নবীগঞ্জে বিআরডিবি পজিপ প্রকল্পের মাঠ সংগঠক সৈয়দা জেসমিন সুলতানার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ!

নিজস্ব প্রতিনিধি, নবীগঞ্জ:

হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (বিআরডিবি) পজিপ প্রকল্পের মাঠ সংগঠক সৈয়দা জেসমিন সুলতানার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি অভিযোগ ওঠেছে। একসাথে তিনি দীর্ঘদিন ধরে সমিতির সদস্য, নিজ দপ্তর এবং সরকারের সাথে প্রতারণা করে আসছেন। সদস্যদের মাধ্যমে ঋণ উত্তোলন করে তা দিয়ে নিজে করছেন সুদের ব্যবসা। টানা দুই যুগ একই স্থানে চাকরির সুবাধে দুর্নীতির মাধ্যমে বনেছেন কোটি টাকার মালিক।

এদিকে, এসব বিষয় নিয়ে তার বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদনে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হলেও অদৃশ্য কারণে ৭ বছরেও কোন ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এতে ক্ষোব্ধ সমিতির সদস্যরা।

যেভাবে দুর্নীতি করছেন:

 

জানা যায়, সৈয়দা জেসমিন সুলতানা নবীগঞ্জে বিআরডিবি’তে প্রায় দুই যুগ ধরে পজিপ প্রকল্পের মাঠ সংগঠক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি আওয়ামী লীগ সমর্থিত সিবিএ’র বর্তমান সভাপতি। তার অধিনে অন্তত ৫০টি সমিতি রয়েছে।

সম্প্রতি সালামতপুর সমিতির দলনেতা রাজিয়া বেগম বাদি হয়ে প্রকল্প পরিচালকসহ বিভিন্ন দপ্তরে জেসমিন সুলতানার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

তিনি অভিযোগে উল্লেখ করেন, জেসমিন সুলতানা তার নিজস্ব বাহিনী ব্যবহার করে তাকে ভয়ভীতি ও হয়রানি করেছেন। বিআরডিবি’র সঞ্চয় তহবিলের সমস্ত টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি।

রাজিয়া বেগম বলেন- ‘আমার সমিতির ১৫ জন সদস্যের পাস বই তিনি তার নিজে কাছে রেখে দিয়েছেন দীর্ধদিন ধরে। একদিন তিনি আমাদেরকে বলেন, তার টাকার খুব দরকার। আমরা যদি ঋণ তুলে তাকে দিয়ে দেই তাহলে তার উপকার হবে। তিনি নিজেই আমাদের সব ঋণ পরিশোধ করবেন।’

রাজিয়া বলেন, ‘আমরা তার কথায় বিশ্বাস করে প্রত্যেকে ২৫ হাজার টাকা করে ঋণ তুলে দিয়েছি। এ সময় তিনি আমাদের সবার পাস বই ও কাগজপত্র নিয়ে যান।’

সূত্র বলছে, বিআরডিবি মূলত ৯ শতাংশ সুদে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ দিয়ে থাকে। জেসমিন সুলতানা সদস্যদের টাকা নিয়ে অন্য ব্যক্তির কাছে উচ্চ সুদে ব্যক্তিগত ঋণ দিয়ে থাকেন। এভাবেই তিনি সদস্যদের টাকায় নিজে ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’ হচ্ছেন।

সালামতপুর গ্রামের শাহেনা বেগম বলেন, ‘আমারে জেসমিন সুলতানা কান্নাকাটি করে বলেন তার টাকার খুব প্রয়োজন। আমি যেন তাকে কিস্তি তুলে ২৫ হাজার টাকা দেই। আমি সরল বিশ্বাসে তাকে টাকাটা দিয়েছি। এখন তিনি আমাকে আমার পাস বইও দেন না। সরকার যদি এখন আমার বিরুদ্ধে মামলা করে তাহলে ফেসে যাব।’

আরেক সদস্য নাজমা বেগম বলেন, ‘আমার টাকার দরকার ছিল না। কিন্তু জেসমিন সুলতানা আমাকে দিয়ে টাকা তুলিয়ে তিনি নিয়ে গেছেন। বলেছেন সব কিস্তি তিনি পরিশোধ করবেন। এখন কিস্তির টাকা পরিশোধ করছেন কি-না কিছুই জানি না। আমাদের পাস বইও তিনি দেন না।’

সর্বশান্ত করেছেন অনেককে:

নবীগঞ্জ উপজেলার শিবপাশা গ্রামের রঞ্জিত দাসের স্ত্রী বিথি রানীকে ঋণ দেয়ার কথা বলে একটি বø্যাংক চেকে স্বাক্ষর নেন জেসমিন। পরবর্তীতে কোনো ঋণ না দিয়েই সেই চেকে পাঁচ লক্ষ টাকা বসিয়ে বিথি রানীর স্বামীর নামে মামলা দায়ের করেন।

একই পস্থা অবলম্বন করে আনমনু গ্রামের সনুফা বেগমসহ আরও অনেকের সাথে প্রতারণা করেছেন জেসমিন।
রঞ্জিত দাসের ভাই রজত দাস বলেন, ‘আমার ভাইকে ৫ লাখ টাকার চেক মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে জেসমিন সুলতানা। মিত্যা মামলার কারণে এখন আমার ভাই পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তার একটা ছেলে ও একটা মেয়ে এবং স্ত্রী খুব অসহায় অবস্থায় পড়ে আছে। আমি তাদেরকে দেখা-শোনা করছি।’

তদন্ত কমিটির সুপারিশের পরও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি!

 

দুর্নীতির কারণে সিলেট আঞ্চলিক দপ্তর থেকে ২০০৬ সালে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। তবে, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সমর্থন নিয়ে তিনি পুনরায় স্বপদে বহাল হন। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে আবারও এসব অভিযোগের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট দপ্তর। তদন্ত শেষে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় জেসমিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা (বদলি) নেওয়ার সুপারিশ করে তদন্ত কমিটি। কিন্তু দীর্ঘ ৭ বছরেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এ বিষয়ে জেসমিন সুলতানার কাছে জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত হয়ে যান। বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি দেখানোর চেষ্টা করেন তিনি।

কি বলছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ?

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা বিআরডিবি উপ-পরিচালক হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আমাদের কাছে জেসমিন সুলতানার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ জমা পড়েছে। এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিয়েছি। তবে এই কমিটি নিয়ে বাদির আপত্তি থাকায় আমি ফাইলটি অধিদপ্তরে পাঠিয়ে দিয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালেও এমন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে তদন্ত হয়। পরবর্তীতে তদন্ত কমিটি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ করে দেয়। কিন্তু কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি সেটি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে পারবে। আমি পুরনো প্রতিবেদন এবং নতুন অভিযোগ সবগুলো ফাইল একত্রিত করে অধিদপ্তর পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন অধিদপ্তর যেটা ভালো মনে করে সেটা করবে।’

সূত্র অভিযোগ বলছেন, এত অনিয়ম-দুর্নীতির পরও জেসমিন সুলতানার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এমনকি তদন্ত না করেই তার মাধ্যমে ঋণ বিতরণ অব্যাহত আছে। মূলত উপপরিচালক হুমায়‚ন কবির এবং জেসমিন সুলতানা একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় দুজনের যোগসাজসে এমন অনিয়ম চলছে বলে মনে করেন অনেকে।

সদস্যদের দাবি, জেসমিনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার মাধ্যমে ঋণ দেওয়া যেন বন্ধ রাখা হয়।

শেয়ার করুন