আয়নায় সাঈদ খোকন এবং ‘জেল- জরিমানা’র হুমকি

ঢাকা শহর নিয়ে মেয়রদ্বয়ের অনেক স্বপ্ন।তারা অনেকবার ঢাকাকে সিঙ্গাপুর বানাতে চেয়েছেন।সিঙ্গাপুর তারা দেখেন নি, সিঙ্গাপুর সম্পর্কে ধারণা নেই, তা বলার সুযোগ নেই।আমাদের চেয়ে অনেক বেশিবার তারা সিঙ্গাপুর গেছেন – দেখেছেন। মেয়র আনিসুল হক জনপ্রিয়তা নিয়েই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আছেন মেয়র সাঈদ খোকন। তিনি ‘স্বচ্ছ ঢাকা’ কর্মসূচি নিয়েছেন। এই কর্মসূচি অনুযায়ী কাজ কতটা হবে, সেটা আলোচনার একটা বিষয়। তার চেয়ে বড় বিষয়, তিনি ঢাকা দক্ষিনের নাগরিকদের জেল- জরিমানার হুমকি দিয়েছেন। আজকের লেখার বিষয় এই হুমকি।

০১.
মেয়র সাঈদ খোকন বলেছেন,’ যে সব ভবনে এডিসের প্রজনন ক্ষেত্র কিংবা লার্ভা পাওয়া যাবে, তাকে অর্থদন্ড কিংবা কারাদন্ডে দন্ডিত করা হবে।ডিএসসিসির আইন ২৬৯-৭০ এই জরিমানা করা হবে।’

এই হুমকি দিয়েছেন মূলত ভবন বা বাড়ির মালিকদের। নিশ্চয়ই নগর পরিস্কার- পরিচ্ছন্ন রাখা শুধু সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব নয়। দায়িত্ব রয়েছে নাগরিকদেরও। নাগরিকরা যদি সচেতন না হন, তবে সিটি কর্পোরেশন কোনোভাবেই নগর পরিস্কার – পরিচ্ছন্ন রাখতে পারবেন না। মেয়ররা যে সিঙ্গাপুর বানাতে চান, সেই সিঙ্গাপুর সম্পর্কে নিশ্চয়ই তাদের ধারণা আছে।ধারণা থাকার কথা সিঙ্গাপুরের পরিচ্ছন্নতার কাজ কিভাবে হয়, সে সম্পর্কেও।

রাস্তায় কাগজের টুকরা,চুইংগাম এমন কি থুথু ফেললেও জরিমানা দিতে হয় যে দেশটিতে, সেই দেশটির নাম সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরের মানুষ সচেতন, তার চেয়ে বেশি সচেতন সিঙ্গাপুর সরকার। সিঙ্গাপুর সরকার কাজ করেছে, পরিচ্ছন্ন দেশ তৈরি করেছে। তারপর মানুষকে আইন মানতে উদ্বুদ্ধ করেছে, মানতে বাধ্য করেছে জেল- জরিমানর মাধ্যমে। কাজ না করে, মানুষকে জেল- জরিমানার হুমকি দেওয়া হয়নি।

ঢাকা শহরের এক অংশের মেয়র সাঈদ খোকন কী করেছেন? নগর পরিচ্ছন্ন রাখার জন্যে আপনি কী করেছেন? এখন ‘স্বচ্ছ ঢাকা’ কর্মসূচি নিয়েছেন। টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে কথা বলছেন। ‘এডিস মশা’ যাতে না জমায় তার দায়িত্ব জনগণের উপর ছেড়ে দিচ্ছেন। গত কয়েকমাস যে পরিমাণ মশা এই নগরে জন্মালো, সে বিষয়ে আপনি প্রায় কিছুই করেননি।

কাজের মধ্যে কিছু জায়গায় কামান দিয়ে ওষুধ ছিটিয়েছেন। সেটা আসলেই ওষুধ না ওষুধের মত কিছু, মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ কিনা, সেই ওষুধে ঢাকার মশা মরে কি না, কোনো কিছুই পরীক্ষা করা হয়নি। সেই ওষুধও আবার ছিটাতে শুরু করেছেন, নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরে। ফলে ঢাকা নগর মশার রাজত্বে চলে গেছে। যখন ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তখন আপনি ‘স্বচ্ছ ঢাকা’ কর্মসূচি নিয়েছেন। সঙ্গে হুমকি দিয়েছেন বাড়ির মালিক বা এই নগরের বাসিন্দদের।জেল- জরিমানার হুমকি।

০২.
হুমকি কেন দিয়েছেন? কারণ আপনি জানেন যে, আপনার এই ‘স্বচ্ছ ঢাকা’ কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হবে না। এ ধরনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার জন্যে যে ‘নিয়ত’ থাকতে হয়,তা আপনার সিটি কর্পোরেশনের নেই। আপনার কর্মকর্তাদের সততা তো নেই-ই, আন্তরিকতা এবং দক্ষতারও অভাব আছে। আপনার এই কর্মসূচির আওতায় কয়েক কোটি টাকা খরচ হবে। তারপর বলবেন, মানুষ সচেতন না বলে ‘ঢাকা স্বচ্ছ’ করা গেল না।

কৌশলটা খারাপ না, ব্যর্থতা ঢাকার একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা। মানুষের এই কৌশল বুঝতে একটুও কষ্ট হয় না।

একজন মেয়রের কাজ প্রজেক্ট নির্ভর নয়। কাজ করতে হয় ১২ মাস, ৩৬৫ দিন। ‘স্বচ্ছ ঢাকা’ ৩৬৫ দিনের কর্মসূচি,লোক দেখানো বা হাসানো কয়েকদিনের নয়। মশা যখন রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে, তখন মেরে শেষ করা যায় না। মারতে হয়, বংশ বিস্তারের আগে। এই হিসেবটি আপনার সিটি কর্পোরেশনের নেই।

০৩.
যানজট-জলজট, পরিচ্ছন্ন শহর- মশামুক্ত শহর… সব সমস্যার তিনি সমাধান করে দেবেন- বলেছিলেন নির্বাচনের আগে। মানুষকে সেই নির্বাচনে ভোট দিতে হয়নি। তারপরও তাকে নির্বাচিত মেয়র বলতে হবে। কারণ একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই তিনি মেয়রের দায়িত্ব নিয়েছেন। দায়িত্ব নিয়ে কিছু চেষ্টা হয়ত করেছেন, কিন্তু নগরের কোনো সমস্যাই কার্যকর সমাধান করতে পারেননি। না পারার একক কারণ তিনি নন, আরো অনেক কারণ আছে।

সাঈদ খোকন যে নগরের মেয়র, সেই নগর বসবাসের জন্যে পৃথিবীর নিকৃষ্ট নগরের একটি। তার ক্ষমতার মধ্যে থাকা ছোট কোনো কাজও তিনি নগরবাসীর জন্যে করতে পারেননি। গাড়ি-বাস- ট্রাকের শব্দ দূষণ তিনি হয়ত ইচ্ছে করলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না।

ঢাকা শহরের কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে বিয়ে- গায়ে হলুদের নামে সারা রাত যে শব্দ যন্ত্রণা হয়, তাও তিনি বন্ধের উদ্যোগ নেননি। অথচ কাজটি তিনি ইচ্ছে করলেই করতে পারেন। নগরবাসীর জন্যে স্বস্তিদায়ক হয়, এমন কোনো কিছুর দিকে তার নজর আছে বলে মনে হয় না।

আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, তিনি মেয়র হিসেবে নগরবাসীকে জেল-জরিমানার হুমকি দিতে পারেন কি না?

নিজে কাজ করে দৃষ্টান্ত তৈরি করে, মানুষকে আইন মানার বিষয়ে সচেতন করতে পারেন। তার এক পর্যায়ে গিয়ে আইন মানতে বাধ্য করতে পারেন। নিজে কিছু না করে কোনোভাবেই তিনি নগরবাসীকে হুমকি দিতে পারেন না। সেই অধিকার জনগণ তাকে দেয়নি।

০৪.
মেয়র সাঈদ খোকনের বিবেচনায় নেওয়া দরকার যে, তিনি যে প্রক্রিয়ায় হুমকি দিচ্ছেন তা অনেকটা জমিদার পুত্রের কথার মতো শোনাচ্ছে। যে আইনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি নগরবাসীকে হুমকি দিচ্ছেন, মশা মারতে না পারার কারণে, যানজট-জলজট দূর করতে না পারার কারণে, তিনি নিজেও অভিযুক্ত হতে পারেন।

মেয়র সাঈদ খোকন মেয়র মোহাম্মদ হানিফের সন্তান। সম্মানিত শ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদ ছিলেন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ । কঠিন বিপদের দিনে বঙ্গবন্ধু পরিবারের পাশে ছিলেন হানিফের পরিবার।

বঙ্গবন্ধুর প্রিয়পাত্র ছিলেন হানিফ। একথাও স্মরণে রাখতে হবে,১৯৮৬ সালে আওয়ামী লীগের দুর্দিনে শেখ হাসিনাকে ছেড়ে এরশাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন হানিফ। আবার ফিরে এসেছিলেন। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সময় মানব প্রাচীর তৈরি করে শেখ হাসিনাকে যারা রক্ষা করেছিলেন, তাদের মধ্যে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ অন্যতম।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন তার। আর সাঈদ খোকনের? তিনি মেয়র হানিফের সন্তান। এখনও পর্যন্ত এটাই তার বড় পরিচয়। ওয়ান ইলেভেনের সময়ে সাঈদ খোকনের অবস্থান তো গোপণ কোনো বিষয় নয়।

কিংস পার্টির সঙ্গে ভিড়েছিলেন। তার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম কঠিন পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হতে পারেননি। মেয়র মোহাম্মদ হানিফের সন্তান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেয়র বানিয়েছেন সাঈদ খোকনকে। নিজস্ব কোনো যোগ্যতায় তিনি মেয়র নির্বাচিত হননি।

সুতরাং নগরবাসীকে হুমকি দেওয়ার আগে, নিজের সম্পর্কে, নিজের কাজ সম্পর্কে- আরো একটু পরিষ্কার ধারণা রাখা দরকার। কারও বাড়িতে অবশ্যই এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র থাকা প্রত্যাশিত নয়।

মানুষকে সে বিষয়ে সচেতন করা যেতেই পারে, জেল- জরিমানার হুমকি নয়। মানুষের বাড়ির আঙ্গিণা ছাড়াও, নালা-ডোবায় মশার অবাধ প্রজনন চলছে। যা দেখার দায়িত্ব মেয়র হিসেবে সাঈদ খোকনের। তিনি তা দেখেননি। তাহলে এই দায়ে তো তারও জেল- জরিমানা হওয়ার কথা।

গোলাম মোর্তোজা: সম্পাদক, সাপ্তাহিক।

শেয়ার করুন