নিজস্ব প্রতিবেদক:
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেছন, বাংলাদেশের কোন ভাষাকেই হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না, যে কোন মুল্যে বিলুপ্তির পথে চলে যাওয়া খাড়িয়া সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা (ফার্সী) ভাষাকে রক্ষা করতে হবে। এর জন্য তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে দ্রæত উদ্যোগ নেয়ার আহবান জানান।
শুক্রবার দুপুরে তিনি শ্রীমঙ্গলস্থ বাংলাদেশ চা গবেষনা কেন্দ্রের গেস্ট হাউসে দেখা করেন খাড়িয়া জাতি গোষ্টীর সাথে। তিনি খাড়িয়া জাতি গোষ্ঠীর সাথে দীর্ঘক্ষন কথা বলেন এবং তাদের ভাষায় কথোপকথন শুনেন। প্রধান বিচারপতির সাথে শ্রীমঙ্গল বর্মাছড়া চা বাগানের খাড়িয়া সম্প্রদায়ের দুই বোন ভেরোনিকা কেরকেটা ও খ্রিস্টিনা কেরকেটা তাদের ভাষায় কথা বলেন এবং তাদের সম্প্রদায়ের অপর একজন জহরলাল ইন্দোয়ার তা বাংলায় বর্ননা করেন।
এসময় উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন, মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক উর্মি বিনতে সালাম, সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আল-মাহমুদ ফায়জুল কবির, জেলা পুলিশ সুপার মো. মনজুর রহমান, শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো আবু তালেব, শ্রীমঙ্গল থানা অফিসার ইনচার্জ বিনয় ভুষন রায়, শ্রীমঙ্গল উপজেলা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বিকুল চক্রবর্তী ও রাজঘাট ইউনিয়ন পরিষদেও চেয়ারম্যান বিজয় বুনার্জী।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ভাষা বৈচিত্রের দেশ আমাদের বাংলাদেশ। তিনি গণমাধ্যম থেকে জেনেছেন খাড়িয়া সম্প্রদায়ের দুইজন লোকই বেঁচে আছেন যারা তাদের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারেন। তারা মারা গেলে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাবে এই ভাষা। এই বিষয়টি তাকে ভাবান্বিত করেছে তাই তিনি এই দুইজন মহিলার সাথে দেখা করতে এসেছেন। এখানে এসে তিনি আস্বস্ত হয়েছেন শুধু দুইজন নয় এই ভাষায় কথা বলতে পারা আরো কয়েকজন আছেন এবং খারিয়া জনগোষ্টীর প্রায় আড়াই তিন হাজার মানুষ বাংলাদেশে বসবাস করছেন। এ সময় এই ভাষাটি রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ উদ্যোগ গ্রহনের প্রয়োজনীতা উপলব্দি করে তিনি সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগকে উদ্যোগ নিতে বলেন।
তিনি বলেন, আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা। কিন্তু এর বাহিরেও আরো অনেক ভাষা রয়েছে। আমাদের দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা ভিন্ন। রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা সবার জন্য প্রজোয্য কিন্তু দেশে যার যার যে মাতৃভাষা আছে সেটা ঠিকিয়ে রাখার জন্য সরকার মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছে। মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট হয়তো প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তবে এটি রক্ষার জন্য এবং এর বর্ণমালা সংগ্রহের জন্য ভারতের যে রাজ্যে খাড়িয়া সম্প্রদায়ের লোক আছেন প্রয়োজনে সেখান থেকে তা সংগ্রহ করতে হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়ে ভারতীয় হাইকমিশনেরও সহায়তা নেয়া যেতে পারে।
অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ আমিন উদ্দিন বলেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের অনেক প্রকল্প আছে। শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে বা জেলা প্রশাসনের কোন প্রকল্পের মাধ্যমে ছোট ছোট প্রকল্প গ্রহনের মাধ্যমে এই ভাষাগুলো রক্ষার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম জানান, প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের যে নির্দেশনা এই খাড়িয়া সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা যাতে বিলুপ্ত না হয় সে ব্যবস্থা গ্রহনের। সে লক্ষে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন কাজ করবে। ভারতের অঙ্গরাজ্য থেকে তাদের এই বর্ণমালা সংগ্রহ করে এখানে ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীর একটি ভাষা শিক্ষা বা ভাষা
চর্চা কেন্দ্র করার উদ্যোগ নেয়া হবে। এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আবু তালেব বলেন, উপজেলা প্রশাসন থেকে ইতিমধ্যে ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীর কয়েকটি ভাষার উপর বই আকারে প্রকাশ করে তা বিতরণ করা হয়েছে। খারিয়া সম্প্রদায়ের নিজস্ব বর্ণমালা পাওয়া যায়নি। শ্রীমঙ্গলে প্রায় দুই হাজার মানুষ আছেন খাড়িয়া সম্প্রদায়ের। এদের মধ্যে মাত্র ১০/১২ জন এই ভাষায় কথা বলতে পারেন। তবে তাদের কেউই এই ভাষার বর্ণমালা জানেন না। তাই এই ভাষা যাতে বিলুপ্ত না হয় এ জন্য যারা এই ভাষায় কথা বলতে পারেন তারা প্রতি রবিবার নিজ বাগানে তাদের নতুন প্রজন্মকে এই ভাষার উপর ক্লাস করান। তিনি বলেন, শীঘ্রই একটি প্রকল্পের মাধ্যমে এই ভাষা সংরক্ষনের কাজ শুরু করবেন।
খাড়িয়া জনগোষ্ঠীর নেতা জহর লাল ইন্দোয়ার বলেন, তাদের পূর্বপুরুষ ভারতের রাচি এলাকা থেকে এদেশে আসে যার বসতী মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন চা বাগানে। তিনি বলেন, মুখে মুখেই এই ভাষা চলমান এর কোন লিখিত রুপ বাংলাদেশে নেই। খাড়িয়া সম্প্রদায়ের মানুষ তিন ভাগে বিভক্ত। ঢেলকি খাড়িয়া, দুধ খাড়িয়া ও পাহাড়ীয়া খাড়িয়া। এই তিনটি খাড়িয়া সম্প্রদায় আবার ৯টি গোত্রে বিভক্ত। এ গুলো হলো ইন্দোয়ার, বাঘোয়ার, নানোয়ার, ধানোয়ার, কেরকেটা, সরেং, কুলু, টানালয়া ও তপ¦ । এই ভাষায় কথা বলতে পারা খ্রিস্টিনা কেরকেটা বলেন, তিনি চা বাগানে কাজ করেন। ভাষা শিখানো জন্য তাকে সময় দিতে হলে অন্যকাজ তিনি করতে পারবেন না। সংসার চালানোর জন্য তাকে কাজ করতে হয়। তবুও তারা দুই বোন প্রতি রবিবার কিছু সময় ব্যয় করে তাদের অনান্য শিশুদের এ ভাষা শিখান।
ভেরোনিকা কেরকেটা বলেন, এই ভাষা তিনি তার মায়ের কাছ থেকেই শিখেছেন। কিন্তু তার ছেলে মেয়ে ভালো পারেনা। তবে কথা বললে তারা বুঝে। কিছু কিছু বলতেও পারে। তিনি বলেন, কাজে কর্মে ছেলে মেয়েরা বাহিরে চলে গেলে তখন এই ভাষায় আর কথা বলার প্রয়োজন হয়না। অন্য ভাষায় কথা বলতে বলতে মায়ের ভাষাটা সন্তানরা ভুলে যাচ্ছে। তাছাড়া নিজ সম্প্রদায়ের বাহিরে বিয়ে করায় বাবা ও মায়ের ভাষা ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সন্তানরা কোন ভাষাই ভালো করে শিখতে পারে না। তারা একটি মিশ্র ভাষায় সন্মুখিন হয়।
শ্রীমঙ্গল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সমন্বয়ক তাজুল ইসলাম জাবেদ বলেন, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলায় এ সম্প্রদায়ের মানুষ প্রায় তিন হাজারের মতো। এর মধ্যে ১৫/২০ জন এই ভাষায় কথা বলতে পারেন।