশের নাগরিকদের পক্ষ থেকে প্রত্যাখ্যান করে আসছি। আমরা মনে করি দেশে এমন পরিস্থিতিতে যেখানে সারা দেশ বিপর্যয় পরিস্থিতিতে রয়েছে সেখানে এসব কথা আজগুবি, ভ্রান্ত,মনগড়া ও অযৌক্তিক। এসব দায়িত্বহীন কথা-বার্তা সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে। আমরা আশংকা করছি এর মাধ্যমে করোনা ভাইরাস মহামারি আকারে ছড়াতে পারে। গত ৩১ মার্চ ডেইলি স্টারে একটি প্রতিবেদনে শ্রীমঙ্গলের মির্জাপুর চা বাগানে একজন নারী চা শ্রমিকের করোনার লক্ষণ নিয়ে মৃত্যু হবার পর আমরা সাধারণ নাগরিক সত্যিই ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। এই ঘটনা আমাদের জানায় যে, কোনভাবেই চা বাগান ঝুঁকিমুক্ত নয়। চা বাগানের শ্রমিকরা নিজেরা দূরত্ব বজায় কেবল পাতা তোলার কাজই করেন, কিন্তু এর পাশাপাশি চা পাতা পরিবহণ কিংবা ফ্যাক্টরিতে তাদেরকে কোন রূপ দূরত্ব না মেনেই কাজ করতে হয়। শুধু তাই নয়, চা বাগানের মানুষরা কেবল চা বাগানেই থাকে না। তারা হাট বাজারে যায় কাজের প্রয়োজনেই। এর পাশাপাশি বাগানে বহু বহিরাগত মানুষ আসে। করোনার ঝুঁকি এড়ানোর বড় সমাধানটি হচ্ছে, যেকোনো প্রকার জনসমাগম এড়িয়ে চলা। চা বাগান ছুটি ঘোষণা না করা হলে এই জনসমাগম কোনভাবেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব না। সবচেয়ে বড় কথা, যেখানে সারা দেশের সমস্ত প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে সেখানে চা বাগানের মানুষ কেন করোনার ঝুঁকি মাথায় রেখে কাজ চালিয়ে যাবে? ইতোমধ্যে সকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেতনসহ ১ মাসের ছুটির আদেশ দিয়েছেন। সেখানেও চা শ্রমিকরা বঞ্চিত। সকল প্রতিষ্ঠান ছুটি পেলেও, চা বাগান ছুটি না পাবার প্রতিবাদে বিভিন্ন চা বাগান শ্রমিকরা নিজেদের বাগানে কর্মবিরতি এবং মানববন্ধন করছে। এই সমাগমের ফলে চা বাগানে করোনা সংক্রমণ হবার ঝুঁকি প্রতিদিন বাড়ছে। বাগানের মালিক যেখানে হোম কোয়ারেন্টাইন যাপন করছে, সেখানে বাগানের শ্রমিক কেন সেই সুবিধা পাবে না?
- বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, চা শিল্প বাংলাদেশের একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান। প্রায় ৭ লক্ষ চা শ্রমিক নামমাত্র মজুরির বিনিময়ে এই চা শিল্পকে একটি মহীরুহে পরিণত করেছে। অথচ তাদের ন্যূনতম নাগরিক সুবিধার কথা ভাবা হচ্ছে না। এই করোনার দিনেও এই শ্রমিকদের জীবন নিয়ে কেউ ভাবছে না। চা বাগানের শ্রমিকদের কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি অন্য অনেকের চাইতে বেশি। আর তাই চা বাগানের শ্রমিকদেরকে বাঁচাতে এবং একজন নাগরিক হিসেবে তাদের সুবিধা এবং মর্যাদা প্রদানে আমরা সাধারণ নাগরিকরা দাবি জানাচ্ছি যে, অবিলম্বে মজুরি এবং রেশনসহ চা বাগানগুলোতে ছুটির ঘোষণা করতে হবে।
- বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন- মোহন রবিদাস, বাকি বিল্লাহ, জাবেদ ভুঁইয়া, মিতা নাহার, মোশফেক আরা শিমুল, সাজিবুল ইসলাম তুষার, অপূর্ব সোহাগ, পারভেজ হাসান সুমন, ইমরান ইমন, সুনীল শৈশব, পুরবী তালুকদার, বীথি হক, হৃদয় দাশ শুভ, স্বর্ণালী দাশ টুম্পা, লিংকন দাস রায়, রিতু রায়, মাসুদ রানা, কণা জাহান, রেজাউর রহমান, ফিলা পতমী, জাহাঙ্গীর জয়েস, নুরুজ্জামান, তাসফিয়া তানজিম আহমেদ প্রমা, ফেরদৌস আহমেদ উজ্জ্বল, রায়হান আনছারী, মারজিয়া প্রভা, মৌমিতা পাল, জাফরুল হাসান, ফরিদা হাসান, এমরান উদ্দীন ও জোহেব হাসান দীপ।
চা বাগানে ছুটি ঘোষণার দাবিতে ৩১ নাগরিকের বিবৃতি
শেয়ার করুন