সাইফুল ইসলাম
বাংলাদেশের প্রান্তিক ও বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুরক্ষায় দুই দিনব্যাপী সম্মেলন ও সাংস্কৃতিক উৎসব শেষ হয়েছে।
সম্মেলন থেকে চা শিল্পের বিকাশ ও চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে মালিক-শ্রমিকদের নিয়মিত সংলাপ এবং শ্রীমঙ্গলে দ্রুত শ্রম আদালত স্থাপনের দাবি জানানো হয়।
শুক্রবার (২৩ নভেম্বর) শ্রীমঙ্গলের ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারে সমাপনী বক্তব্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসির নির্বাহী পরিচালক ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘চা শ্রমিকদের জন্য মালিকপক্ষ অনেক কিছুই করছেন বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো সামনে দৃশ্যমান নয়।
শ্রমিকদেরও অনেক দাবি রয়েছে যা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হওয়া প্রয়োজন। এজন্য তিন মাস পর পর না হলেও অন্তত ছয় মাসে এক বার হলেও মালিকদের সাথে শ্রমিকদের সরাসরি বৈঠক হওয়া দরকার। তাহলে সমস্যা সহজেই সমাধান করা সম্ভব হবে।’
তিনি বলেন, ‘চা জনগোষ্ঠীসহ আমাদের দেশে পিছিয়ে পড়া আরো বেশ কয়েকটি জনগোষ্ঠী আছেন যাদের বাদ দিয়ে বা পেছনে রেখে আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারবো না। তাই সামগ্রিক উন্নয়নের পাশাপাশি এসব জনগোষ্ঠী নিয়েও আমাদের ভাবতে হবে।’
এর আগেরদিন বৃহস্পতিবার দুই দিনের এই সম্মেলন ও সাংস্কৃতিক উৎসবের উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। সম্মেলনে প্রায় ৬০টি জাতিগোষ্ঠীর প্রায় চার শত মানুষ অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনে আটটি সেশনে দেশের প্রান্তিক ও বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনমান, সামাজিক সংকটসহ তাদের ভাষা, সংস্কৃতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।
সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (সেড), পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি), খ্রিস্টিয়ান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ (সিসিডিবি) এবং গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র (জিবিকে)Ñযৌথভাবে এই সম্মেলন ও সাংস্কৃতিক উৎসবের আয়োজন করে।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের শুরুতে ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে চা বাগানে মালিক-শ্রমিক একতা’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের সভাপতিত্বে এসময় বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ড. কাজী মুজ্জাফর আহমেদ বলেন, ‘এই অঞ্চলে চা শিল্পের বিকাশকাল হিসেবে ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সময়কে ভাগ করা যায়। এর মধ্যে বাংলাদেশ সময়ে প্রায় ২০০ শতাংশ উৎপাদন বেড়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ এক হাজার ৮১৩ কোটি টাকার চা রপ্তানি করেছে। বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়নের জন্য চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যমে মূল ধারায় নিয়ে আসতে হবে। এজন্য আমরা কাজ করছি। তাদের মূল মজুরী ১০২ টাকা হলেও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে তা দাঁড়ায় প্রতিদিন ৩৫২ টাকায়। আর যারা কারখানায় কাজ করেন তাদের মজুরী হয় ৩২০ টাকা।’
তবে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বলেন, ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা মানে উন্নয়নকে স্থায়ী করা। এজন্য মালিকপক্ষের ইতিবাচক ভূমিকা দরকার। আমাদের শ্রমিকদের মগজে ঢুকে যাওয়া ‘মালিক আমাদের ঠকায়’ এই চিন্তা বদলাতে হবে। এই ধারণা বা বিশ্বাস ভাঙতে মালিকপক্ষকে কাজ করতে হবে। কিন্তু তারা আমাদেও সাথে বসতে চান না।’
বিদ্যমান আইনের সমালোচনা করে রামভজন কৈরী বলেন, ‘ম্যানেজারের জুতা খুলে ও পরিয়ে দেওয়ার জন্য একটি পদ এখনও আছে। এর মধ্যেমে প্রভু আর ভিত্বের সম্পর্ক স্থাপন করা হচ্ছে। এখনই এই পদ বাতিল করতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘আইনের অনেক সমালোচনা আছে, কিন্তু এর মধ্যে যে ভালো দিক আছে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে পারলে আমরা অনেক এগিয়ে যাবো।’
রাজঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বিজয় বুনার্জী বলেন, ‘চা শ্রমিকরা নিজ দেশে পরবাসী। তাদের কেনো ভূমির অধিকার নেই। চা বাগানে নির্দিষ্ট কিছু মানুষের কাজ হয়। বাকিরা বেকার। অধিকাংশ শিক্ষিত ছেলেরা চাকরি পাচ্ছে না। জীবনমান অত্যন্ত তলানিতে। শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বাসস্থানসহ সব মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত।’
এছাড়া, সম্মেলনের শেষ দিনে ‘আন্তর্জাতিক সনদ এবং জাতীয় আইন’, ‘বেদে, যৌনকর্মী, ঋষি এবং নির্দিষ্ট কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর (মুন্ডা, শব্দকর, পাত্র ইত্যাদি) ইস্যুসমূহ’, ‘চা জনগোষ্ঠী, বেদে এবং হরিজন সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্য, পানি ও স্যানিটেশন অধিকারসমূহ’, ‘প্রান্তিক ও বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীসমূহের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সুরক্ষায় কর্মকৌশল নির্ধারণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধি’ শীর্ষক পাঁচটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
এসব সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তানজিমুদ্দিন খান, আইন বিভাগের লেকচারার সারোয়াত শামিন, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়–য়া, সেড-এর পরিচালক ফিলিপ গাইন, সিসিডিবি-এর হেড অব স্পেশাল প্রোগ্রামস অ্যান্ড এইচআরএমডি সিলভেস্টার হালদার, জিবিকে-এর প্রধান নির্বাহী মোয়াজ্জেম হোসেন, পরিত্রাণের নির্বাহী পরিচালক মিলন দাস, বেদে সর্দার সৌদ খান, সেক্স ওয়াকার্স নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক আলেয়া আক্তার লিলি প্রমুখ।
সম্মেলনের শেষ দিনেও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন রয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় শ্রীমঙ্গল পৌরসভার মহসিন অডিটরিয়ামে মণিপুরী, সাঁওতাল, তেলেগু, ত্রিপুরা, গারো এবং তুরি সাংস্কৃতিক দল তাদের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক পরিবেশন করা হয়।