মোহাম্মদ আখতার হুসাইন, টরন্টো, কানাডাঃ
মানুষ ভাবে যে, যেইদিন সে জন্ম নিয়াছে, সেইদিন খুবই মূল্যবান। আমার কাছে মূল্যবান হইলো সেই দিন, যেই দিন সে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়া জানিবে, কেন সে জন্ম নিয়াছে!!
আমাদের সকলের পশ্চাৎদেশেই স্রষ্টার লাথির কৃষ্ণচিহ্ন এখনো বিদ্যমান রহিয়াছে। অতিভোগের মাত্রাতিরিক্ত লিপ্সার কারণে আমরা স্রষ্টার লাথি খাইয়া স্বর্গ হইতে বিতাড়িত হইয়াছিলাম। সেই অতিভোগের মাত্রাতিরিক্ত লিপ্সা এখনও আমাদের সবার মাঝে প্রবল আকারে বিদ্যমান। বর্তমান সমাজ সেই চিত্রই বহন করিতেছে।
কতো অর্থ আয় বা জমা করিয়াছি তাহা দিয়া আমরা আমাদের জীবনের সফলতা মাপিয়া লইতে পারি কিন্তু সেই সফলতা দিনের শেষে বা জীবনের শেষে সার্থকতা আনিয়া দিতে পারিবে না।
কতোটা জ্ঞান আর বোধ আমাদের মাঝে উদয় হইয়াছে তাহার ওপর ভিত্তি করিয়া আমাদের সার্থকতা নির্ণয় হইবে। ফলে, সফল হওয়া মূল কাজ নহে বরং সার্থক হওয়া মূল কর্ম জানিতে হইবে—মানিতে হইবে।
আমরা সবাই আবার স্বর্গে ফিরিয়া গিয়া সুরা-নারী ভোগের জন্য উদগ্রীব কিন্তু মরিতে রাজী নহি। ফলে, অনেকেই না মরিয়াই এই ধরাধামেই স্বর্গ বানাইতে শুরু করিয়াছে।
বাগে আনিয়া ভোগের অভিপ্রায়ের নিমিত্তে স্বর্গাভিলাষীদের এহেন নিয়ন্ত্রনহীন আচরণে ধরাধাম এখন নরকধাম-নরকে পরিণত হইয়াছে। স্বর্গদূতগণ কোণঠাসা হইয়া ধরাধাম হইতে বিতাড়িত হইয়াছেন।
সমাজে তাল নাই, সুর নাই, লয় নাই। সর্বত্র অসুরের দাপাদাপি।
যেকোনো মূল্যে বিখ্যাত হওয়ার বাসনা, যেকোনো প্রক্রিয়ায় সম্পদ অর্জনের মানসিকতার কারণে ‘আদম সমাজ’ এখন ‘অধম সমাজে’ পরিণত হইয়াছে।
সৃষ্টির মধ্যে আদম সমাজই এখন নোংরামীর তলানীতে আসিয়া ঠেকিয়াছে। প্রকৃতিও সীমাহীন অত্যাচার সহ্য করিতে না পারিয়া মাঝে মাঝেই ফুসিয়া উঠিতেছে। জলে, স্থলে আর অন্তরীক্ষে প্রকৃতির রোষানল সর্বভুতেই অনুভব করিতেছে।
খারাপ চিন্তায় মস্তিষ্ককে প্রক্ষালণ করিয়া রাখিয়াছে বিধায় খারাপ কর্ম করিতেছে। খারাপ কর্মের প্রভাবে খারাপ স্বপ্ন দেখিতেছে।
নিয়ন্ত্রণহীন স্বপ্নের মধ্যে চাকচিক্যময় শৌচাগার দেখিয়া উহার অবাধ ব্যবহার করিয়া নিজের বাস্তব শয্যা নোংরা করিয়া ফেলিতেছে।
আদমজাত ভুলিয়া গিয়াছে যে, সৎকর্মের অভাবহেতু সৎস্বপ্ন আসে না আর সৎস্বপ্নের অভাবে সৎ-সুন্দর ভবিষ্যৎও গড়িয়া ওঠে না।
যেমন আলো-বায়ু-খাবার গ্রহণ করিবে তেমন আত্মা গড়িয়া উঠিবে। ভাবে-চিন্তায় যেমন মানসিকতা থাকিবে তেমন কর্ম করিবার অভিলাষই হইবে।
চুরি করিয়া খাইলে মানসিকতায়ও চোর চোর ভাব থাকিয়াই যাইবে—খাকি পোষাক দেখিলে মনের ভেতরে অস্থিরতা আসিতেই থাকিবে।
ঘটিত ঘটনার ছায়া-স্মৃতি কোনোভাবেই মুছিয়া দেওয়া যায় না। ফলে, পাপকর্মের ফলাফলও মুছিয়া ফেলা যায় না।
ভুলের ক্ষমা হইলেও পাপের ক্ষমা হয় না—প্রায়শ্চিত্ত করিয়াই সামনে আগাইতে হয়। পরিণতি জানিয়াও যাহারা অকর্ম-কূকর্ম করে তাহারা আত্মাকে কলুষিত করিয়া লয়। কলুষিত আত্মা পরিবার ও সমাজের জন্য বোঝাস্বরূপ।
আদমজাত এতো হিংস্র হইয়া উঠিল কেন? ধর্ম আর সংস্কৃতিকে আলাদা করিয়া ফেলিয়াছে।সত্তাজ্ঞানে জ্ঞানবান না হইয়া ব্রতপ্রথার বাণিজ্য করিতেছে।
পাপাত্মার চাপ আর মানসিক সুখের অভাবেহেতু সামাজিক নিরাপত্তার অভাবও প্রকট হইয়া যাওয়াতে আদমজাত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিতেছে। নিজেদের কৃতকর্মের চক্রবুহ্যে নিজেরাই আটকাইয়া পড়িয়াছে। অনেকেই তারস্বরে মুক্তির জন্য ক্রন্দন করিতেছে।
কিল, তেল আর কথা একবার পড়িয়া গেলে উহা আর উদ্ধার করা যায় না। ঠিক তেমনিভাবে কর্ম করা হইয়া গেলে তাহাও আর উদ্ধার করা যায় না। কর্মফল স্কন্ধে লইয়া সামনে আগাইতে হয়।
খারাপ কর্মের ফল ধীরে ধীরে আত্মাকে আরো অশান্ত করিয়া দেয়। বর্তমান সমাজের অধিকাংশ আদমজাত অশান্ত আত্মা বহন করিতেছে। অশান্ত আত্মা আরো অশান্ত আত্মার জন্ম দিতেছে। জগৎও অশান্ত হইয়া থাকিতেছে।
আমরা আমাদেরকে আত্মাকে অন্ধকারে রাখিয়া দিব্যদর্শনের স্বপ্ন দেখিতেছি। মুলা বীজ বপন করিয়া কলা খাইবার আশায় দিনাতিপাত করিতেছি। বাস্তব কর্মবিহীন জীবনযাপন করিয়া কল্পিত ঈশ্বরের অবারিত সাহায্যের আশায় ঊর্ধাকাশে হস্ত প্রসারিত করিতেছি। আমাদের পূর্বপুরুষের মতো আমরাও পঙ্কিলতায় পূর্ণ কৃষ্ণগহব্বরে নিজেদেরকে হাসিমুখে ঠেলিয়া দিতেছি।
জীবনের শেষ প্রান্তে আসিয়া মনে হইতেছে যে, যাহা জড়ো করিয়াছি তাহা আমাদের আত্মার জন্য বিষময়। সময় শেষ হইয়া যাইবার কারণে অতীতে ঘটিয়া যাওয়া কর্মের আর সংশোধন করা যাইতেছে না। পাপের স্মৃতি আত্মায় ধারণ করিয়া সময়ও কাটানো যাইতেছে না—অন্তরাত্মা অশান্ত হইয়া উঠিতেছে। মরার পরে সেই অশান্ত আত্মার শান্তির জন্য লোক ভাড়া করিয়া দুই খণ্ড জিলাপী খাওয়াইয়া পরিত্রাণ পাওয়ার কল্পিত আশা করিতেছি।
কাজের কাজ কিছুই হইতেছে না। অপকর্মে জগৎ বিষাক্ত হইয়া উঠিতেছে।