মৌলভীবাজার ৪,চা শ্রমিকদের ভোটে নির্বাচিন হন প্রার্থী

 

মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:
মৌলভীবাজার -৪,আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা মাঠে সক্রিয়। তারা নিয়মিত চালিয়ে যাচ্ছেন প্রচার-প্রচারণা। অন্যদিকে এ আসনে বিএনপি প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় রয়েছেন হাজী মুজিবুর রহমান চৌধুরী। তাই এককভাবে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন প্রত্যাশী বর্তমান সাংসদ,সাবেক চীফ হুইপ ও সংসদীয়প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি উপাধ্যক্ষ ড.আব্দুস শহীদ । তার নির্বাচনী এলাকায় তিনি জনপ্রিয়তায় শীর্ষে রয়েছেন।
চা বাগান ও বনাঞ্চল বেষ্টিত শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত মৌলভীবাজার -৪ আসন। কমলগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে দেশের জাতীয় উদ্যান লাউয়াছড়া। রয়েছে চা বাগান। আগামী নির্বাচন নিয়ে শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জের গ্রামেগঞ্জের হাট-বাজারে, চায়ের দোকানে আলোচনা চলছে। তবে উত্তাপ আছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে।

এ আসনে বিএনপি’র সম্ভাব্য প্রার্থী নিয়ে তেমন উত্তাপ না ছড়ালেও আওয়ামী লীগের নৌকা’র মাঝি কে হবেন এ নিয়ে দলের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা ও উত্তেজনা এখন তুঙ্গে। দলীয় কর্মী ও সমর্থকদের মাঝে এ নিয়ে আছে ব্যাপক কৌতূহল। এ আসনে টানা পাঁচবারের সংসদ সদস্য উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ। তিনি এবারও দলীয় মনোনয়ন চাইবেন। তাছাড়া, দলের মনোনয়ন দৌড়ে আছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. রফিকুর রহমান, মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ মনসুরুল হক।
এদের মধ্যে উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ এমপি নির্বাচনী এলাকায় বহুমাত্রিক বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে ভোটারদের কাছে নিজের সুসংহত অবস্থান ধরে রাখতে চাইছেন। প্রতি সপ্তাহেই তিনি এলাকায় এসে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ ও গণসংযোগ করে নির্বাচনী মাঠ সরগরম রাখছেন। রাজনৈতিক কর্মসূচির পাশাপাশি এলাকায় বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে হাজির হচ্ছেন।
অন্যদিকে পুলিশি বাধার ফলে বিএনপির কোনো প্রার্থী মাঠে নেই। সম্প্রতি জাতীয় সংসদের সরকারি প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে আব্দুস শহীদের পালে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে।
নির্বাচনের আগেভাগে আব্দুস শহীদকে আবারো সংসদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়ায় তিনিই দলের মনোনয়ন পাবেন বলে সকলেই মনে করছেন’। নির্বাচনের আগমুহূর্তে সংসদ নেতার পক্ষে এই গুরুদায়িত্ব প্রদানকে অনেকটা ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন নির্বাচনী এলাকার মানুষজন।
অন্যদিকে দলের অপর একটি অংশ আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক দ্বারিকা পাল মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ মনসুরুল হককে সামনে এনে তার পক্ষে দলীয় মনোনয়ন লাভের চেষ্টা চালাচ্ছেন। জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি সদ্য ঘোষণার পর তিনিও শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে উপস্থিত হচ্ছেন। ইতিমধ্যে তার নেতৃত্বে দলে একটি আলাদা বলয় তৈরিও হয়েছে। নিজেদের অবস্থান সুসংহত করতে তার অনুসারীরা নেতাকর্মীদের সঙ্গে জোর লবিংও চালাচ্ছেন। এমনকি সৈয়দ মনসুর জেলা কমিটির পদ পাওয়ার পর তিনি জমি দখলে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগও রয়েছে।
আওয়ামী লীগের অপর মনোনয়ন প্রত্যাশী অধ্যাপক রফিকুর রহমান। তিনি ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার অনুসারী।
কমলগঞ্জের রাস্তার দু’পাশে অধ্যাপক রফিক নিজের ছবির সঙ্গে সাবেক চিফ জাস্টিজের বড় বড় ছবি লাগিয়ে ফেস্টুন ও ব্যানার টাঙান। লাগানো এসব ফেস্টুন এখনো এলাকায় শোভা পাচ্ছে।
দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের অভিযোগ, প্রতিটি নির্বাচনের আগেই দলের একটি অংশ নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠে। তবে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এসব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে প্রতিটি নির্বাচনেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বিজয়ী করেছেন।
এদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে পক্ষে এবারো দলীয় মনোনয়য়ন চাইবেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আলহাজ মো. মুজিবুর রহমান চৌধুরী (হাজী মুজিব)। তিনি ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র প্রার্থী ছিলেন। ওই নির্বাচনে হাজী মুজিব ৭৯ হাজার ৫৯৯ ভোট পেয়ে নৌকার প্রার্থী উপাধ্যক্ষ আব্দুস শহীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন।
তবে শ্রীমঙ্গল পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি নুরুল আলম সিদ্দিকী বলেন, বিএনপিসহ ২০দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হচ্ছে। এই আসনে হাজী মুজিবের বিকল্প কোনো নেতৃত্ব এখনো গড়ে উঠেনি। এটাই দলের নেতাকর্মীরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। হাজী মুজিবই দলীয় মনোনয়ন পাবেন এটা প্রায় সুনিশ্চিত। বর্তমানে তিনি পুলিশি বাধা, হয়রানিমূলক অনেক মিথ্যা মামলা মোকদ্দমার কারণে নির্বাচনী এলাকায় নির্বিঘেœ অংশ নিতে পারছেন না। তাছাড়া এ আসনে এবার জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন চাইবেন শ্রীমঙ্গল উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মো.আসলাম।

এই আসনটি স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকেই আওয়ামী লীগের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এ আসনের জয়-পরাজয় নির্ভর করে মূলত চা শ্রমিকদের ভোটেই।
চা-শ্রমিকদের মাঝে জনশ্রুতি আছে দেশ স্বাধীনের পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখানকার চা-শ্রমিকদের ভোটাধিকার দিয়েছিলেন। সে থেকেই চা-শ্রমিকরা বঙ্গবন্ধুর এই প্রতিদান হিসেবে নৌকায় ভোট দেন। চা-শ্রমিকদের একচেটিয়া ভোটের প্রভাবে এ আসনটিতে সব সময় নৌকারই বিজয় হয়। মূলত এই আসনে আওয়ামী লীগের টিকিটে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হওয়া মানেই বিজয় নিশ্চিত।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে ফলাফলের ধারাবাহিকতা এটাই প্রমাণ করে। এই আসনে চা-শ্রমিক ও নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর ভোটাররা প্রার্থী দেখে নয়, বরং প্রতীক দেখেই ভোট দেন। বর্তমানে এ আসন থেকে টানা পাঁচবারের এমপি উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ এমপি।

২০০১ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ দুই উপজেলায় দলের ভেতরে প্রভাবশালী একটি বৃহৎ অংশের প্রকাশ্যে বিরোধিতায় পড়েন। কিন্তু শত বাধা- বিপত্তির পরও চ্যালেঞ্জের মুখে ৯৬ হাজার ৩২৯ ভোট পেয়ে বিজয় ছিনিয়ে নেন। পরবর্তীতে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা তাকে পুরস্কার হিসেবে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ নিযুক্ত করেন। ওই নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীকে পরাজিত করতে আওয়ামী লীগের প্রাক্তন এমপি মরহুম মো. ইলিয়াস-এর ভ্রাতষ্পুত্র বর্তমান বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আলহাজ মুজিবুর রহমান চৌধুরী (হাজী মুজিব) আওয়ামী লীগের টিকিট বঞ্চিত হয়ে দলের স্বতন্ত্র বিদ্রোহী প্রার্থী হন।

নির্বাচনে ঘড়ি প্রতীক নিয়ে হাজী মুজিব পান ৭০ হাজার ৩৬৪ ভোট। আর বিএনপি’র প্রার্থী বর্তমান শ্রীমঙ্গল পৌরসভার মেয়র মহসীন মিয়া মধু ধানের শীষ প্রতীকে পান ৩৪ হাজার ৭২৬ ভোট।
আলহাজ মুজিবুর রহমান চৌধুরী হাজী মুজিব জোট সরকারের ক্ষমতার শেষের দিকে প্রয়াত অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের হাত ধরে বিএনপিতে যোগ দেন। এরপর তিনি ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র প্রার্থী হয়ে অংশ নেন। ওই নির্বাচনে হাজী মুজিব ৭৯ হাজার ৫৯৯ ভোট পান। সে নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মো. আব্দুস শহীদ ১ লাখ ৩৪ হাজার ৭৪০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন।

সর্বশেষ ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে না আসায় উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। তিনি ক্ষমতাসীন দলের এমপি হলেও সর্বমহলে মিলেমিশে এলাকার উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছেন। শ্রীমঙ্গল শহর সিলেট বিভাগের অন্যতম পাইকারি বাণিজ্যিক শহর। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা এই শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন নির্বিঘেœ। এখানে নেই কোনো চাঁদাবাজদের উৎপাত।

দলে একাধিক প্রার্থী প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কমলগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ও যুবলীগ সভাপতি মো. জুয়েল আহমদ বলেন, আওয়ামী লীগ একটি বড় গণতান্ত্রিক দল। দলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকতে পারে। যে কেউ দলের কাছে মনোনয়ন চাইতে পারেন। কিন্তু এলাকার শান্তি এবং উন্নয়নের ধারা বজায় রাখতে বর্তমান এমপি উপাধ্যক্ষ মো. আব্দুস শহীদের বিকল্প নেই।

নিজেদের প্রার্থিতা সম্পর্কে কমলগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রফিকুর রহমান বলেন, ‘আমি দলের কাছে মনোনয়ন চাইবো।’ তিনি আওয়ামী লীগের দুর্দিনে শক্ত হাতে দলের হাল ধরেছেন এই বিবেচনায় দল এবার তাকে মনোনয়ন দেবে।

উপাধ্যক্ষ ড. মো. আব্দুস শহীদ বলেন, ‘আমি এলাকায় দীর্ঘ ২৫/২৬ বছর ধরে জনগণের সেবা করে আসছি। প্রতিবারেই জনগণের আস্থা নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দান করে আমাকে এবং এলাকাবাসীকে কৃতার্থ করে রেখেছেন। বিশেষ করে চা-বাগানের আমার প্রিয় ভাইবোনেরা তারাও কিন্তু আমাকে সমর্থন ও ভোট দিতে কার্পণ্যবোধ করে না। এর পরেও অনেক কালো টাকার মালিক এই এলাকায় এসে আমাদের ভোটারদের বিভ্রান্ত করে। জাতির পিতার আদর্শের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আগামী নির্বাচনেও প্রধানমন্ত্রী, জাতির পিতার কন্যা আমাকে মনোনয়ন দেবেন সে প্রত্যাশা আমার রয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমি ইতিমধ্যেই জনগণের চাহিদা পূরণে নির্বাচনী এলাকার ৯০ শতাংশ কাজ পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি’।
আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের আরেক বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপি’র মনোনয়ন প্রত্যাশীরা ব্যানার ও ফেস্টুনের মধ্যে নিজেদের প্রচারণা সীমাবদ্ধ রেখেছেন।
দলীয় সূত্রে জানা যায়, এ আসন থেকে এবারো দলীয় মনোনয়ন চাইবেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আলহাজ মো. মুজিবুর রহমান চৌধুরী (হাজী মুজিব)।


বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য আলহাজ মো. মুজিবুর রহমান চৌধুরী (হাজী মুজিব) বলেন,দল থেকে আমি মনোনয়ন পাবো। মামলা হামলার কারণে আমি মাঠে কাজ করতে পারছি না।’

ছবি: সাংবাদিক মামুন আহমদ।

শেয়ার করুন