ন্যাশনাল ব্যাংক শ্রীমঙ্গল শাখার সাবেক  ব্যবস্থাপকের নানা অনিয়ম দূর্নীতি আর ঘুষ বাণিজ্যে- আঙুল ফুলে কলা গাছ !

  • মৌলভীবাজার প্রতিনিধি.
  • বাংলাদেশ ন্যাশনাল ব্যাংক (পিএলসি) শ্রীমঙ্গল শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক, বর্তমান মৌলভীবাজার শাখার  ব্যবস্থাপক বনমালী রায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের উভোগ উঠেছে । তিনি দীর্ঘ প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর ধরে শ্রীমঙ্গল শাখায় দায়িত্ব থাকাকালীন সময়ে বিভিন্ন গ্রাহকদের প্রনোদনা  ও  সিসি ঋণ প্রদানের বিনিময়ে উপকারভুগি গ্রাহকদের কাছ থেকে মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ার অভিযোগ রয়েছে। অবৈধ উপায়ে টাকা কামিয়ে আজ তিনি আঙুল ফুলে কলা গাছ হয়ে গেছেন! বিগত ফ্যাসিস্ট সৈরাচারী সরকারের কথিত স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতাদের সাথে সখ্যতা  থাকায় সহজ হয় দুর্নীতি জড়িয়ে পড়েন।  এসব অবৈধ টাকা দিয়ে তিনি বিলাশবহুল বাড়ি-গাড়ি করার পাশাপাশি একাধিক রিসোর্টে শেয়ার রয়েছে ।
  • খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বনমালী রায় ২০১৫ সাল ন্যাশনাল ব্যাংক শ্রীমঙ্গল শাখায় যোগদান করেন। এর আগে তিনি ফেঞ্চুগঞ্জ শাখায় কর্মরত ছিলেন। ভুক্তভূগিরা অভিযোগ করেন,  তিনি উপকারভুগিদের ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ১০% ঘুষ নিতেন। অর্থ্যাৎ এক লাখ ১০ হাজার।  ১০ লাখে এক লাখ টাকা। এটি তার নিয়মে পরিনত হয়। এভাবে শ্রীমঙ্গল শাখায় যোগদান করার অল্পদিনের মধ্যেই বিশাল অর্থবিত্তের মালিক বনে যান। তিনি শহরতলীর মৌলভীবাজার সড়কের ৪নং পুল এলাকায় (জেটি রোড) এলাকায় কয়েক কোটি টাকা খরচ করে বিশাল জায়গা জুড়ে একটি  টি-প্লেক্স বাড়ি গড়ে তুলেছেন। এছাড়া অবৈধ উপায়ে অর্জন করা টাকা ইনভেস্ট করেছেন নামে বেনামে একাধিক রিসোর্টে শেয়ারের মাধ্যমে। চসে বেড়ান লেটেস্ট মডেলের গাড়ি দিয়ে ।
  • নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যাংকের সাবেক এক কর্মকর্তা জানান, বনমালী যেসব শাখায় দায়িত্ব পালন করেছেন সে শাখায় গাড়ি মেরামত ও গাড়ির জ্বলানী খরচ বাবদ ভূয়া বিল ভাউছার বানিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন। এমনকি তার বাসার এসি’র বিল ও ব্যাক্তিগত গাড়ির জ্বালানী খরচ ব্যাংকের নামে ভাউচারের করে লুটে নিতেন ব্যাংকের টাকা। এছাড়া ব্যাংকের এসিসহ নানান সরঞ্জাম ক্রয়বাবত কারসাজি করে বিশাল অংকের টাকা লুটে নেন তিনি।
  • ন্যাশনাল ব্যাংক শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজার শাখার সাবেক ব্যাংক অফিসার  শায়লা আক্তার বলেন, দীর্ঘ ছয় বছর তার অধীনে ব্যাংকে কর্মরত থাকায়বস্থায় যে প্যারা এবং মানসিক ভাবে নির্যাতন করেছে এতে আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ি। তিনি নানাভাবে আমাকে ইনসাল্ট করতো। কাজ না থাকলেও রাত ১০-১১ পর্যন্ত অফিসে বসিয়ে রাখতো। শাখার যাবতীয় কাজ আমাকে দিয়ে করাতো। অফিসে পুরুষ স্টাফ থাকা-সত্বে তিনি আমার ঘাড়ে সব চাপাতেন। তার অনিয়মের কোন শেষ নেই। তিনি আরও বলেন, তার সাথে বসে যদি রোমান্টিক গল্পসল্প করতাম তাহলে হয়ত আমাকে এসব প্যারা দিতো না। কিন্তু আমিতো এই স্বভাবের নারী নই । যার ফলে আমি মানষিক যন্ত্রণা নিয়ে চাকরি থেকে অব্যাহতি নেই। সেই মানষিক যন্ত্রণা  থেকে লিভারের সমস্যা হয়েছে। আমি বিদেশে গিয়ে এখনো হাসাপাতালে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে বলে যোগ করেন শায়লা।
  • অভিযোগ উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে কিছু বড় কর্মকর্তার সাথে তার দহরম-মহরম থাকায় তাদের দোহাই দিয়ে ব্যাংকের ঋণ প্রদানের নামে  গ্রাহকের কাছ থেকে মোটা অংকের উৎকোচ নিতেন। এমনকি তার টার্গেট  থাকতো সুন্দরী উপকারভুগি নারীদের ঋণ  প্রদানের ক্ষেত্রে। তিনি সুযোগ বুঝে নানা কুপ্রস্তাব দিতেন ঋণগ্রহীতা নারীদের। আবার অনেক উপকারভুগিকে লোভ দেখিয়ে তাদেরকে নির্দিষ্ট কিছু রিসোর্টে নিয়ে মনোরঞ্জন করারও অভিযোগ উঠেছে।অভিযোগ রয়েছে. সম্প্রতি শ্রীমঙ্গল থানার উল্টো পাশে অবস্থিত আল -আমিন মার্কেটের দু’তলায় ব্যাংকের শাখা থাকাবস্থায় তার অধীনস্থ এক নারী স্টাফকে নানাভাবে উক্ত্যক্ত করতেন । ব্রাঞ্চে পুরুষ স্টাফ থাকা সত্বেও  রাত্র ১০- ১১টা পর্যন্ত অফিসে বসিয়ে রাখতেন তিনি ওই নারী কর্মীকে। পরে ওই নারী সেচ্ছায় চাকরি থেকে অব্যাহতি নিয়ে বিদেশে পাড়ি দেন। ফারজানা বেগম নামের ভূক্তভূগি আরেক নারী কর্মকর্তা মানষিক চাপ সহ্য করতে না পেড়ে রাত্র ১০টায় ব্রাঞ্চে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। তিনি তার অধিনস্থ  নারী সহকর্মীকে সব মানষিক চাপে রাখতেন। পুরুষ স্টাফ থাকা সত্বেও নারী সহকর্মীদেরকে দিয়ে নগদ টাকা সিলেট পাঠাতেন।অভিযোগ রয়েছে শ্রীমঙ্গল আল আমিন মার্কেটের দু’তলা থেকে  ব্রাঞ্চ স্থানান্তর করার নামে নতুন ভবনের মালিক স্বপন রায়ের কাছ থেকে সাত লাখ টাকা উৎকোচ গ্রহন করার। বিষয়টি নিয়ে শহরের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে ওপেন সিক্রেটের মতো সিরাজ শেখ নামে শহরের এক ব্যবসায়ী বলেন, আমাকে জোর করে করোনাকালীন ৩০ লাখ টাকা প্রনোদনা ঋণ দিয়েছে বনমালী রায়। এ ঋণ আমি নিতে চাইনি। ব্রেন ওয়াশ করে তিনি আমার বিশাল ক্ষতি করেছে । বিষয়টি আমি কারো কাছে বলতেও পারছি না, সইতেও পারছি না। তিনি আরও বলেন,  বনমালী কি যে চতুর এবং ধান্দাবাজ সেটা তার সাথে না মিশলে কেউ বুঝতে পারবে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে শহরের আরো এক বড় ব্যবসায়ী বলেন, আমাকে কয়েক কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বনমালী রায়। তার বিনিময়ে সে আমার কাছ থেকে উৎকোচ নিয়েছে অনেক টাকা। প্রনোদনা  ঋণ আমাকে দুই বারে ৬০ লাখ টাকার মতো দিয়েছে, তার বিনিময়ে একটি প্রাইভেট কার গাড়ি তাকে উপহার হিসেবে আমাকে দিতে হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা টাকা দিতে চাইনি, এতে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে নানান শর্ত জুড়ে দেন। শেষে সমঝোতার মাধ্যমে লেনদেন করি। তিনি আগে বলে দেন যে আমি এত টাকা ঋণ দিবো তার বিনিময়ে এত টাকা আমাকে দিতে হবে।
  • অনুসন্ধানে আরো জানাযায়, শাখা ব্যবস্থাপক  বনমালী রায়  শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাধানগর এলাকায় অরণ্যে দিন-রাত্রি রিসোর্টে শেয়ার রয়েছে তার পরিবারের নামে। সেই রিসোর্টের জমি নিয়ে আদালতে মামলা চলমান থাকাবস্থায় তিনি মৌলভীবাজার শাখা থেকে এক কোটি টাকার ঋণ প্রদান করেন ওই জমি মর্গেজ নিয়ে। ওই রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী কুমকুম হাবিবা ও শামিমা আক্তারের ২টি বুটিক হাউসের নামে সিসি ঋণ প্রদান করা হয়। জেন্সিস এন্ড জেনিফার নামের বুটিক হাউজের ঠিকানা ব্যবহার করা হয় শ্রীমঙ্গল পৌর শহরের পোষ্ট অফিস সড়কের এম সাইফুর রহমান মার্কেটে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানাযায়, এই নামে ওই মার্কেটে অদৌ তাদের কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান’ই নেই। ধারনা করা হচ্ছে বড় অংকের উৎকোচের বিনিময়ে তিনি নাম ঠিকানা বিহীন প্রতিষ্টানের নামে এ ঋণ প্রদান করেন।
  • এভাবে আরো ৮-১২ টি কৃষি ঋণ প্রদান করার অভিযোগ পাওয়া গেছে যেগুলোর ঠিকানার সাথে প্রতিষ্টানের অস্থিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে তিনি নিজেই এসব ঋণের প্রকৃত উপকারভুগি।
  • দেশের প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হওয়ার কারণে মানুষ মন খুলে কথা বলছে।  কিন্তু তার আগে  ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররা ন্যাশনাল ব্যাংকের টাকা লুটেপুটে খেয়ে সাবাড় করে গেছে । অভিযোগ রয়েছে শ্রীমঙ্গল উপজেলায় দীর্ঘদিন চাকরির সুবাধে শহরের প্রভাবশালী আওয়ামীলীগ নেতা ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ভানুলাল রায়, কথিত সুশীল সমাজের নেতা অবিনাশ আর্যাচ্য ও আওয়ামলীগ নেতা জহর তরফদার, সাবেক কৃষি মন্ত্রী কলেজের একাউন্ট  বিকাশ দেব বাপনসহ তার বিশাল একটি সিন্ডিকেট গ্রæপ গড়ে তুলে। সেই সিন্ডিকেটের হোতাদের মাধ্যমে তার আধিপত্য বিস্তার লাভ করতে থাকে। ওই সিন্ডিকেট চক্রের বন্ধন সমিতি নামে ক্রেডিট ব্যবসা থাকায়, সেখানে নামে বেনামে গ্রাহককের ঋণ প্রদান করেছেন। বিনিময়ে তিনি বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন।  নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক ভুক্তভুগি জানিয়েছেন ঋণ দেওয়ার নামে তিনি তাদেরকে নিঃস্ব করে ছেড়েছেন।এসব কারো কাছে বলতে পারছেন না। ইজ্জত সম্মানের ভয়ে কাউকে বলতে চান না তারা।
  • নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক ব্যবসায়ী জানান, করোনাকালীন সময়ে প্রনোদনা ঋণ নিজের ব্যক্তি স্বার্থ যেখানে ছিলো, সেই ব্যক্তিদেরকে ৩০ লাখ থেকে শুরু করে ৬০ লাখ টাকাও ঋণ দিয়েছেন। নিজের প্রভাব খাটিয়ে ঋণ প্রদানের নামে  অবৈধ টাকা ইনকাম করে বিভিন্ন রিসোর্ট ও বাসা-বাড়ি নামে বেনামে কিনে তিনি এখন আঙুল ফুলে গাছ হয়েছেন।  হরিপুর অয়েল এন্টারপ্রাইজের প্রোপাইটার আব্দুল মুকিত চৌধুরীর বলেন, চারটি দোকান দেখিয়ে  কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন ২ কোটি টাকার বিনিময়ে ব্যাংক ম্যানেজার বনমালী ২০ লাখ তার কাছ ঘুষ নেন ব্যাংকের সাবেক দুই উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার নাম বলে। সেই টাকার শোক সইতে না পেয়ে সম্প্রতি মুকিত চৌধুরী মারা যান। তিনি জীবদ্দশায় অনেক কিছু এ প্রতিবেদককে বলে গিয়েছেন।ব্যাংক একটি সূত্রে জানা গেছে, শ্রীমঙ্গল শহরের সপ্তডিঙ্গা এন্টারপ্রাইজ, দুলাল হাজী, সিরাজ শেখ, হরিপুর অয়েল, অরন্যের দিন রাত্রি ও জেন্সিস এন্ড জেনিফার বুটিক হাউসসহ কয়ে ‘শত ব্যক্তিকে মোটা অংকের নানা স্কিমের ঋণ দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে অনেক ঋণের প্রকৃত উপকারভুগি ব্যাংকের ম্যানেজার বনমালী রায় নিজেই। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্যাংকের ম্যানেজার বনমালী রায় মুঠোফোনে (০১৭১৩-২০৫২০৮)  বার বার যোগাযোগের চেষ্ঠা করে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।জানতে চাইলে ন্যাশনাল ব্যাংক সিলেটের বিভাগের  রিজিওনাল ম্যানেজার মো. সাইফুজামান মুঠোফোনে বলেন, একজন শাখা ব্যস্থাপকের অনেক ক্ষমতা থাকে। তবে এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অন্যের নামে ম্যানেজার নিজেই যদি উপকারভুগি হন, সেটা অডিটের মাধ্যমে বেড়িয়ে আসবে।ন্যাশনাল ব্যাংক (পিএলসি) ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর শেখ আক্তার উদ্দিন আহমদ মুঠোফোনে বলেন, ম্যানেজারের আনীত অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়েছে। শিগগিরই ইনভেস্টিগেশন টিম যাবে সে যেখানে সেখানে ছিল। ইনভেস্টিগেশন গেলে সব তথ্য বেরিয়ে আসবে।তিনি আরো বলেন, আমি যোগদান করেছি ২০২১ সালের মে মাসে। আমার যোগদানের পর দেশের বাহিরে ছিলাম। আমি এখানে আসার পর দুর্নীতিবাজদের শাস্তির মাত্রা বেড়েছে। ন্যাশনাল ব্যাংকের ইতিহাসে সেটা এর আগে ছিল না। আমরা দুর্নীতিবাজদের জন্য জিরো টলারেন্স ঘোষনা করেছি। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না ইনশাআল্লাহ। শাখা ব্যবস্থাপক বনমালী রায়ের বিষয়ে ইতিমধ্যে আমাদের আইসিটিকে বলেছি পরিদর্শন করে স্পেশাল ইনস্পেকশনের জন্য। স্পেশাল ইনস্পেকশন যখন হয় তখন একেবারে ইন এন্ড আউট সমস্ত দেখে তারা মোটামুটি যাচাই-বাচাই করে। তখন কার  অপরাধ  কতটুকু ছিল, কে কোনটা করেছে সেটা বেড়িয়ে আসবে তিনি আরো বলেন, বনমালী যে দুইটি শাখায় ছিলো, এই দুটি শাখাতেই ইনভেস্টিগেশন হবে। ডকুমেন্টারি এভিডেন্স দিয়ে বিচার করবো কার সাথে সখ্যতা ছিল সেটা দেখবো না। আমাদের এখন যে চেয়ারম্যান স্যার উনি খুবই শক্ত। উনি বলেছেন যার বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্যতা প্রমাণ পাওয়া যাবে সাথে সাথে ক্রিমিনাল কেইস ধরা হবে।এতোদিন অর্থদন্ড  দিয়েছি, এখন এগুলোর পাশাপাশি সরাসরি ক্রিমিনাল কেইস করতে হবে এবং সেই ধারা অব্যাহত আছে।
শেয়ার করুন