সাইফুল্লাহ বিন নামর :: ১২ মে সুরাইয়া নক্ষত্রের উদয় হবে আর মহামারি (করোনা ভাইরাস) পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে। কয়েকজন সম্মানিত আলেমকে দেখলাম এমন আশার বাণী জাতিকে শুনাচ্ছেন খুবই নিশ্চয়তার সাথে। আসলেই কী ১২ মে সুরাইয়া নক্ষত্র উঠলে করোনা ভাইরাস বিদায় নিবে? এমন কোন কথা কি হাদীসে আছে? যে কয়েকটি হাদীসের উপর ভিত্তি করে তাঁরা এমন বক্তব্য দিচ্ছেন, সেগুলো নিয়ে আমি ভাবতে না ভাবতেই এসম্পর্কে আরও কয়েকজন মুহাক্কিক আলেমের বক্তব্য পেলাম, মোটামুটি হাদীসগুলোর প্রকৃত ব্যখ্যা সম্পর্কে নিশ্চিত হলাম, তাই ভাবলাম এ ব্যাপারে ছোট্ট কলেবরে হলেও লেখা উচিত, যাতে কেউ এমন বক্তব্যে বিভ্রান্ত না হয়। তাই আসুন আমরা হাদীসগুলো দেখি-
عن أبي هريرة، عن النّبيّ صلّى اللّه عليه وسلّم قال: ” ما طلع النّجم صباحًا قطّ وبقوم عاهةٌ إلّا رفعت عنهم أو خفّت”. وهو حديث صحيح أخرجه أحمدُ في «المُسنَدِ»
অর্থাৎ আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এমন একটা সকালের তারকা আছে, সেটা উদিত হলে ব্যাধি উঠিয়ে নেয়া হবে অথবা হালকা করে দেয়া হবে।
[হাদীসটি সহীহ, আহমাদ ইবনু হাম্বাল হাদীসটি তাঁর মুসনাদে উল্লেখ করেছেন। আবুল আব্বাস বলেছেন, হাদীসটি হাসান।]
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : إِذَا طَلَعَتِ الثُّرَيَّا صَبَاحًا رُفِعَتِ الْعَاهَةُ عَنْ أَهْلِ الْبَلَدِ
অর্থাৎ আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন সকালের সুরাইয়া নামক নক্ষত্র উদিত হবে, তখন শহরবাসী (অন্য বর্ণনায় প্রতিটি শহর) থেকে ব্যাধি উঠিয়ে নেয়া হবে।
আলোচ্য হাদীসদ্বয়ের প্রথম হাদীসে যে নক্ষত্রের কথা বলা হয়েছে, দ্বিতীয় হাদীসে নক্ষত্রটির নাম বলা হয়েছে সুরাইয়া। অন্যান্য হাদীস থেকেও জানা যায়, নক্ষত্রটি সুরাইয়া। সুরাইয়া নক্ষত্রকে বাংলায় কৃত্তিকা আর ইংরেজিতে Pleiades (প্লায়েডিয) ও Seven Sisters বলা হয়। হাদীসদ্বয়ে বলা হয়েছে নক্ষত্রটি উদিত হলে আহাত (ব্যাধি) উঠিয়ে নেয়া হবে। এই আহাত তথা ব্যাধি দ্বারা কিসের ব্যাধি বুঝানো হয়েছে তা আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুর হাদীস হতে পাই-
عَنْ عُثْمَانَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ سُرَاقَةَ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى عَنْ بَيْعِ الثِّمَارِ حَتَّى تَذْهَبَ الْعَاهَةُ . قَالَ : فَسَأَلْتُ ابْنَ عُمَرَ مَتَى ذَلِكَ ؟ قَالَ : طُلُوعَ الثُّرَيَّا
উসমান ইবনে আব্দিল্লাহ ইবনে সুরাক্বাহ হতে বর্ণিত। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যাধি চলে যাওয়ার আগে ফল বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন। বর্ণনাকারী (উসমান) বলেন আমি ইবনে উমরকে জিজ্ঞেস করলাম, কখন যাবে সেই ব্যাধি? তিনি বললেন, সুরাইয়া নক্ষত্র উদয়ের পর।
[মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ৫১০৫, বুখারীর শর্ত সাপেক্ষে হাদীসটি সহীহ]
ইবনে উমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদীসটি সহ এসংক্রান্ত অন্যান্য হাদীসগুলো একত্র করলে এটাই প্রমাণিত হয়, এই আহাত (ব্যাধি) দ্বারা ফলের ব্যাধি বুঝানো হয়েছে। এটা আরবের আবহাওয়া ও মৌসুমী ফল সম্পর্কিত। রাসূল সা. বলেছেন, তোমরা ব্যাধি দূর হওয়ার আগে ফল বিক্রি করো না [কেননা, এতে ফল পরিপক্ব না হওয়াতে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে] আর এই ব্যাধি দূর হওয়ার ক্ষণ নির্ধারণ করেছেন সুরাইয়া নক্ষত্র উদিত হওয়ার সময়কাল।
প্রথমে উল্লেখিত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদীসদ্বয়ের আলোকে “সুরাইয়া নক্ষত্রটি উদিত হলে করোনা ভাইরাস, মহামারি, প্লেগ ও অন্যান্য রোগ ব্যাধি দূর হবে” এই ব্যাখ্যাটি আমাদের করা উচিত নয়, কেননা-
প্রথমত, সাহাবায়ে কেরামের যুগেও মহামারি হয়েছে। অসংখ্য অগণিত সাহাবী মহামারিতে শহীদ হয়েছেন। কিন্তু কোন নক্ষত্র উদিত হলে মহামারি চলে যাবে, এমন বিশ্বাস সাহাবায়ে কেরাম করেছেন মর্মে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
দ্বিতীয়ত, “রাসূল সা. বলেছেন, গতরাতে আমাদের বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে একশ্রেণী ঈমান পেয়েছে একশ্রেণী কাফের হয়ে গেছে। যারা বলছে বৃষ্টিপাত হওয়ার দরুণ এটা আল্লাহর ফদ্বলে হয়েছে কোন নক্ষত্রের প্রভাবে হয়নি, তারা মুমিন আর যারা বলছে এটা নক্ষত্রের প্রভাবে হয়েছে তারা কাফের।” [বুখারী ও মুসলিম]
সুতরাং আমরা বুঝতে পারলাম নক্ষত্রের কোন প্রভাবে কোন সুলক্ষণ বা কুলক্ষণ ইসলামে নেই। এটা বিশ্বাস করা কুফরী।
তৃতীয়ত, সুরাইয়া নক্ষত্র উঠলে করোনা ভাইরাস চলে যাবে এমন ব্যাখ্যা ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিকদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া। যদি সুরাইয়া নক্ষত্র উঠলে করোনা মহামারি চলে না যায়, তাহলে ইসলাম বিদ্বেষী ও নাস্তিকরা ইসলামের সমালোচনা করার সুযোগ পেয়ে যাবে।
করোনা ভাইরাস সহ মহামারি হলো আমাদের কৃতকর্মের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে গজব। আল্লাহ যখন ইচ্ছা করবেন, তা উঠিয়ে নেবেন। এতে কোন নক্ষত্রের প্রভাব নেই। আমাদের উচিত আল্লাহর নিকট বেশি বেশি তাওবা ইস্তেগফার করা, যাতে আল্লাহ আমাদের থেকে এই গজব উঠিয়ে নেন।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, আল-ফিকহ এন্ড লিগ্যাল স্টাডিজ বিভাগ, আইন অনুষদ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।