এএসএম সা’-আদাত উল করীমঃ
জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ী উপজেলার পৌরসভার মেয়র রুকুনুজ্জামান রুকন সরকারের অর্থে ব্যক্তিগত পুকুরে পার্ক নির্মাণ করেছেন। পৌর মেয়র রুকুনুজ্জামান রুকনের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, নিয়োগ বাণিজ্য, টেন্ডারবাজী অর্থ আত্মসাতসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। তিনি এককভাবে স্বেচ্ছাচারী ও কুক্ষিগত করে রেখেছেন পৌর পরিষদকে। শহরের অধিকাংশ রাস্তাঘাট খানাখন্দ থাকলেও সেগুলোর উন্নয়ন না করে শোভাবর্ধনের নামে বিভিন্ন স্থানে পার্ক, ডিজিটাল ঘর ও বসার স্থান নির্মাণ করেছেন। নীতিমালা লঙ্ঘন করে অধিকাংশ প্রকল্প টেন্ডার ছাড়াই কোটেশনের মাধ্যমে কাজ দেখিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। এদিকে একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুরে সরকারি অর্থ নষ্ট করে মেয়র মিনিপার্ক নির্মাণ করায় জনমনে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।
সরেজমিন পরিদর্শন ও এলাকাবাসীর অভিযোগে জানা যায়, পৌরসভার সাতপোয়া গ্রামের মৃত আব্দুল লতিফ সরকারের ছেলে আনিছুর রহমান বাদলের ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ও মেয়রের বাড়ির নিকটবর্তী একটি পুকুরকে সরকারি টাকা নষ্ট করে মিনিপার্ক বানিয়েছেন মেয়র রুকুনুজ্জামান। অথচ পুকুরের সামনেই এলাকাবাসীর চলাচলের একমাত্র রাস্তাটি খানাখন্দ। ব্যক্তিগত পুকুরে করা ‘সাতপোয়া উত্তরা মেয়র রুকন মিনি পার্ক’ নামের ওই প্রকল্পে নির্মাণ ব্যয় ধরা করা হয় আট লাখ ৭৫ হাজার টাকা। পুকুরের চার কোনায় টাইলস করা ৪টি আধুনিক ছাতাসদৃশ্য ডিজিটাল বিশ্রামাগার, চারপাশে ১০টি বসারস্থান, একটি পুকুরঘাট, পুকুরের মাঝখানে কৃত্রিম শাপলা ফুল ও পানির ফোয়ারা নির্মাণ করা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) এ প্রকল্প দরপত্র ছাড়াই শুধুমাত্র কোটেশন নোটিশের মাধ্যমে কার্যাদেশ দেওয়া হয় মেসার্স নাইম এন্টারপ্রাইজকে। ঠিকাদারের কাছ থেকে অগ্রিম চেক জমা নিয়ে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে বাকি টাকা আত্মসাত করেন মেয়র।
মেসার্স নাইম এন্টারপ্রাইজের সত্ত্বাধিকারী গোলাম রাশেদ সংবাদ মাধ্যমকে জানান, কাজ শুরুর আগেই মেয়রকে পুরো বিলের চেক দিতে হয়েছে। সব টাকা মেয়র নিজেই উত্তোলন করে তাকে মাত্র পাঁচ লাখ টাকা দেন। তাও সে টাকা আদায় করতে মেয়রের পেছনে ঘুরতে হয়েছে অনেক দিন। এদিকে কোটেশন অনুযায়ী মিনিপার্কে আরো কাজ বাকি থাকলেও তা করতে দেওয়া হয়নি।
এদিকে মেয়র মিনিপার্কটি নির্মাণ করতে পুকুর লিজ নেওয়ার কথা বললেও পুকুরের মালিক আনিছুর রহমান বাদল তা অস্বীকার করে বলেন, পুকুর আমার, পৌরসভাকে লিজ দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। মেয়র একদিন আমাকে হঠাৎ ডেকে বললেন যে, আপনার পুকুরে পার্ক বানানো। পুকুরের শোভা বাড়বে, তাই আমি আর পার্ক নির্মাণ করতে মানা করিনি।
অপরদিকে বাউসি পপুলার মোড়ে ব্রীজের দু’পাশে এবং সড়ক ও জনপথের সড়কে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ‘মেয়র পার্ক’ নামে একটি পার্ক তৈরি করেছেন মেয়র রুকন। এখানে সরকারি অর্থ নষ্ট করা হয়েছে ৩৭ লাখ টাকা। এ পার্কের কার্যাদেশ টেন্ডার ছাড়াই দীপক কুমার সাহার ‘মেসার্স সাহা ব্রাদার্স’-এর নামে কোটেশনের মাধ্যমে কাগজ-কলমে দেখানো হলেও মেয়র রুকন নিজেই করেন। এ প্রকল্পে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। অনুমতি ছাড়া এখানে পাক নির্মাণ করায় গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর ৮৭ নম্বর স্মারকে সড়ক ও জনপথের (সওজ) উপবিভাগ-১, জামালপুর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী পার্কের নির্মাণ কাজ বন্ধের জন্য মেয়রকে পত্র দেন। নির্দেশ অমান্য করে মেয়র পার্কের কাজ চলমান রাখেন এবং পুরো কাজ শেষ করার আগেই বরাদ্দের সিংহভাগ টাকা উত্তোলন করে নেন মেয়র।
এদিকে কোটেশন দিয়ে বলারদিয়ার গ্রামে নতুন আরো একটি পার্কের কাজ শুরু করা হয়েছে। সামনের রাস্তাটি ধীর্ঘদিন ধরে চলাচলের অযোগ্য পড়ে থাকলেও সেদিকে নজর নেই মেয়রের। মেসার্স শাকিল এন্টারপ্রাইজকে বলারদিয়ার পার্কটির কার্যাদেশ দেওয়া হলেও মেয়র রুকন ও কাউন্সিলর নুরুল ইসলাম শেখ কাজ করছেন। মেয়র ও কাউন্সিলর যোগসাজশে এ প্রকল্পের বরাদ্দকৃত প্রায় ১০ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পায়তারা করছেন।
পৌরসভা সূত্র জানায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এডিপি’র ৭১ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। এছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পের নামে চার বছরে প্রায় দুই’শ কোটি বরাদ্দ আসে। বরাদ্দকৃত অর্থ মেয়র ব্যক্তিগত লাভের জন্য কিছু টেন্ডার প্রক্রিয়া অনুসরণ করলেও অধিকাংশই কোটেশন নোটিশের মাধ্যমে নামেমাত্র ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের অনূকুলে কার্যাদেশ দেন এবং অধিকাংশই বাস্তবায়ন করেন মেয়র নিজে। ২০১৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর রুকুনুজ্জামান রুকন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আগের কাজের ঠিকাদারদের বিল পরিশোধ না করে পিপিআর ২০০৬ ও ২০০৮ সংশোধিত নীতিমালা উপেক্ষা করে কোটেশনের মাধ্যমে এডিপি’র বরাদ্দের কাজ কাগজে-কলমে দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। পৌরসভার বিভিন্ন স্থানে মিনিপার্ক, মোড়ে মোড়ে অপ্রয়োজনীয় ১৪টি ডিজিটাল ঘর ও অর্ধশতাধিক বসার স্থান নির্মাণ করা হলেও সেগুলোর পার্শ্ববর্তী রাস্তাগুলোই চলাচলের অযোগ্য।
সরিষাবাড়ী পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল মালেক বলেন, উন্নয়ন কাজের সিদ্ধান্ত নেয় পৌর পরিষদ। নিয়মের বাইরে কোনো সিদ্ধান্ত হলে আমার শুধুমাত্র মতামত দেওয়া ছাড়া কিছুই করার থাকে না। পৌরসভার অর্থায়নে ব্যক্তিগত স্থানে পার্ক নির্মাণের বিধান না থাকলেও তা মেয়রের এখতিয়ার। পৌরসভার সচিব আবু সাঈদ বলেন, পৌরসভার উন্নয়ন কাজে যে সকল বরাদ্ধ আসে কমিটির মাধ্যমে মেয়র সব প্রজেক্ট সিলেকশন করেন। বরাদ্ধকৃত অর্থের চেক সচিব হিসেবে আমার কাজ স্বাক্ষর করা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মেয়র রুকুনুজামান রুকন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, পৌরবাসীর বিনোদনের জন্য বাউসি পপুলার মোড়ে ‘মেয়র পার্ক’ নির্মাণ করেছি। এটি একটি বিশাল অঙ্কের কাজ। বিভিন্ন স্থানে বিনোদনের জন্য ডিজিটাল ঘর ও ছাতাসদৃশ্য বসার স্থান করেছি।
ব্যক্তিগত পুকুরে ‘সাতপোয়া উত্তরা মেয়র রুকন মিনিপার্ক’ নির্মাণ নীতিমালা অনুযায়ী ঠিক হয়েছে কি-না জানতে চাইলে তিনি ক্ষুদ্ধ হয়ে বলেন, পুকুরটি মালিক পৌরসভাকে আজীবনের জন্য লিজ দিয়েছে। পুকুরের মাছ ও গাছ কার সম্পত্তি এ প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।