- এম. এ. কাইয়ুম, মৌলভীবাজার ::
- কুলাউড়ায় চুরির অপবাদে মুস্তাফিজ নামে ১৬ বছরের এক কিশোরকে হাত বেঁধে
নির্যাতনের ঘটনায়
তোলপাড় চলছে। কিশোরের শরীর এবং মাথায় রয়েছে আঘাতের একাধিক গাঢ় চিহ্ন। এ ঘটনায়
বিচার হচ্ছে, হবে, এমন আশার বানীতে ন্যায়বিচার রীতিমতো ধোঁয়াশায়। - অনুসন্ধানে জানা যায়, দুই যুবকের নারীঘটিত জটিলতা ও টাকা পয়সা সংক্রান্ত
বিরোধের জেরে কিশোর মুস্তাফিজকে নাটকীয়ভাবে বাই সাইকেল চুরির অভিযোগ দিয়ে
ফাঁসিয়ে দেয়া হয়। পুরো রাত খুঁটির সাথে হাত বেধে প্রহার করেন স্থানীয় ইউপি
সদস্য বাদশা মিয়া। কিশোরের শরীরের রয়েছে একাধিক ক্ষতের সু-স্পষ্ট চিহ্ন। - এমন অমানবিক ঘটনাটি ঘটেছে উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের চান্দপুর গ্রামের
বাসিন্দা আব্দুল জলিলের ছেলে কিশোর মুস্তাফিজ সুয়েজের সাথে। - এদিকে ঘটনার ২৩ দিন পেরিয়ে গেলেও অন্যায়ভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়ার বিচার
পায়নি বলে অভিযোগ কিশোর মুস্তাফিজের পরিবারের। - গত ২ মে টিলাগাঁও ইউনিয়নের আশ্রয় গ্রামের বাসিন্দা হোটেল ব্যবসায়ী কাইয়ূম
মিয়ার ব্যবহৃত বাইসাইকেলটি মনু নদীর আশ্রয় গ্রাম বাঁধ এলাকা থেকে হারিয়ে
যাওয়ার ঘটনা ঘটে। বারো দিন পর ১৪ মে কাইয়ুমের হারিয়ে যাওয়া বাইসাইকেলটি
পার্শ্ববর্তী পৃথিমপাশা ইউনিয়নের ছৈদলবাজারে শাহ আলমের নিকট পাওয়া যায়। খবর
পেয়ে ওইদিন রাতে টিলাগাঁও ইউনিয়নের ৬নং ওয়াডের্র সদস্য মো. বাদশা মিয়া ও ১ নং
ওয়ার্ডের সদস্য মখলিছুর রহমান, সাইকেলের মালিক কাইয়ুম, গ্রাম পুলিশ শাহাব
উদ্দিন ও ফরিদকে নিয়ে ছৈদলবাজার এলাকায় গিয়ে সাইকেলটি উদ্ধার করেন এবং এসময়
সেখানে আটকে রাখা কিশোর মুস্তাফিজকে হাত বেঁধে টিলাগাঁওয়ের আশ্রয়গ্রামে নিয়ে
আসেন। - এসময় তাঁরা মুস্তাফিজকে একটি দোকানের বেড়ার সাথে হাত বেঁধে রেখে রাতভর অমানবিক
নির্যাতন করেন বলে জানা গেছে। এদিকে রাতে ছেলের কোন খবর না পেয়ে মুস্তাফিজের
পিতা আব্দুল জলিল ও চাচা আব্দুল মান্নান বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুজি করতে থাকেন।
সকালে খবর পান মুস্তাফিজকে আশ্রয় গ্রামে চুরির অভিযোগে বেঁধে রাখা হয়েছে। এরপর
আব্দুল জলিল বিষয়টি স্থানীয়দের অবগত করেন এবং তাঁদের সাথে নিয়ে ঘটনাস্থলে যান।
সেখানে গিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ইউপি সদস্য বাদশা মিয়াকে অনুরোধ করেন।
তখন বাদশা মিয়া তাঁদের জানান মুস্তাফিজকে ছাড়িয়ে নিতে হলে ইউপি চেয়ারম্যান
আব্দুল মালিককে জানাতে হবে। তিনি নির্দেশ দিলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। পরে
আব্দুল জলিলসহ স্থানীয় মুরব্বী তছবির আলীকে নিয়ে যান ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল
মালিকের বাড়িতে গিয়ে ঘটনাটি অবগত করেন। চেয়ারম্যান আব্দুল মালিক বিষয়টি
পরবর্তীতে সালিশী বৈঠকের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে দিবেন বলে তছবির আলীর জিম্মায়
মুস্তাফিজকে তার অভিভাবকের নিকট হস্তান্তর করেন। ৩ জুন বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য
সালিশি বৈঠকের তারিখ ছিলো। - কিন্তু এর আগের দিন মঙ্গলবার ২ জুন মুস্তাফিজকে হাত বেধে রাখার একটি ছবি
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরী হলে চেয়ারম্যান আব্দুল মালিক
পূর্বনির্ধারিত সালিশী বৈঠক স্থগিত করেন। - বুধবার বিকেলে সরেজমিন কিশোর মুস্তাফিজের বাড়িতে গিয়ে তার ও তার পিতা আব্দুল
জলিল এবং চাচা আব্দুল মান্নানের সাথে কথা বলে জানা যায়, মুস্তাফিজ স্থানীয়
আশ্রয় গ্রামের বাসিন্দা মৃত হুরমত আলীর ছেলে মো. শামীম ওরফে কুদরতের সাথে মনু
বাঁধ এলাকায় বালু উত্তোলনের শ্যালো মেশিন পাহারা ও সেখানে দৈনিক মজুরীতে কাজ
করতো। সেই সুবাদে গত ২ মে ব্যবসায়ী কাইয়ুমের সাথে কুদরতের টাকা পয়সার লেনদেন
সংক্রান্ত ও নারীঘটিত পূর্ব বিরোধের জেরে কাইয়ুমের বাই সাইকেলটি পাশ্ববর্তী
পৃথিমপাশা ইউনিয়নের ছৈদল বাজারে শাহ আলমের নিকট পাঠাতে কিশোর মুস্তাফিজকে বলে
কুদরত। তার কথামতো কিশোর মুস্তাফিজ সাইকেলটি শাহ আলমের নিকট পৌঁছে দেয়। এরপর
ওই সাইকেলটি চুরি হয়েছে বলে অভিযোগ এনে অন্যায় ভাবে তাকে বেঁধে মারধর করা হয়।
এখনো তাঁর শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। - তারা আরো বলেন, চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্য আমাদের বিষয়টি বৈঠকের মাধ্যমে
নিষ্পত্তি করে দিবেন বলে আশ্বাস প্রদান করলে আমরা প্রশাসন কিংবা সাংবাদিকদের
বিষয়টি জানাইনি। - ছেলের পিতা আব্দুল জলিল বলেন, কাইয়ুম ও কুদরতের বিরোধের কারণে আমার ছেলেকে
অন্যায়ভাবে ফাঁসিয়ে চুরির অপবাদ দিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হলো। এতে
সামাজিকভাবে আমার পরিবারের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়েছে। এ ঘটনার আমরা ন্যায় বিচার
চাই প্রশাসনের কাছে। - এ বিষয়ে শামীম ওরফে কুদরত জানায়,‘মুস্তাফিজকে নিয়ে মনু বাঁধে বালু উত্তোলনের
কাজ করতে গিয়ে কাইয়ুমের হোটেলে গিয়ে খাওয়া দাওয়া করার সুবাদে সে অনেক সময়
অতিরিক্ত টাকা আমার কাছ থেকে রাখতো। পরবর্তীতে সেই অতিরিক্ত টাকা ফেরত চাইলে
কাইয়ূম আমাকে তাঁর বাই সাইকেলটি দিয়ে দেয়। সেটি বিক্রির জন্য মুস্তাফিজকে দিয়ে
ছৈদল বাজারে শাহ আলমের কাছে পাঠাই এবং পরে একদিন আবার সেই টাকা আনার জন্য
মুস্তাফিজকে সেখানে পাঠাই।’ - কুদরত আরো জানায়, ‘কাইয়ূম আমাকে আমার পরিচিত এক নারীর সাথে অবৈধ কাজ করার জন্য
বলতো। আমি না করায় ওই নারীর মোবাইল নাম্বার দিতে বলতো। এজন্য কাইয়ূম
পরিকল্পিতভাবে আমাকে সাইকেল দিয়ে পরে সেটি চুরির অভিযোগ তুলে। এরপর মুস্তাফিজ
ওই এলাকায় গেলে তাকে সেখানে আটকে রেখে মারধর করা হয়। আসলে সাইকেল চুরির কোন
ঘটনা ঘটেনি। মুস্তাফিজকে কেন মারধর করা হল সেটা আমি অবগত নই। মেম্বারের ভয়ে
আমি তখন এলাকা ছেড়ে গা ঢাকা দেই।’ - এ বিষয়ে ব্যবসায়ী কাইয়ুম জানান, ‘আমার ব্যক্তিগত পুরাতন বাই সাইকেলটি
টিলাগাঁওয়ের চড়ক বাঁধ এলাকায় রেখে আমার বোনের বাড়িতে যাই। সেখান থেকে ফিরে
সাইকেলটি পাইনি। বিষয়টি মেম্বার বাদশা মিয়াকে জানাই। পরে জানতে পারি সাইকেলটি
ছৈদলবাজারে আছে এবং সেখানকার লোকজন মুস্তাফিজকে আটকে রেখে খবর দিলে মেম্বারসহ
আমরা সেখানে যাই। এসময় তাঁকে হাতে বেঁধে আশ্রয়গ্রামে আনা হয়। এসময় কিশোরকে কি
করেছেন মেম্বার সেটা মেম্বারই ভালো বলতে পারবেন।’ - অভিযুক্ত ইউপি সদস্য বাদশা মিয়া জানান, ‘আমার ওয়ার্ডের ব্যবসায়ী কাইয়ুমের চুরি
যাওয়া সাইকেলটি পৃথিমপাশার ছৈদল বাজারে পাওয়া গেছে বলে জানতে পেরে সেখানে
গ্রাম পুলিশসহ যাই।
কিশোর মুস্তাফিজের উশৃঙ্খল আচরণ ও যাতে পালিয়ে না যায় সেজন্য তাকে সেখান থেকে
হাত বেধে আশ্রয়গ্রামে একটি দোকানে এনে রাখা হয় তবে কোন মারধরের ঘটনা ঘটেনি।
বিষয়টি সালিশি বৈঠকে নিষ্পত্তির জন্য। - এ বিষয়ে টিলাগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মালিক জানান, চুরি যাওয়া সাইকেলটি গত
১৪ মে পৃথিমপাশার ছৈদলবাজার থেকে উদ্ধার করা হয় এবং এসময় এ ঘটনায় জড়িত আটক
মুস্তাফিজকেও সেখান থেকে হাত বেঁধে আশ্রয়গ্রামে নিয়ে আসেন ইউপি সদস্য বাদশা
মিয়া। মুস্তাফিজের অভিভাবক তাকে ছেড়ে দেওয়ার ও বিষয়টি নিষ্পত্তির অনুরোধ করেন।
পরে ৩ জুন বিষয়টি সালিশী বৈঠকে নিষ্পত্তি করার তারিখ নির্ধারণ করা হয়। এর আগের
দিন বিষয়টি বানচালের উদ্দেশ্যে একটি গোষ্ঠী ফেসবুকে ছবিটি ভাইরাল করেছে। - তিনি বলেন, প্রশাসন বিষয়টি আমার কাছে জানতে চাইলে আমি প্রশাসনকে ঘটনাটি তদন্ত
করে দেখার জন্য বলি। - এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এটিএম ফরহাদ চৌধুরী সাংবাদিকদের
জানান, ’ঘটনাটি শুনেছি। মারধরের ঘটনা সত্যি হলে এটা খুবই অমানবিক।
শুকিয়ে যাচ্ছে আঘাতের ক্ষত চিহ্ন, ধোঁয়াশায় ন্যায়বিচার!
শেয়ার করুন