যেভাবে গণজমায়েত ছাড়াই সম্ভব হলো শায়খুল হাদিস ঢেউপাশীর জানাযা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক : করোনায় অবরুদ্ধকালীন সময়ে সামনে যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক জানাযায় বিশাল গণজমায়েতের উদাহরণ। ঘটনার এক মাসও পার হয়নি। মঙ্গলবার (২৮ এপ্রিল) রাতে মারা যান মৌলভীবাজার তথা বৃহত্তর সিলেটের শীর্ষ আলেমে-দ্বীন শায়খুল হাদিস আল্লামা আব্দুল মুমিত ঢেউপাশী।
    এই হাদিসে হাফিজের ছাত্রই আছেন ৫০ হাজারের ওপরে। আছেন ভক্ত ও শুভাকাংখিও। চিন্তায় পড়ে যান জেলা পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
    কিন্তু হাজারো মানুষের জমায়েত ছাড়াই মৌলভীবাজারে অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢেউপাশীর নামাজে-জানাযা।
    কিভাবে এড়ানো সম্ভব হলো সম্ভাব্য জনসমাগম?
    মৌলভীবাজারের বরুণা মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস আল্লামা আব্দুল মুমিত ঢেউপাশী (৭২) মঙ্গলবার (২৮ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টায় সিলেট মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত কারণে শারীরিক নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়।
    তার মৃত্যুর পরই মৌলভীবাজারসহ পুরো সিলেট বিভাগে শোকের ছায়া নেমে আসে।
    বুধবার (২৯ এপ্রিল) বাদ ফজর সদর উপজেলার ঢেউপাশা গ্রামে নামাজে-জানাযা শেষে সেখানেই পারিবারিক কবরস্থানে আল্লামা আব্দুল মুমিত ঢেউপাশীকে দাফন করা হয়। জানাযায় আত্মীয়-স্বজনসহ অল্প-সংখ্যক ঘনিষ্ঠজন উপস্থিত হন।
    স্থানীয় আলেমরা জানান, ‘শায়খুল হাদিস আল্লামা আব্দুল মুমিত ঢেউপাশীর ছাত্রই আছেন ৫০ হাজারের ওপরে। এক্ষেত্রে নামাজে-জানাযায় অর্ধলক্ষাধিক মানুষের সমাগম হওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিলো।
  • ঢেউপাশীর দাফন-কাপন সমন্বয় করছেন জেলা প্রশাসন, পুলিশ, র‌্যাব, নেতৃস্থানীয় আলেম এবং জনপ্রতিনিধিরা।
    কিন্তু পুলিশ, প্রশাসন, র‌্যাব, জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় আলেমদের প্রচেষ্টায় এড়ানো গেছে বড় ধরনের গণজমায়েত- বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন মরহুম ঢেউপাশী হুজুরের পরিবারের লোকজনও।
    জেলা প্রশাসন ও পুলিশের তৎপরতা
    ঢেউপাশীর মত্যুর খবর পাওয়ার সাথে সাথে তৎপর হন মৌলভীবাজার সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিয়াউর রহমান।
    তিনি বলেন, ‘যেহেতু তিনি (ঢেউপাশী) একজন প্রখ্যাত আলেমে-দ্বীন। তার অনেক ছাত্র, ভক্ত ও শুভাকাংখি আছেন। জানাযায় ব্যাপক সমাগম হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। দেশে সাম্প্রতিক ‍দু’একটি ঘটনাও আমাদের মাথায় ছিলো।
    ঘটনার গভীরতা বিবেচনা করে তৎক্ষণাৎ পুলিশ মরহুমের বাড়িতে উপস্থিত হয় এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারকে শান্তনা দেয়। সেই সাথে দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে তাদের অবগত করা হয়। পরে নেতৃস্থানীয় আলেমগণ, মরহুমের পরিবার, জেলা পুলিশ, প্রশাসন, র‍্যাব সবাই সমন্বিত আলোচনার মাধ্যমে, সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি মেনে, যথাযথ এবং পূর্ণ ধর্মীয় মর্যাদায় জানাযার নামাজ আদায় করা হয়। পরে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। জেলা পুলিশ, জেলা প্রশাসন এবং র‍্যাব-এর সমন্বিত প্রচেষ্টায় আমরা সেই জনমাসগম এড়াতে পেরেছি। নেতৃস্থানীয় আলেমগণও সহযোগিতা করেছেন।’
    তিনি বলেন- ‘জনসমাগম যাতে না হয়, সেজন্য পুলিশ রাতে শ্রীমঙ্গল, শেরপুর, চাঁদনীঘাট, কুসুমবাগ, চৌমোহনাসহ প্রবেশের চারিদিকে চেকপোস্ট বসিয়েছে। এছাড়া জনগণকে বুঝিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে। র‌্যাব সহযোগিতা করেছে।
  • কবর খনন করা, বাঁশ কাটা, গরম পানি করে লাশ ধোয়ানো ইত্যাদি কাজে সহযোগিতা করেন পুলিশ সদস্যরা। পুলিশ সুপার স্যার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সার্বক্ষণিক খবর রেখেছেন, স্যারের নির্দেশনা মোতাবেক আমরা কাজ করেছি ।
    দাফন হয় ভোর হওয়ার আগেই
    ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন- সদর উপজেলা নির্বাহি অফিসার মো. শরীফুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ারুল হক, সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিয়াউর রহমান, জেলা প্রশসানের নির্বাহি ম্যাজিস্ট্র্যাট সৈয়দ আমজাদ হোসেন, সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন। ছিলেন- র‌্যাব-৯, শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পের অধিনায়ক আনোয়ারে হোসেন শামীম।
    এছাড়াও মাওলানা রশীদুর রহমান ফারুক পীরসাহেব বরুণা, খেলাফত মজলিশের নেতা মাওলানা আহমদ বেলালসহ নেতৃস্থানীয় আলেমসহ স্বল্পসংখ্যক জনপ্রতিনিধি এবং আত্মী-স্বজন সেখানে উপস্থিত হন।
    পুলিশ ও প্রশাসনের পচেষ্টায় পরিবারের লোকজনকে বুঝিয়ে জানাযা হয় বাদ ফজর, ভোর হওয়ার আগেই। দিনের বেলা জানাযা হলে উপস্থিতি বেড়ে যেত বলে ধারণা করা হচ্ছে।
    এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার সদর উপেজেলা নির্বাহি অফিসার মো. শরীফুল ইসলাম আই নিউজকে বলেন, মরহুমের পরিবার এবং স্থানীয় আলেমে-দ্বীনগণ দারুণভাবে সহযোগিতা করেছেন। বরুণার পীর সাহেব সবাইকে বলে দিয়েছেন জানাযায় জমায়েত করা যাবেনা। ঘরে বসে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে মাদ্রাসা ছাত্রদের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি জানাযার নামাজ পড়েই চলে গিয়েছেন। কারণ তিনি উপস্থিত থাকলেই মানুষের ভিড় হয়ে যাবে। আমরা দেখেছি আলেমগণ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি- সবাই আইনের প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল এবং সহযোগিতাপরায়ণ। তাদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেছে।’
    উপেজেলা নির্বাহি অফিসার বলেন, ‘জেলা প্রশাসক মহোদয় সারারাত খোঁজ নিয়েছেন। বিষয়টি সমন্বয় করেছেন, যেন জনসমাগম ছাড়াই সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। পুলিশ ও র‌্যাব দারুণ কাজ করেছে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা বড় ধরনের গণজমায়েত এড়াতে পেরেছি।’
    হাদিসে হাফেজ
    মৌলভীবাজার তথা বৃহত্তর সিলেটের শীর্ষ আলেম আল্লামা আব্দুল মুমিত ঢেউপাশী জেলার ঐতিহ্যবাহী বরুণা মাদ্রাসার শায়খুল হাদিস ছিলেন।
    তিনি শহরের জামিয়া দ্বীনিয়া, দারুল উলুম এবং সিলেটের জামেয়া কাজিরবাজারসহ বিভিন্ন কওমী মাদ্রাসায় ইলমে দ্বীনের খেদমত করে গেছেন।
  • দরসে-হাদিস (হাদিস অধ্যয়ন) নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন আল্লামা ঢেউপাশী
    আলেমরা জানান- শায়খুল হাদিস আব্দুল মুমিত ঢেউপাশী ছিলেন হাদিসের হাফেজ। ধারণা করা হতো- প্রায় সকল হাদিস তার মুখস্থ ছিলো।
  • DC Office Moulvibazar তার ফেসবুকে বলেছেন, আলহামদুলিল্লাহ।
    আল্লাহর অশেষ রহমতে মুহতারাম আলেমে দ্বীন,জেলা প্রশাসন এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সহ সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টায় 
     মৌলভীবাজারের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মোহাদ্দেস মাওলানা আবদুল মুমিত (৭২) এঁর দাফন সম্পন্ন হয়েছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর মতো আরেকটি জানাজা কেন্দ্রিক বড় গণজমায়েত সফলভাবে পরিহার করা সম্ভব হলো।
    উল্লখ্য প্রখ্যাত মোহাদ্দেস মাওলানা আবদুল মুমিত গতকাল (২৮ এপ্রিল ২০২০) বিকালে সদর উপজেলার ঢেউপাশা গ্রামের নিজ বাড়িতে স্টোক এ আক্রান্ত হন।
    পরবর্তীতে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করা হয়।
    এ সংবাদ অবগত হওয়ার পরেই জেলা প্রশাসন উদ্যোগী হয়ে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সমুহের সহায়তায় নেতৃস্থানীয়/ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ এবং মরহুমের পারিবারের সীদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ (২৯ এপ্রিল) বাদ ফজর সীমিত পরিসরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে জানাজা ও পূর্ণ ধর্মীয় মর্যাদায় তাঁকে পারিবারিক কবরস্থান দাফন করা হয়।
    জেলা প্রশাসন প্রয়াত এই আলেমে দ্বীন এর রুহের মাগফেরাত কামনা করছে এবং তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছে।
শেয়ার করুন