ইতিকাফ সম্পর্কিত কয়েকটি জরুরি মাসআলা

মাওলানা রফিক আহমদ সামাদঃ

রমযানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদায়ে কিফায়াহ। বড় শহরবাসী প্রতি মহল্লার একজন এবং ছোট গ্রামের প্রতি বস্তি থেকে একজন করে ইতিকাফ না করলে এলাকার সকল লোক সুন্নাত পরিহারের দায়ে দায়ী হবেন। যদি একজনও ইতিকাফ পালন করে, তবে এলাকার সকলের পক্ষ হতে সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। কাউকে বিনিময় দিয়ে ইতিকাফে বসালে গুনাহ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না।

ইতিকাফকারীর জন্য একেবারে নিরব থাকা আবশ্যক নয় বরং; মাকরুহ। কারো সমালোচনা করা এবং ঝগড়া ফাসাদ ও অহেতুক গল্প গুজব থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

ইতিকাফের নির্দিষ্ট কোন ইবাদত নেই। নামায, তিলাওয়াত, ধর্মীয় গ্রন্থাদির পঠন এবং ইচ্ছা অনুযায়ী যে কোন ইবাদত করতে পারা যাবে।

যে মসজিদে ইতিকাফ করা হয়েছে তা যদি জামে মসজিদ না হয়, তবে জুমার নামাযের জন্য অনুমান করে উক্ত মসজিদ থেকে এতটুকু সময় হাতে নিয়ে বের হতে হবে, যেন জুমা মসজিদে পৌঁছে সুন্নাত আদায় করে খুতবা শুনতে পারা যায়। তার পূর্বে পৌঁছলেও ইতিকাফ নষ্ট হবে না।

কোন ব্যক্তির যদি এমন ব্যবসা-বাণিজ্য থাকে, যা ছাড়া তার দৈনন্দিন খরচ নির্বাহ হয় না, তখন ইতিকাফকারী মাল উপস্থিত করা ছাড়া বেচা-কেনা করতে পারবে।

পেশাব-পায়খানা থেকে ফেরার সময় পুকুরে ওযূ করতে যা সময় লাগে, ঐ সময়ে ওযূ না করে শরীরের প্রশান্তির জন্য গোসল করে নিলে কোন অসুবিধা নেই।

ঘর থেকে খাবার আনার জন্য কেউ না থাকলে ইতিকাফকারী নিজেই ঘর থেকে খাবার নিয়ে আসতে পারবে, অথবা খেয়ে আসতে পারবে। তবে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে পারবে না।

প্রাকৃতিক অথবা শরয়ী প্রয়োজন ব্যতীত স্বল্প সময়ের জন্যও মসজিদ থেকে বের হলে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। চাই ইচছাকৃত হোক কিংবা ভুল ক্রমেই হোক। এমতাবস্থায় ইতিকাফ ক্বাযা করা ওয়াজিব।

রমযানের শেষ দশদিনের ইতিকাফ করতে হলে বিশ তারিখের সূর্যাস্তের পূর্বেই মসজিদে প্রবেশ করতে হবে এবং ঈদের চাঁদ দেখার পর মসজিদ থেকে বের হতে হবে।

ইতিকাফকারীর জন্য জুমার দিনের গোসল অথবা শুধুমাত্র শীতলতা বা প্রশান্তি লাভের উদ্দেশ্যে গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয নয়। (জাওয়াহিরুল ফিক্বাহ- ১/৩৮৩)।

অনুরুপ জানাযার নামায, রোগী দেখা, পানাহার, নিদ্রা যাওয়া ইত্যাদির উদ্দেশ্যে বের হলেও ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। (বাদায়ে)।

ইতিকাফকারী ভুলবশতঃ যদি মসজিদ থেকে বের হয়ে যায়, তবুও ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। (শরহে তানবীর দ্রষ্টব্য)। ইতিকাফকারী যদি বিনা ওজরে ভুলবশতঃ মসজিদ থেকে অল্প সময়ের জন্যও বের হয় এবং ঘুরাফিরা করার নিয়্যাতও না থাকে, তবুও ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। (দুররে মুখতার- ২/৪৪৫, আহসানুল ফাতওয়া)।

শরয়ী প্রয়োজনে ইতিকাফকারী মসজিদ থেকে বের হতে পারবে। যেমন, জুমার জন্য এবং নির্ধারিত মুয়াজ্জিনের উপস্থিতিতেও আযান দেওয়ার জন্য বের হওয়া। (দুররে মুখতার- ৩/৪৪৫, আহসানুল ফাতাওয়া- ৪/৪৯৮ পৃষ্ঠা)।

নফল ইতিকাফের ক্বাযা করা ওয়াজিব নয়। কেননা নফল ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদ থেকে বের হওয়ার ফলে শুধু ভঙ্গ হয় না। বরং তখনই তা নিঃশেষ হয়ে যায় কোন ব্যক্তি যদি নির্দিষ্ট অথবা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য ইতিকাফের মান্নত করে এবং সে মান্নতের কোন এক সময়ের ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যায়, তাহলে নতুনভাবে আবার পূর্ণ ইতিকাফ ক্বাযা করা ওয়াজিব। কারণ মান্নতের মধ্যে ধারাবাহিকতা রক্ষা করা ওয়াজিব। রমযানের শেষ দশকের সুন্নাত ইতিকাফের মধ্যে যদি কোন একটি, ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যায়, তাহলে শুধুমাত্র ঐদিনের ইতিকাফ ক্বাযা করা ওয়াজিব। ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে সে ইতিকাফ নফলে পরিণত হয়ে যায়। একদিনের ক্বাযা চাই রমযানের মধ্যে হোক বা রমযানের বাইরে হোক। নফল রোযার সাথে যখনই হোক আদায় করতে হবে। (আহসানুল ফাতওয়া ৪/৫০১, দুররে মুখতার ২/৪৪)। কিন্তু পূর্ণ দশদিনের ইতিকাফ ক্বাযা করা উত্তম। (ফাতওয়ায়ে রহীমিয়া- ৫/২০৬ পৃষ্ঠা)।

যদি ইতিকাফকারী প্রাকৃতিক প্রয়োজন (প্রশ্রাব-পায়খানা) ইত্যাদি সম্পন্ন করার জন্য বাইরে যায় এবং তখন পায়খানা খালি না থাকে, তাহলে বাইরে অপেক্ষা করা জায়েয আছে। (আহসানুল ফাতাওয়া- ৪/৫০১ পৃষ্ঠা)।

ইতিকাফকারীর জন্য মসজিদের এক কোণে পর্দা ইত্যাদি দিয়ে স্থান নির্ধারিত করা মুস্তাহাব। কারণ এর দ্বারা নিজের সতর হিফাযত করা ছাড়াও অন্যান্য সুবিধাদি রয়েছে। হুযুর (সা.) এর জন্য চাটাই এর কক্ষ তৈরী করার প্রমাণ রয়েছে। এটা বিদআত নয়। কিন্তু ইতিকাফকারীকে এদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে যে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত জায়গা ব্যবহারের কারণে যাতে নামাযীদের কোন ধরনের অসুবিধা না হয় এবং কাতার সোজা করতে ব্যঘাত না ঘটে। (শরহে মিশকাত- ৪/৩২৯, তা’লিকে সাবআ-২/৪১৫, ফাতাওয়ায়ে রহীমিয়্যাহ- ৫/২০৫ পৃষ্ঠা)।

প্রাকৃতিক ও শরয়ী প্রয়োজন ব্যতীত অন্যান্য কারণে মসজিদ থেকে বের হলে ইতিককাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে। যেমন- পানিতে ডুবন্ত কিংবা অগ্নিতে জ্বলন্ত ব্যক্তির সাহায্যার্থে মসজিদ থেকে বের হওয়া আবশ্যকীয় কর্তব্য হয়ে পড়ে, কিন্তু বের হলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে। (ফাতওয়ায়ে রহীমিয়া- ৫/২০৮ পৃষ্ঠা)।

ইতিকাফকারী ব্যতীত মসজিদের ভিতরে ইফতার করা মাকরুহ। কিন্তু যদি মসজিদের ভিতরে প্রবেশের সময়ে বা যখনই স্মরণ হবে তখন নফল ইতিকাফের নিয়্যাত করে নেয়, তাহলে মসজিদের ভিতর ইফতার করতে পারবে। (আলমগীরি-৬/২১৫, ফাতওয়ায়ে রহীমিয়া- ৫/২০৫)। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে সঠিকভাবে ইতিকাফ পালন করার তৌফিক দান করেন।

মাওলানা রফিক আহমদ সামাদ

শেয়ার করুন